জিবি নিউজ 24 ডেস্ক //
উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনের স্বপ্ন ঘরছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বাসা থেকে টাকা, স্বর্ণালংকার ও শিক্ষা সনদ নিয়ে উধাও হওয়া রাজধানীর পল্লবীর কলেজপড়ুয়া তিন বান্ধবী। তারা কক্সবাজার থেকে নৌপথে জাপানে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা করেছিলো। তবে দেশছাড়ার আগেই তাদের উদ্ধার করা হয়।
প্রায় এক সপ্তাহ নিখোঁজ থাকার পর তাদেরকে উদ্ধার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। পরে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে র্যাবের কর্মকর্তারা। বুধবার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক।
তিন তরুণী হলো- স্নেহা আক্তার (১৬), কাজী দিলখুশ জান্নাত নিশা (১৫) ও কানিজ ফাতেমা (১৬)।
মো. মোজাম্মেল হক জানান, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দীর্ঘ দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা ঘরে আবদ্ধ ছিলো। এসময়ে তারা বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে জাপানি সংস্কৃতির প্রতি তারা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে রাজধানীর দিয়াবাড়ীতে ঘুরতে গিয়ে হাফসা চৌধুরী নামে এক নারীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়। তিন বান্ধবী হাফসার সঙ্গে পরিকল্পনা করে কক্সবাজার থেকে নৌপথে জাপান যাওয়ার পরিকল্পনা করে।
তিনি জানান, হাফসার পরামর্শে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা নিজেদের ইমেইল, ফেসবুক ও ব্যবহৃত মোবাইল গাবতলীতে নষ্ট করে ফেলে। এটা করার অন্যতম কারণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন তাদের অবস্থান চিহ্নিত না করতে পারে। এরপর তারা বাসে করে কুমিল্লা ময়নামতি যায়। পথিমধ্যে তারা নিজেদের পরিচয় গোপনের উদ্দেশ্যে নিজেদের চুল কেটে ফেলে এবং পশ্চিমা বেশভূষা ধারণ করে। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পৌঁছে তারা কেডস্, পোশাক ও একটি মোবাইল কেনে। কিন্তু মোবাইল কিনলেও তারা সিম না কিনে ওয়াইফাই ব্যবহার করে।
এদিকে, শনিবার (২ অক্টোবর) রাতে নিখোঁজ শিক্ষার্থী দিলখুশ জান্নাত নিশার বড় বোন অ্যাডভোকেট কাজী রওশন দিল আফরোজ বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি মামলা করেন।
এ ঘটনায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, যার প্রেক্ষিতে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-৪ এর একটি গোয়েন্দা দল এ বিষয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে। র্যাব-৪ এর গোয়েন্দা দল, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ও কক্সবাজারে থাকা র্যাব-৪ এর টিমের মাধ্যমে জানতে পারে, নিখোঁজ তিন তরুণী মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) রাত আনুমানিক ৯টার দিকে ছদ্মবেশে কক্সবাজার থেকে বাসে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রাওনা দিয়েছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আবদুল্লাহপুরের বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে নিখোঁজদের উদ্ধার করে।
ঘটনার অনুসন্ধান ও ভিকটিমদের প্রাথামিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে র্যাব জানিয়েছে, তারা তিনজন বান্ধবী। মিরপুরের একটি কলেজে লেখাপড়া করে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অপসংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। দিনদিন লেখাপড়ার প্রতি তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যার ফলে তাদের পরিবার পড়ালেখার জন্য ও ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলার জন্য চাপ দিতো। কড়া বিধিনিষেধের ফলে একটা সময় তারা পরিবারের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়ে।
র্যাব জানায়, তাদের নিজেদের পরিবারের নিয়ম-কানুন ভালো লাগতো না এবং এসব সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়ম-কানুন তাদের কাছে অত্যাচার মনে হতো। তারা মূলত উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখতো। তারা জাপানি সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। জাপানি সিনেমা-সিরিয়াল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে জাপানি ভাষাও কিছুটা আয়ত্ত করে নেয়। দেশ ছেড়ে জাপান যাওয়ার পরিকল্পনার কারণ হিসেবে জাপানি সংস্কৃতিতে নারী পুরুষের সমঅধিকার, স্বাধীনতা, দত্তক হওয়ার সুযোগ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ না থাকার কথা উল্লেখ করে।
‘দুই মাস আগে তিন বান্ধবী তরিকুলের সঙ্গে দিয়াবাড়ী এলাকায় ঘুরতে গিয়ে হাফসা চৌধুরী নামের এক নারীর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। ওই নারীর সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে তারা জাপানে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানান। হাফসা চৌধুরী তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের জন্য ফেসবুকে বন্ধু হয়। ম্যাসেঞ্জারে নিয়মিত চ্যাটিংয়ে তারা হাফসার সঙ্গে কক্সবাজার রুট দিয়ে নৌপথে জাপান যাওয়ার পরিকল্পনা করে। সেই উদ্দেশ্যে গত ৩০ সেপ্টেম্বর বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।’
র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, বাসা থেকে বেরিয়ে তারা প্রথমে গাবতলী যায়। সেখানে নিজেদের মোবাইল ও ফেসবুক নিষ্ক্রিয় করে। পরে নৌকাযোগে নদী পার হয়ে আমিন বাজার এলাকায় গেলে হাফসার দুজন লোক কালো রঙের নোহা গাড়িতে করে তাদের অজ্ঞাত একটি জায়গায় নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে সিএনজিযোগে তাদের কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চট্টগ্রামে যাওয়ার পরামর্শ দেয়।
‘তিন বান্ধবী তাদের কথামত কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে চট্টগ্রামগামী কোনো ট্রেন না পেয়ে বাসে করে কুমিল্লার ময়নামতি যায়। পথে তারা নিজেদের পরিচয় গোপনের উদ্দেশ্যে ও পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে নিজেদের চুল কেটে ফেলে পশ্চিমা বেশভূষা ধারণ করে। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পৌঁছে তারা কেডস, পোশাক ও একটি মোবাইল কেনে। সেখান থেকে তারা পুনরায় বাসযোগে চট্টগ্রাম সিনেমা প্লেস বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দুটি মোবাইল কিনে বাসে করে কক্সবাজারে পৌঁছায়’ বলেন র্যাব কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, মোবাইল কিনলেও আত্মগোপনে থাকার জন্য তারা কোনো সিম কেনে না। ১ অক্টোবর কক্সবাজার পৌঁছে তারা ৫ অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজারের কলাতলির একটি হোটেলে অবস্থান করে ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করে। এরপর ২ অক্টোবর তারা কক্সবাজার সি-বিচ এলাকায় বেড়াতে গেলে হাফসার লোক পরিচয়ে আসিফ ও শফিক নামের দুজন তাদের কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও কিছু নগদ টাকা নিয়ে নেয়। এ ঘটনায় তারা আতঙ্কিত হয়ে হোটেল অবস্থান নেয় ও হোটেলের আশপাশে র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ৫ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে ছদ্মবেশে বাসে করে কক্সবাজার থেকে রওনা হয়। সেখান থেকে তারা ঢাকার আব্দুল্লাহপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পৌঁছালে র্যাবের একটি দল তাদের উদ্ধার করে র্যাব-৪ কার্যালয়ে নিয়ে আসে।
হাফসা নামের নারীকে শনাক্তের ব্যাপারে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, হাফসার কোনো মোবাইল নম্বর অথবা অন্য তথ্য না থাকায় এখন পর্যন্ত তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে হাফসা ও তার সহযোগীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে র্যাব।
এদিকে, উদ্ধার তিন তরুণীকে পরিবারের উপস্থিতিতে পল্লবী থানায় হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান র্যাবের এ কর্মকর্তা।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন