প্রণব মুখার্জি ছিলেন ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য

 

।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।

রাজনীতিতে পরম মিত্র যেমন থাকে, চরম শত্রুও সমাহারে দৃশ্যমান। কিছু মানুষ এসবের সকল কিছু অতিক্রম করে অনেক উঁচুতে জায়গা করে নেন। জাগতিক কোন বিদ্বেষ তাদের স্পর্শ করে না। সদ্য প্রয়াত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তেমন একজন মহীরুহ। তিনি চলে গেলেন একা, অজানা পথে চিরকালের জন্য। যেখান থেকে আর কখনো কেউ আসতে পারে না। কিন্তু এই উপমহাদেশ কি হারিয়ে বসলো, কতটুকু শূণ্যতা সৃষ্টি হলো সে হিসেব মেলানো খুবই কঠিন। যতই দিন যাবে, তার শূণ্যতা ততটাই অনুভব করবে উপমহাদেশ। 

 

৩১ আগস্ট সন্ধ্যায়ই খবর পেলাম ভারতীয় উপমহাদেশের প্রবীণ রাজনীতিক ও বাঙ্গালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি আর নেই। সংবাদটা শোনার জন্য হয়তো মানষিক প্রস্তুতি ছিল তার পরিবারের ও ভারতসহ বাঙ্গালি জনগোষ্টির। কারণ, তার মস্তিষ্কে জমাট বাঁধা রক্ত, দোসর হয়েছিল করোনাভাইরাস। তারপর থেকেই ছিলেন গভীর কোমায় ছিলেন তিনি। আর এই ধরনের অবস্থা থেকে সাধারনত মানুষ ফিরে আসে না। বরং ফিরে আসাটাই মিরাকেল। অবশ্য সেই মিরাকেলটা আর তার সাথে ঘটেনি। কঠিন লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত সোমবার ভারতীয় সময় ৫টা ২৫ মিনিটে হার মানলেন উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় এক বাঙালি রাজনীতিবিদ। চলে গেলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি দুই বাংলায় ‘প্রিয়জন’ ও ‘জনপ্রিয়’ প্রণব মুখার্জি।

 

করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই সাবেক রাষ্ট্রপতির শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। ৯ আগস্ট তিনি নিজের বাড়িতে পড়ে যান। মাথায় আঘাত লাগে, অবশ হতে থাকে বাঁ হাতও। পরের দিনই তাকে দিল্লীর সেনা হাসপাতালে নেয়া হয়। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানান, দ্রুতই অস্ত্রোপচার দরকার। অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে গিয়ে বোঝা যায়, প্রণব মুখার্জির শরীরে বাসা বেঁধেছে করোনাভাইরাস। সেই খবর তিনি নিজেই টুইট করে জানিয়েছিলেন।

 

প্রণব মুখার্জি ভারতীয় রাজনীতির অলিন্দে পরিচিত ছিলেন ট্রাবলশ্যুটার বা ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসেবে। ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি চাণক্য। যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি তিনি সামলে দিয়েছেন ক‚টনৈতিক বুদ্ধির জোরে। যে কোনো কঠিন যুদ্ধেই জয় অনিবার্য করেই ফিরতেন তিনি। তবে এবারের সংকটটা আর কাটিয়ে উঠতে পারলেন না! এবারে রত্নহারা হলো ভারত। চলে গেলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি। ভারতরত্ন প্রণব মুখার্জি।

 

প্রণব মুখার্জি একাধারে ছিলেন বাংলাদেশের নড়াইলের জামাই, অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান অনেক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার দুই কণ্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। নানা ইস্যুতে পাশে দাঁড়ানোয় বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছিলেন তিনি খুই পরিচিত।

ভারতের রাজনীতিতে অত্যন্ত ধীশক্তির অধিকারী প্রণব মুখার্জির জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের অদূরের মিরিটি গ্রামে। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং কংগ্রেস নেতা। জেলা কংগ্রেস সভাপতি, এআইসিসি সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদেরও সদস্য হয়েছিলেন। সেদিক থেকে অবশ্যই রাজনীতি প্রণব মুখার্জির উত্তরাধিকারসূত্রেই পাওয়া। যদিও সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন রাজনীতির সাথে কোন সম্পর্কই ছিলনা তার। বরং ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্বের পর মন দিয়েছিলেন আইনের ডিগ্রি অর্জনের জন্য।

 

তবে আইনের ডিগ্রি অর্জন করলেও আইনজীবীর পেশাকে বেছে নিনেনি তিনি। বরং ডাক ও তার বিভাগে করণিক এবং হাওড়ার বাঁকড়া স্কুলে শিক্ষকতা পর্বের পর ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৭ সালে নড়াইলের মেয়ে শুভ্রা দেবীকে বিয়ে করেন। বিদ্যানগর কলেজে যোগ দেয়ার পর টানা পাঁচ বছর আমতলাতেই ছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে বিদ্যানগর কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হরেন্দ্রনাথ মজুমদারের হাত ধরে তার রাজনীতি শুরু। তারপর এই রাজনৈতিক সফর প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে যায় অনেক দূরের অন্য ঠিকানায়। কংগ্রেসের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেসের রাজনীতিতে অনেক কংগ্রেস নেতাদের পারিবারিক আভিজাত্যই ছিল সবচেয়ে বড় সম্বল, প্রণব মুখার্জির ক্ষেত্রে তা ছিল না। সাফল্যের পেছনে ছিল তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, মেধা এবং তার পরিশ্রম করার ক্ষমতা। যখন যে দায়িত্বই পেয়েছেন, সেটাকেই সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।

 

তিনি রাষ্ট্রপতি পদে যাওয়ার আগে শেষ তিন বছর, অর্থাৎ ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত লোকসভার নেতা ছিলেন। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও প্রণব মুখার্জিকে সম্মান করতেন, নানা বিষয়ে তার উপদেশ নিতেন। এত কিছুর পরও শিকড়কে ভোলেননি কখনও। দিল্লীর ক্ষমতার এত বছর বিচরণ করেও খাঁটি বাঙালিই থেকে গিয়েছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সেই ধুতি-পাঞ্জাবিই ছিল প্রিয় পোশাক। পুজোর সময়ে বীরভূমে নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে পারিবারিক দুর্গোৎসবে তন্ত্রধারক হওয়াই ছিল তার জীবনের নিয়ম। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেয়ার পর সে অর্থে আর সক্রিয় রাজনীতিতে না থাকলেও থেকে গিয়েছিলেন রাজনীতির অভিভাবক হয়ে। তাই প্রণব মুখার্জির চলে যাওয়া ভারতীয় রাজনীতিতে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করল।

 

১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দুঃসময়ে ইন্দিরাজির প্রতি আনুগত্যে অবিচল থাকার পুরস্কারটাই ১৯৮০ সালে পেয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। ১৯৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরেই প্রণব মুখার্জিকে ইন্দিরা গান্ধি মন্ত্রী করেছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুও পরে প্রণব মুখার্জির ঘোর দুর্দিন শুরু হয় কংগ্রেসে।

রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দিকে তিনি কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন। আলাদা দল গড়ে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব¡ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। পরে ১৯৮৯ সালে তিনি কংগ্রেসে ফিরে আসেন। পরে বাণিজ্যমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। মনমোহন সিংহের সেই মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন প্রণববাবু। প্রথমে তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। পরে হন অর্থমন্ত্রী। ২০১২ সালে দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে চলে গিয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার আগে পর্যন্তই তিনি থেকে গিয়েছিলেন ওই অবস্থানে। একজন বাঙালি হয়ে দিল্লীর রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছানো অবশ্যই ইতিহাস তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।

 

বৈশ্বিক রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা আর কৌশলের কারণে প্রণব মুখার্জি পরিণত হয়েছিলেন একজন বড় মাপের শিক্ষকে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি কীভাবে পাল্টাচ্ছে, ভারত বা এশিয়ার জন্য তার তাৎপর্য প্রভাব কেমন হবে- এগুলো নিয়ে তার বিরাট দক্ষতা, এটা ছিল তার বিরাট গুণ। উনি বিরাট একজন শিক্ষক। উনাকে না জিজ্ঞেস করে ইন্দিরা গান্ধী বা মনমোহন সিং কিছু করতেন না। এমনকি নরেন্দ্র মোদীও তাঁর কাছে পরামর্শ নিয়েছেন। সুতরাং উনি বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যে সেটা সবাই জানে। কিন্তু তিনি যে বড় মাপের শিক্ষক সেটা সবার জানা নেই।

 

মূলত রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রণব মুখার্জি আলো ছড়াতে শুরু করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারতীয় পার্লামেন্টে তার তৎপরতার মাধ্যমেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই বড় কারণ প্রণবের জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশে। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মেধায় আকৃষ্ট হয়ে তাকে কংগ্রেসে নেন ও বড় বড় নেতাদের রেখে তাকেই নাম্বার টু হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এক সময় তাকে ইন্দিরা গান্ধীর মানসপুত্র বলা হতো। প্রণব মুখার্জি তার রাজনৈতিক জীবনে পাঁচবার রাজ্যসভায় গিয়েছেন আর লোকসভায় নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০০৪ সাল থেকে ২০১২ সালে, যা তাকে পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

 

নিজের বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার আলোকে বই লিখেছেন অন্তত আটটি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত বইয়ে বাংলাদেশে ২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পেছনের ভূমিকাও উঠে এসেছিলো। যদিও ভারতে কংগ্রেসের বাইরেও উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে তার গ্রহণযোগ্যতা তাকে রাজনীতিতে বিশেষ মর্যাদায় তুলে এনেছিল।  যে কোনো সংকটময় মুহূর্ত থেকে উত্তরণে তার তৎপরতায় বারংবার ঋদ্ধ হয়েছে ভারতের রাজনীতি। কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়েই তিনি ভারতের রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলো এমনকি বিজেপি নেতাদেরও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।

 

বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাদের সাথেই প্রণব মুখার্জির সম্পর্ক ছিল খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ। বাংলাদেশের এক তরুন রাজনৈতিক নেতা বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানিও তার মধ্যে অন্যতম। ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসেই প্রণব মুখার্জির সাথে প্রথম স্বাক্ষাত জেবেল রহমানের। প্রথম স্বাক্ষাতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মশিউর রহমান যাদু মিয়ার সাথে সম্পর্ক অবস্থান সম্পর্কে প্রণব মুখার্জির আলোচনা তরুন এই নেতাকে অভিভূত করে। জেবেল রহমানও তার ভক্তে পরিনত হয়। সে থেকে সে সম্পর্ক এক পর্যায়ে খুবই ঘনিষ্ট হয়ে উঠে। সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রæয়ারিতেও প্রণব মুখার্জির সাথে স্বাক্ষাত করেন জেবেল রহমান। প্রণব মুখার্জি সন্তান সমতূল্য এই নেতাকে স্নেহ করতেন। স্বাক্ষাতে আলোচনা করতে উপমহাদেশ আর বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে। জেবেল রহমান গানি বলেন, " প্রণব মখার্জির রাজনৈতিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আমাকে রাজনীতি সম্পর্কে অধ্যায়নে উৎসাহ যুগিয়েছে। ভারতের মত একটি দেশের রাষ্ট্রপতি থাকার পরও তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন মাটি ও মানুষের নেতা। অহঙ্কার যাকে স্পর্শ করতে পারে নাই।"

 

শেষ জীবনে প্রবীণ রাজনীতিক প্রণব মুখার্জি মারাত্মক বাস্তবতা ব্যাখ্যা করেছিলেন ভারত-বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট নিয়ে। বাংলার আপামর জনসাধারণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে ভীষণ তিক্ততা বিরাজ করছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম বলেন, "মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে ভারত একটি সৌহার্দ্যের আত্মিক সম্পর্কে উন্নীত হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার চার যুগ পরে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের চরম উদাসীনতা এবং বিভিন্ন পক্ষপাতিত্বের কারণে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতায় সীমাহীন অবদান রাখার পরও ভারতকে এখন পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে অনেক বেশি আধিপত্যবাদী এবং শত্রু মনে করে।"

 

উত্তরে ভারতের বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক বলেছিলেন, "শোন বাঘা, তুমি বাংলাদেশ কে দেখো তোমার দেশপ্রেমের চোখ দিয়ে। আর ভারত বাংলাদেশকে দেখে তাদের স্বার্থের দৃষ্টিতে। মিসেস গান্ধীর মৃত্যুর পর উভয় পক্ষের চিন্তা চেতনায় এই পার্থক্যটা চিরদিন থেকেই গেল।" এমন অকপট স্বীকারোক্তি প্রকাশের দৃঢ়তা সকল রাজনীতিকের থাকে না।

 

ভারতের বাঙালি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় প্রণব মুখার্জি বরাবরই বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত নাম। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সাথে তৈরি হওয়া সম্পর্ক তিনি সযত্নে যেমন লালন করেছেন। প্রণব মুখার্জি হচ্ছেন একমাত্র ভারতীয় বাঙ্গালি যিনি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ছাপ রেখেছেন, রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তার শ্বশুরবাড়ি বাংলাদেশে। সে কারণে একটা টান তার থাকতে পারে। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই তিনি নানাভাবে সম্পৃক্ত।

 

প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের বন্ধু। আর এই বন্ধুত্বের সূচনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক সিরিজের প্রথমটি দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস–এ তিনি একটি পুরো অধ্যায়ই লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ: দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’ নামে।

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রণব লিখেছেন, ‘১৫ জুন বাজেট অধিবেশন চলাকালে আমি রাজ্যসভায় বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া। একজন সদস্য জানতে চান, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। উত্তরে আমি জানাই, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমেই এর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। রাজনৈতিক সমাধান মানে গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে বস্তুগত সহায়তা করা। আমি সংসদকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার বহু নজির আছে।’

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের প্রতি প্রণব মুখার্জির দুর্বলতা অপরিসীম; অনেকটা জ্যোতি বসুর মতোই। জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি ছিল বারদিতে, লোকনাথ বাবার আশ্রমের পাশেই। সেই অর্থে তিনি ছিলেন বাঙাল। প্রণববাবু আপাদমস্তক ঘটি তাঁদের আদি বাড়ি দীঘাতে। তবে বিবাহসূত্রে তিনিও বাংলাদেশের জামাই।

 

বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রণব মুখার্জির একধরনের হার্দিক সম্পর্ক রয়েছে। এ নিয়ে তাঁর নিজের ব্যাখ্যা হলো: ‘ভারত ও বাংলাদেশ শুধু প্রতিবেশী নয়; তাদের মধ্যে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক ও জাতিগত বন্ধন। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়টি ভারত সব সময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। কেননা, আমরা অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা ও ভৌগোলিক সংহতি ধারণ করি।’

 

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। ভারতীয় রাজনীতিতে তার মতো শিক্ষিত, মার্জিত, সংস্কৃতিবান ও বিচক্ষণ রাজনীতিক খুব কম এসেছেন। যখন যে পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, সব পদেই তিনি যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারিয়েছে এক অকৃত্রিম বন্ধুকে। ভারতের রাজনীতিতে তিনি যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন, সেজন্য তিনি দীর্ঘদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন