মোস্তফা কামাল মিলন, লন্ডন।|
পৃথিবীতে শুভ কর্মের সুযোগ রয়েছে অপরিসীম, তবে অপকর্মেরও কোন অন্ত নেই। তেমনি একটি আদিম ও অতি নিকৃষ্ট অপকর্ম হচ্ছে,
যে কোন ধরণের বৈষম্য। আর এর মধ্যে জঘন্যতম হচ্ছে বর্ণবৈষম্য। এর ছোবলে যুগযুগ ধরে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষকে, অহেতুক নানাভাবে অত্যাচারিত হতে হয়েছে। এর প্রয়োগ হয়ে থাকে বিভিন্ন খোলসে।
এই বর্ণববৈষম্যকে বর্ণবাদে রূপান্তরিত করে পগ্ধতিগতভাবে নানা গোষ্ঠী, নানা সমাজ, নানা জাতি এমন কি নানা দেশ ক্ষমতাকে পাকারোক্ত করা, ক্ষমতাকে ভোগ করাসহ বহুধরণে হীনস্বার্থ ও লোভ লালসাকে চরিতার্থ করার সরঞ্জাম বা অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করে আসছে। এই বর্ণবাদের বিষবাষ্পে নিপতিত হওয়ার মাধ্যমে কত মানুষকে ব্যাক্তিগত, গোষ্ঠিগত, জাতিগত এমন কি রাষ্ট্রীয়ভাবে জর্জরিত ও নিষ্পেষিত হয়ে অন্তহীন মানবেতর যাপন করতে হয়েছে এবং করতে হচ্ছে, অকালে জীবন দিতে হয়েছে ও দিতে হচ্ছে। এর যেন শেষ নেই। এক্ষেত্রে বিবেকবর্জিতদের ভণ্ডামী বিবেকবান মানুষ বা গোষ্ঠীকে পীড়া দেয়, ভাবায়। বিশেষ করে সভ্যতার ধ্বজাধারীদের কোলে যখন এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ বিকাশ, ব্যপ্তি ও প্রয়োগ দৃশ্যমান ও চলমান। কিন্তু, তাই বলে বর্ণবাদ নামক কখনও অদৃশ্য আর কখনও দৃশ্যমান এই মহামারীটিকে আশকারা না দিয়ে এর আশু অবসানের জন্য প্রতিবাদ, সংগ্রাম বা যুদ্ধ না করে, নির্বাক আর নিশ্চুপ থেকে ও চোখ বুজে ঘরের কোনে কিংবা ঝুপ-ঝাড়ের মধ্যে নমিত মস্তকে আজীবন আত্মগোপন করে থাকা যায় না। র্বণবাদের অবসান ‘অপরিহার্য ও অবস্যম্ভাবী’ এই লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যেতে এর অবসান একটা সহনীয় পর্যায়ে না নিয়ে আসলে, সভ্যতার দাবী মানুষ কি করে করবে। এরই একটি সম্যক বা বাস্তব নমুনা হচ্ছে “ব্যাটল অব কেবল স্ট্রীট” বলে বিশ্বখ্যাত বর্ণদাঙ্গা। যে দাঙ্গাটি বৃটেনে বর্ণবৈষম্যসহ সব রকমের বৈষম্যের কালোছায়ার চিরবিদায়ের আন্দোলনে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল। যা কি না বর্ণবাদের শিকার মানুষজন ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলদের মাঝে কিছুটা স্বস্তির নি:শ্বাস এনে দিয়েছিলো। এই অবিস্মরণীয় ঘটনাটি বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেগবান করে এই দুষ্টসত্ত্বাকে একেবারে অতীত করে দেবার, অন্তত: সহনীয় পর্যায়ে অবনমিত করার একান্ত প্রয়াসের মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আর এই “ব্যাটল অব ক্যাবল স্ট্রিট” নামক বর্ণদাঙ্গার ৮৫তম বার্ষিকী পালন উপলক্ষে গত ৩রা অক্টোবর রোববার দুপুর একটায় পূর্ব লন্ডনের ক্যাবল স্ট্রীট সংলগ্ন সেন্ট জর্জেস পার্কে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বর্ণবাদ বিরোধী সংগঠন, কর্মী ও সমর্থকগন এক সমাবেশে মিলিত হয়েছিলেন। এতে সাবেক লেবার লিডার জেরেমি কর্বিন, স্থানীয় লেবার দলীয় এম পি আপসানা বেগম, টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র জন বিগস্, শ্রমিক ইউনিয়ন ও কমিউনিটি-নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।
১৯৩৬ সালের ৪ঠা অক্টোবর হাজার হাজার শান্তিপ্রিয় লোক, অসওয়াল্ড মোসলীর ‘বৃটিশ ইউনিয়ন ফ্যাসিস্ট’ আয়োজিত ইহুদী অধ্যুষিত একটি এলাকা দিয়ে বর্ণবাদীদের মিছিল করে যাওয়ার অপচেষ্টাকে রুখে দিয়েছিলেন।লন্ডন
মেট্রোপলিটান পুলিশের ৬ হাজার সদস্যের ইহুদী বিদ্বেষীদের ‘ব্ল্যাকসার্ট’ মিছিলটির পথ পরিষ্কারের চেষ্টাকালে এই দাঙ্গার সূত্রপাত হয়।
এতে শতশত লোক আহত হন। তবে তারা, ইহুদী, অইহুদী, কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী ও ইংরেজ শ্রমজীবি মানুষদের দ্বারা তৈরী বেষ্টনী ভেদ করতে ব্যর্থ হয়। ঐ তারা সময় স্পেনের প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিবাদ বিরোধী স্লোগান ‘নো পাসারান’ সমস্বরে উচ্চারণ করতে থাকে। যার অর্থ হচ্ছে যে “ওদের (বর্ণবাদীদের) মোটেই ঢুকতে দেওয়া হবে না”। বর্ণবাদ বিরোধী কর্মী ও সমর্থকগন প্রথমে ক্যাবল স্ট্রীটের ডক স্ট্রীট প্রান্তে জড়ো হন এবং সেখান থেকে রেলী করে সেন্ট জর্জেস পার্কে গিয়ে উপনীত হন। বেশ কয়েকটি বর্ণবাদ বিরোধী সংগঠন “সিলেব্রেট দ্যা স্পিরিট অব ক্যাবল স্ট্রীট” নামক বর্ণবাদ বিরোধী একটি মোর্চা এই সমাবেশের আয়োজন করে। এতে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীগন বর্ণবাদ বিরোধী ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে হাজির হন। যেগুলোতে লেখা ছিলো ‘নো রেইসিজম’, ‘নো ফ্যাসিজম’, ‘ইউনাইট এগেইনস্ট দ্যা ফাঁক রাইটস’। ওই দাঙ্গায় উপস্থিত অনেকের সন্তান-সন্ততিও ৩রা অক্টোবরের সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। বেলা দুটোয় সভা শুরু হলে এতে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেন ডেভিড রসেনবার্গ ও জুলি বেগম। সভায় বক্তব্য রাখেন, জেরেমী করবেন এম পি, লাইম হাউস ও পপলার থেকে নির্বাচিত বাঙালী এম পি আপসানা বেগম, মেয়র জন বিগস ও ইউনাইটের শ্যারন গ্রাহাম। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৩৬ সনের ঐ দাঙ্গার সময় জেরেমি করবিনের মাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ইয়ং কমিউনিস্ট লীগের হ্যারল্ড রসেন ও কনি ইসাকফস্কীও ঐ সময় ওখানে ছিলেন, যাদের পুত্র বিশিষ্ট লেখক ও ব্রডকাষ্টার মাইক্যাল রজেন সাম্প্রতিক এই সভায় কবিতা আবৃত্তি করেন। এছাড়াও, এতে বক্তৃতা করেন রাবাই হার্শেল গ্লাক, ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডস মেমোরিয়াল ট্রাষ্টের পক্ষে মার্লিন সিডউয়ে, আর এম টি রেলওয়ে ওয়ারিকার্স নেতা মীক লিঞ্চ, আলতাব আলী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নূর উদ্দিন আহমেদ, বেঙ্গলী ওয়ার্কার কাউন্সিল ও দ্যা ইন্ডিয়ান ওয়ার্কার এসোসিয়েশনের (জি বি)
প্রতিনিধিবৃন্দ এবং রুথ লেভিটাস যার পিতা মরিস, ক্যাবল স্ট্রীট থেকে গিয়ে স্পেনের বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং একই সময়ে তাঁর চাচা ম্যাক্স, বাড়ী ভাড়া সক্রান্ত সফল হরতালের আয়োজন করেছিলেন যিনি পরবর্তিতে স্টেপনীর কাউন্সিলার নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ক্যাবল স্ট্রীট ২০২১ কমিটির আহ্ববায়ক রবার্ট গ্রিফিথ্ বলেছেন ইহুদী বিদ্বেষসহ বর্ণবাদ আজও অনেকের উপর অশুভ ছায়া ফেলছে। ক্যাবল স্ট্রীটের সেই যুদ্ধজয়ের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস থেকে আমাদের অনুপ্রাণিত হতে হবে।
সভাপূর্বক রেলীতে যৌথভাবে নেতৃত্ব দেন জুয়িশ
সোস্যালিষ্ট গ্রুপের ডেভিড রজেনবার্গ ও স্বাধীনতা ট্রাস্টের জুলি বেগম। চেয়ারপার্সন নুরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে আলতাব আলী ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মিছিল ও সভায় অংশ নেন সেক্রেটারী আনসার আহমেদ উল্যাহ, রাজু নেইথান, জামাল খান, সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ, আই টি সম্পাদক শেখ নূর, মতিয়ার চৌধুরী, স্মৃতি আজাদ, মোস্তফা কামাল মিলন, ফজলুর রহমান সাগর, পৃষ্ঠপোষক মুরাদ কোরেশী ও ডেইল জোন্স এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন