আমেরিকা ট্রাম্প শাসনে কী হবে

-মোঃ নাসির, নিউ জার্সি, আমেরিকা থেকে : আমেরিকা একটি প্রবল বিক্রমশালী দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল থেকে এটা কেউ অস্বীকার করে না। অস্বীকার করতে পারে না। এই বিক্রম সর্বব্যাপী। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, অর্থনীতি-রাজনীতিতে, বিত্ত-বৈভবে বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব স্বীকৃত। যুদ্ধ-সামর্থ্যে আমেরিকা আজ অদ্বিতীয়। আমেরিকার এই বিধ্বংসী ক্ষমতার কথা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকি, ইরাক-আফগানিস্তানের বর্তমান প্রজন্ম শুধু নয়, ভবিষ্যতেরও অনেক অনেক প্রজন্ম ভীতি নিয়ে স্মরণ করবে। আমেরিকার এই শৌর্য-বীর্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে ভয়-ভীতির সঙ্গে এত দিন সমীহও ছিল। অনেক দেশের আপৎকালে আমেরিকার স্বার্থ নিরঙ্কুশ রেখেও তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকার অভিভাবকত্ব মেনে নিয়েছে। আমেরিকাকে নিয়ে আমেরিকার মানুষ, আমেরিকানদের শ্লাঘাবোধ ছিল ঈর্ষণীয়। আমেরিকা ছিল বিশ্বের সব অঞ্চলের পঞ্চাৎপদ, দারিদ্র্যপীড়িত ভবিষ্যদ্বিহীনদের চোখে স্বপ্ন পূরণের দেশ। আকাশ ছোঁয়ার দেশ। বর্তমানে এটা প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৬ থেকে সবার কাছে আমেরিকা ধূসর-বিবর্ণ। বিশ্ব পরিসরে আমেরিকার আজ সেই শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাÑদুই-ই ক্ষয় হতে চলেছে বলে ভাবছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। আমেরিকার অভ্যন্তরেও নাগরিক সমাজে দেশ নিয়ে আর আগের সেই শ্লাঘাবোধ দেখা যায় না। আর যাদের কাছে আমেরিকা ছিল স্বপ্নের দেশÑসেই অভিবাসীরাও আজ আর সে রকম স্বপ্ন দেখে না। তাদের নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়া, সন্তানদের সুশিক্ষা দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিৎ-নিরাপদ করে গড়ে তোলার স্বপ্নও ফ্যাকাশে। এ জন্য সব মহলই দায়ী করতে চান বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রশাসনকে। সবাই মনে করেন, রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ রাষ্ট্র, বিশেষ করে আমেরিকার মতো দেশের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখে পরিচালনা করার জন্য যে মেধা-মনন এবং প্রাজ্ঞতা আবশ্যক, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে তার অভাবই এর কারণ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে মেজাজ ও মানসিকতা নিয়ে ব্যবসা করে বিলিয়নিয়র হয়েছেন, সেই একই মানসিকতা নিয়ে আমেরিকার মতো একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়েই এই বিপত্তি। এবার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন নিয়ে প্রচারণায় নেমেছেন। ইতিমধ্যেই তার প্রচারণা ঘিরে ভয়ংকর ভয়ংকর সংঘর্ষ এবং হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। তার প্রচারণাকে কেন্দ্র করে ওরেগানের পোর্টল্যান্ডে গোলাগুলির ঘটনায় ১ জন নিহত হয়েছেন। উইসকনসনেও তার প্রচারণা নিয়ে গোলযোগ হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, ট্রাম্পের প্রচারণাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে আরও সহিংসতা ঘটবে, যা আমেরিকার ঐক্য ও সংহতিতে চিড় ধরাবে। ট্রাম্পকে নিয়ে কেবলই যে ডেমোক্র্যাটদের বিরোধিতা তা নয়, এবার তাকে নিয়ে রিপাবলিকানদের মধ্যেও অসন্তোষ ও অস্বস্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মধ্যে রিপাবলিকান দলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়র ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউস থেকে সরানোর জন্য ডেমোক্র্যাট দলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও বারাক ওবামার সঙ্গে জোট বেঁধেছেন। আমেরিকা ঐতিহ্যের দেশ। অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা করে এগিয়ে চলার মধ্য দিয়েই আমেরিকার আজকের অবস্থান। আমেরিকার শক্তির বড় একটি উৎস ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল’ এই মন্ত্র। শতবর্ষের চর্চা আর সাধনায় ঐক্যের এই চেতনায় আমেরিকানরা উজ্জীবিত। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট হওয়ার দুর্বিনীত আকাক্সক্ষা সেই শক্তিতে চিড় ধরাচ্ছে। ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারছেন না ট্রাম্প। যে করেই হোক তার দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট হওয়া চাই-ই চাই। এ জন্য দেশের ঐক্য-সংহতি ভেঙে পড়ুক, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ুক, দু-চারজন মানুষ মরুক, তাতে তার কিছুই যায়-আসে না। এ জন্য যদি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য মলিন হয়, বিশ্বব্যাপী মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা ক্ষয় হয় হোক। দেশের মানুষের স্বার্থ, বহির্বিশ্বে আমেরিকার অবস্থান ক্ষুণ্ন হোক, ফাটল ধরুক তাতে যেন ট্রাম্পের কিছুই যায়-আসে না! যায়-আসে না বলেই পরিস্থিতি বুঝে হোক, না বুঝে হোক, যেকোনো মন্তব্য করতে, যেকোনো পদক্ষেপ নিতে ট্রাম্প বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। অতি সম্প্রতি পুলিশের হাতে কালো মানুষ জর্জ ফ্লয়েডসহ কয়েকজনের মর্মান্তিক মৃত্যুতে বিক্ষোভে-প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে আমেরিকা। বিভিন্ন স্থানে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা প্রতিরোধ-প্রতিবাদ হয়। বহু নারী-পুরুষ গ্রেফতার হন। সেখানে ট্রাম্পের আচরণে তার বিরুদ্ধে কেবল মানুষের ক্ষোভই বৃদ্ধি করে। এছাড়া এ শতাব্দীতে মানবসভ্যতার জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর অভিশাপ হয়ে যে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, সে করোনাভাইরাস নিয়েও ট্রাম্পের আবোল-তাবোল কথাবার্তা এবং অবহেলায় বিশেষজ্ঞ যারা তাদের মতে, মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তোলে। আমেরিকায় সংক্রমণ রোগের সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞ বলে যিনি খ্যাতিমান, অ্যান্থনি ফাউসির কথাকেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবজ্ঞা করে চলায় আমেরিকায় বহু মানুষের অকারণ মৃত্যু হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অনেকে এও মনে করেন, অবহেলা-অবজ্ঞা না করে ট্রাম্প যদি বিশেষজ্ঞদের কথামতো করোনার বিরুদ্ধে সময়মতো পদক্ষেপ নিতেন, তবে অনেক মানুষই বেঁচে যেতেন এবং করোনাভাইরাস এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগও পেত না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবহেলা ছিল চরম দুঃখজনক। সাংবাদিকদের সঙ্গে তার আচরণও প্রেসিডেন্ট হিসেবে অত্যন্ত অসংগত। অনেকে দৃঢ়ভাবে মনে করেন, নাগরিকদের প্রতি তার আচরণ মোটেও প্রেসিডেন্টসুলভ নয়। সাধারণ নাগরিকদের প্রতি তার অবহেলা ও অমর্যাদা প্রদর্শন অত্যন্ত দুঃখজনক। উল্লিখিত এসব কারণেই আজ আমেরিকার ভাবমূর্তি অনুজ্জ্বল হতে চলেছে। আর মানুষের ক্ষোভও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অরেগনের মেয়র টেড হুইলার অত্যন্ত ক্ষোভ নিয়ে বলেছেন, ট্রাম্প আমেরিকার মানুষের মধ্যে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন এবং বিভক্তি সৃষ্টি করে চলেছেন। সেই ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই কলোনি যুগের ১৩টি রাজ্য গ্রেট ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য থমাস জেফারসন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, জন অ্যাডামস, রবার্ট লিভিং স্টোন এবং রজার শেরম্যান মিলে যে ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স লেখেন, যা তাদের দ্বিতীয় কংগ্রেসে অনুমোদিত হয়, তা যেন আজ ট্রাম্পের শাসনে অনেকটাই মলিন হতে চলেছে বলে আমেরিকার মৌলিকত্বে বিশ্বাসীরা দৃঢ়ভাবে মনে করেন। আমেরিকা ধনী-নির্ধন, কালো-সাদা-পীত, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান নির্বিশেষে মিলেমিশে থাকার দেশ। সেই সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিতে ক্ষত সৃষ্টি করতে চলেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কার্যকলাপ। আমেরিকার আদর্শের দেয়ালে তিনি যে চিড় ধরাতে চলেছেন, তা যদি এখনই রোধ করা না যায়, তবে ভবিষ্যতে সে ফাটল এতটাই ভয়ংকর রূপ নিতে পারে, যা হয়তো তখন চেষ্টা করেও আর ঠেকানো যাবে না। ট্রাম্পের গোপন অ্যাজেন্ডা কীÑতা জানা না গেলেও এখনই যদি তাকে ঠেকানোর উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তবে অবস্থা দাঁড়াবে সেই ‘সময়ের এক ফোড়, অসময়ের দশ ফোড়’ প্রবাদের মতো। সামনের নভেম্বরের ৩ তারিখে আমেরিকার যে নির্বাচন হবে, তাতে জয়ী হলে ট্রাম্প হবেন ৪৫তম প্রেসিডেন্ট। এবারও বিজয়ী হলে তিনি আমেরিকাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবেন, কে জানে? তাই আমেরিকার কল্যাণকামী মানুষেরা মনেপ্রাণে চান না ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হোক। তবে সেটা শুধু চাইলে হবে না, এর জন্য সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। এবারই হয়তো আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম কাউকে জেতানোর জন্য মানুষ ভোট দেবে না। ভোট দেবে ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউস থেকে সরানোর জন্য।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন