আলহাজ্ব জিল্লুল হক স্মরণে বিটিএ-র শোক সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত

(মোস্তফা কামাল মিলন, লন্ডন)।
————————————————————
বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডে অগণিত নক্ষত্রের মেলা। কিন্তু, কেবলমাত্র একটি নক্ষত্রই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলো সূর্য। বলা হয়ে থাকে সূর্যই সকল শক্তির উৎস এবং তা তার গ্রহ-উপগ্রহকে আলো দিয়ে সজীব করে রেখেছে। দেশ, জাতি ও সমাজ গঠনে, এ সবের স্থিতিশীলতা রক্ষায় আর উন্নয়নে এমন নক্ষত্রসম উৎসের প্রয়োজন সার্বক্ষণিক। তেমনি একজন নক্ষত্রসম উৎস ছিলেন কমিউনিটি চ্যাম্পিয়ন সদ্যপ্রয়াত জনাব আলহাজ্ব জিল্লুল হক। সূর্য আলো দেয়, উষ্ণতা দেয়। যা অন্ধকারকে দূরীভূত করে, বাঁচতে দেয়, স্বাচ্ছন্দ্য দেয়। জনাব হক, দীর্ঘ ষাট বছরেরও অধিক সময় ধরে সমাজ-তারকা হিসেবে সূর্যের মত অকাতরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে আলো ও উষ্ণতা বিলিয়ে গেছেন। এই আলোর বিচ্ছুরণ দেশে-বিদেশে শতশত মানুষের ললাটে ভাগ্যের রেখা এঁকে দিয়েছে। ল্ন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় তিনি অতন্দ্র প্রহরীর মত ছিলেন। সরব ছিলেন মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন বর্ণবাদ ও উগ্রবাদ ও বিরোধী আন্দোলনে। তিনি সাম্প্রদায়িকতাকে কখনই আশ্রয়-প্রশ্রয় বা আসকারা দেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ও মুক্তি সংগ্রামে তিনি অসামান্য ও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন বিদেশে থেকেও।
১৯৫৭ সনের মাঝামাঝি সময়ে বিলেতে ছাত্র-ভিসায় পড়তে আসার আগে পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরাম শ্রী হাই স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। এ স্কুল প্রতিষ্ঠাতায় তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। বিলেতে এসে জীবন জীবিকা নির্বাহ ও সামাজিক কর্মতৎপরতার মাঝে নিমজ্জিত থাকা সত্বেও ফেলে আসা স্কুলটির সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য তহবিল গঠনে নিজেকে নিয়োজিত করতে মোটেও কালবিলম্ব করেননি। আমৃত্যু এই তহবিলকে রেখেছিলেন সজীব, গতিশীল ও কার্যকর। এমন একজন  কর্মময় আলোকবর্তিকার মৃতুতে শোকে মূহ্যমান বিলেতের বাঙ্গালীরা, বিশেষ করে টাওয়ার হ্যামলেটসের আগের ও বর্তমান বসবাসকারীরা। বংলাদেশ টিচার্স  এসোসিয়েশন ইউকের (বিটিএ) সদস্যবৃন্দ, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তবর্গ ও শুভাকাঙ্খীগনও এর ব্যতিক্রম নন। তাছাড়া, তিনি বিটিএর উপদেষ্টাও ছিলেন। তাই, এমন একজন মহারথীর স্মরণে গত ২৭শে অক্টোবর ভার্চ্যুয়ালী জুমের মাধ্যমে বিটিএ এক শোক সভা ও দোয়ার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন বিটিএর সভাপতি আবু হোসেন আর জুম নিয়ন্ত্রণ ও উপস্থাপনার দায়িত্বটি সুচারুরূপে পালন করেন সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল বাসিত চৌধুরী। এই শোক সভায়, জনাব জিল্লুল হকের কীর্তি, অবদান ও বর্ণাঢ্য জীবনের কথা স্পষ্ট করে পরিস্ফুটিত হয়েছে। 
পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে সভা শুরু হয়। তেলাওয়াত করেন, ফারুক হোসেন। বিটিএর সভাপতি আবু হোসেন জুমে যোগদানকারী সব সদস্য এবং অথিতিদের স্বাগত জানান। এতে অতিথিগনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, টাওয়ার হ্যামলেটস বারার প্রথম বাঙালী মেয়র, বিটিএর অন্যতম শুভাকাঙ্খী মোহাম্মদ গোলাম মর্তুজা, বিবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডন্ট ও বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা শাহগীর বখ্ত ফারুক, আতিয়া বেগম ঝর্ণা, প্রয়াত জনাব জিল্লুল হকের পুত্র জীতুজ্জামান হক, মরহুমের ভাতিজা মোহাম্মদ সানু মিয়া। বিটিএর সদস্যদের মধ্যে এতে অংশ নেন জামাল আহমেদ, জামাল চৌধুরী, অ্যাডভোকেট শাহ্ ফারুক আহমেদ, এ কে এম এহিয়া, মিসবাহ আহমেদ কামাল, মোস্তফা কামাল মিলন, ইকবাল হোসেন, রাহেল এহিয়া চৌধুরী, ডক্টর রোয়াব উদ্দিন, মোশতাক চৌধুরী, হাসনা রহমান, মুনজেরিন রশীদ, রুখসানা গনি ও জেসমিন আরা।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শাহগীর বখ্ত ফারুক বলেন যে, তাঁর স্মৃতি শক্তির ছিল অত্যন্ত প্রখর। ১৯৯২ সালে তাঁর অফিসে পুরোনো একটা ফটো দেখে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজীর সঙ্গে লন্ডনে আসার কথা স্মরণ করেছিলেন জনাব হক। গোলাম মর্তুজার মতে তিনি কমিউনিটির জন্য একটি ইতিহাস। পঞ্চাশের দশকের প্রায় মাঝামাঝিতে এসে বাঙালী কমিউনিটিকে একটা অতি ক্ষুদ্র কমিউনিটি হিসেবে পেয়েছিলেন। নানা সমস্যার সম্মুখীন ক্রমবর্ধমান কমিউনিটির প্রয়োজনে ও সাহায্যার্থে একটি ওয়েলফেয়ার সেন্টার নির্মাণের উদ্দেশ্যে তিনি ও তাঁর সতীর্থগন ১ শিলিং অর্থাৎ ৫০ পেন্স করে চাঁদা তুলে অক্লান্ত পরিশ্রমের বদৌলতে ব্রীকলেইন সংলগ্ন ফোর্নিয়ার স্ট্রীটে একটি ভবন ক্রয় করেছিলেন। তিনি বিশেষ করে বর্ণবাদ বিরোধী, শিক্ষা ও বাসস্থান বিষয়ক আন্দোলনে দীর্ঘদিন ধরে ধরণী থেকে বিদায় নেওয়া অন্যান্য প্রখ্যাত সমাজ গড়ার কারিগর তৈয়বুর রহমান, সমরু মিয়া, আব্দুল মতলিব ও আহমেদ ফকর উদ্দীনের সঙ্গে একই কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছিলেন। ইকবাল হোসেনের বর্ণনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ও এখানে কমিউনিটির অধিকার প্রতিষ্ঠাতায় তাঁর অন্তর্ভুক্তি ও সম্পৃক্ততা ছিল অনবদ্য  ও অবিস্মরণীয়। ড: রোয়াব উদ্দিন তাঁকে একজন বিনয়ী মানুষ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কমিউনিটি, একজন অভিভাবককে হারিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। শাহ্ ফারুক আহমেদ দীর্ঘ পঁচিশ বছর একই সংগঠনে তাঁর সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। একজন সাহসী ব্যক্তি হিসেবে তিনি জনাব হককে আখ্যায়িত করে, ঐ সময়ে প্রায় সব ধরণের আন্দোলন ও সভা-সমিতিতে তাঁর সভাপতিত্ব করার স্মৃতি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে রোমন্থন করেন। তিনি উত্তরসুরীদের, তাঁর কর্মের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার উপর গুরুত্বারোপ করেন। জামাল চৌধুরীর ভাষায় কোন ধরণের প্রতিকূল আবহাওয়া বা অন্য কোন বাধা-বিঘ্ন কমিউনিটির কোন প্রয়োজনে তাঁকে আটকে রাখতে পারতো না। তাঁদের মত বড় মনের মানুষের ত্যাগ ও অবদান আজ আমাদের এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে আর এ কথাটা ভবিষ্যত প্রজন্মকে অবশ্যই জানাতে হবে ইতিহাসের মাধ্যমে। জনাব জিল্লুল হক যে আমাদের জন্য ও আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছেন, তা রেহেল এহিয়া চৌধুরীর বক্তব্যে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। মিসবা আহমেদ কামালের বিবেচনায় প্রয়াত এই মহান মানুষটি কমিউনিটির একটি সুদৃঢ় স্তম্ভ হিসেবে ছিলেন। এ কে এম এহিয়া চরম ত্যাগী জনাব জিল্লুল হককে একজন সুহৃদ ও জ্ঞানী মানুষ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতায় মি: হকের চিন্তাধারা ছিল সুদুর প্রসারী এবং কমিউনিটি কিভাবে মান-মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে পারে, কেবল তা নিয়েই তিনি আমৃত্যু চিন্তা-ভাবনা করে গেছেন। হাসনা রহমান ও রোখসানা গনি সমাজে তাঁর অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। ভাতিজা সানু মিয়া অত্যন্ত আবেগজড়িত কণ্ঠে, এ দেশে তাঁকে কিশোর বয়স থেকে দেখাশুনা করা, বৃহত্তর পরিবার, স্বীয় গ্রাম এবং এখানে বিলেতে তাঁর একনিষ্ঠ, আন্তরিক ও নি:স্বার্থ অবদানের কথা পরম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন যে, তাঁর চাচা একজন সত্যবাদী ও স্পষ্টবাদী মানুষ ছিলেন। তাঁর আদেশ-নির্দেশ করার ক্ষমতা ছিল। পুত্র জীতুজ্জামান হক কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেছেন যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর বাবা বাংলাদেশে এবং বিলেতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বর্ণবৈষম্য ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন এবং চ্যালেঞ্জকে লক্ষ্যবস্তু ধরে কাজ করতেন। এঁরা দুজনেই পরিবারের পক্ষ থেকে শোকসভা ও দোয়া আয়োজনের জন্য বিটিএকে ধন্যবাদ জানান ও আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এবং মরহুমের জন্য দোয়ার আবেদন জানান। মোশতাক চৌধুরী অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেন, তাঁর অতি শ্রদ্ধাভাজন শ্বশুর প্রয়াত আলহাজ্ব  হক মানুষকে, সমাজকে নিজের পরিবারের আগে স্থান দিয়েছিলেন ও কমিউনিটি তাঁর নিকট বেশী গুরুত্ব পেয়েছিলো। তিনি তাঁকে পিতার আসনে স্থান দিয়েছিলেন, যার সত্যিকার দাবীদার ছিলেন তাঁর এই প্রিয় শ্বশুর। তিনিও তাকে অকপটে নিজের সন্তানের চেয়েও বেশী ভালবেসেছিলেন বলে তিনি কৃতজ্ঞ ও অকুণ্ঠচিত্তে দাবী করেন।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন