শান্ত নদী মেঘনার তীর ঘেষা সবুজে ঘেরা ও পাখ পাখালির কলরবে মুখরিত ছোট্ট এক মায়ার শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ। মেঘনা পাড়ে অবস্থিত এ শহর সমগ্র দেশের সাথে সড়ক, রেল ও নৌপথের ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় খুব দ্রুতই একটি শিল্প ও বন্দরনগরীতে পরিণত হয়েছে যা এখন নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে ।আশুগঞ্জের অপরুপ সৌন্দর্য্যে বিমোহিত এ নগর বাসীর যেন মুগ্ধতার শেষ নেই। কেউ বলে জাদুর শহর, কেউ বলে বিদ্যুতের রাজধানী, কেউ বন্দরনগরী। এ শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা আশুগঞ্জবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি নির্গমনের অাঁকাবাঁকা চ্যানেলগুলো যেন ইতালির ভেনিস শহরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। অাশুগঞ্জে এসেছেন, আশুগঞ্জে থেকেছেন অথচ আশুগঞ্জ এর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হননি এমন মানুষ খোঁজে পাওয়া ভার।
ভ্রমণপিপাসু মানুষগুলো নাগরিক জীবনের কর্মব্যস্ততা থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচতে কিছুটা সময় প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটাতে ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।তাইতো দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতেই মেঘনার কোলঘেষা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুতে (যা ভৈরব-অাশুগঞ্জ ব্রীজ নামেও সুপরিচিত) বেড়ে যায় এসব ভ্রমণপিপাসু মানুষদের অানাগোনা। সন্ধ্যায় এ ব্রীজ বর্ণিল অালোর ঝলকানিতে অন্য রুপ ধারণ করে। তখন যেন এর সৌন্দর্য্য বেড়ে যায় দিগুণ। খোলা অাকাশের নিচে বুক ভরে প্রশান্তির বাতাস নেওয়ার জন্য এটা এক অাদর্শ জায়গা। এই সেতুতে দাঁড়িয়ে বহমান মেঘনার কলতাল ধ্বনি শুনতে শুনতে ও চরসোনারামপুরের সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে করতে কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে অাপনি টেরই পাবেন না! তাইতো এ নদী ও নগরীকে ভালোবেসে কেউ কেউ নিজেদের মেঘনার যুবরাজও বলে থাকেন। শুধুই কি তাই? মেঘনার বুকে বয়ে চলা পাল তোলা নৌকা, নদীর দুই তীরের সৌন্দর্য্য, সাদা বক, পানকৌড়ি ও গাংচিল এর উড়াউড়ি অাপনাকে মুগ্ধ করবে। আশুগঞ্জ বাসীর অাতিথেয়তারও সুনাম রয়েছে যথেষ্ট। সৌন্দর্য্য যার অঙ্গে অঙ্গে ছোট এই জাদুর শহরে মুগ্ধ অাপনি হবেনই! কারণ এ শহর যেন বিশ্বজগৎ এর সৃষ্টিকর্তা ও সুনিপুণ কারিগর মহান অাল্লাহ তাঅালার রংতুলিতে অাঁকা।
এই আশুগঞ্জেই রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যুৎ কেন্দ্র আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিঃ, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাদ্য শষ্য প্রকল্প সাইলো, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সার কারখানা আশুগঞ্জ সারকারখানা , পেট্রো বাংলা, পদ্মা অয়েল কোম্পানী ডিপো শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয় সারা বিশ্বে আশুগঞ্জকে পরিচয় করে দিচ্ছে সুনামের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও বন্দর নগরী হিসেবে। এছাড়াও আশুগঞ্জে রয়েছে অর্ধ সহস্রাধিক চাতাল কল। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি হওয়া আশুগঞ্জের লালপুরের বিভিন্ন মাছের সুস্বাদু শুটকির খ্যাতি রয়েছে।
এখন দেশের পূর্বাঞ্চল ও হাওরাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি মোকাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ। আশুগঞ্জ মোকামে বেচাকেনা হয়ে থাকে দেশের পূর্বাঞ্চলের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা,কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলের উৎপাদিত ধান। মেঘনা নদীর ভিওসি ঘাটে অবস্থিত শতবর্ষী পুরাতন এ ধানের হাটকে দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাট হিসেবে ধরা হয় এবং হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত ধানের এ হাটে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ মণ ধান বিকিকিনি হয়। আর হাওরাঞ্চলের উৎপাদিত ধানের এ হাটকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে অর্ধ সহস্রাধিক চাতালকল যা অাশুগঞ্জের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। মেঘনার নদীপথে শতশত নৌকায় করে কৃষকের ধান ঐতিহ্যবাহী এ প্রাচীন হাটে নিয়ে আসেন বেপারিরা। ভোর থেকেই নদীর তীরে ভিড়তে থাকে ধানবোঝাই নৌকাগুলো অার প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষের আনাগোনায় মুখরিত হয় ধানের এই হাট। ধান ও চালের বড় মোকাম হওয়ায় প্রতিবছর সরকারের ধান ও চাল সংগ্রহের বড় একটি অংশ হয়ে থাকে আশুগঞ্জ থেকেই। দীর্ঘদিন চালের গুণগত মান বজায় রাখার লক্ষ্যে ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে আশুগঞ্জে মেঘনা নদীর তীরে তৈরি করা হচ্ছে হচ্ছে ১ লক্ষ ৫ হাজার মেট্রিকটন ক্ষমতার আধুনিক সাইলো। জানা যায়, আশুগঞ্জের এই অত্যাধুনিক সাইলোটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ও দেশের সবচেয়ে বড় চাল সংরক্ষণাগার।
আশুগঞ্জ নদীবন্দর বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার নদীবন্দর। আশুগঞ্জ নদীবন্দরে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ ভীড় করে। আশুগঞ্জকে একটি নদীবন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২০০৪ সালে। আশুগঞ্জ নৌবন্দরকে ‘পোর্ট অব কল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রেড প্রটোকল অনুযায়ী। এ প্রটোকল অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের নৌযানের মালামাল লোডিং, আনলোডিং সুবিধা দেবে এবং এই প্রটোকলের আওতায় আশুগঞ্জ নৌবন্দর পর্যন্ত নৌপথে অাসা যাবতীয় ভারতীয় মালামাল ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া যাবে বাংলাদেশের ট্রাক ও ট্রেইলারের মাধ্যমে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে ট্রানজিটের ফলে “আন্তর্জাতিক নদীবন্দর’’ হিসাবে সমগ্র পৃথিবীতে আশুগঞ্জকে দিচ্ছে এক নতুন মাত্রা।
সড়কপথ, রেলপথ ও নৌপথ, জ্বালানী উৎস (গ্যাস) ইত্যাদি অবকাঠামোগত সুবিধাসমূহ বিবেচনা করে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলায় একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য একটি বিদেশী নির্মাণ কোম্পানির সাথে ১৯৬৬ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আশুগঞ্জ মেঘনা নদীর তীরবর্তী হওয়ায় ও অাশুগঞ্জে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস গ্যাসের সহজলভ্যতা তৎকালীন সময়ে দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য উপযোগী স্থান হিসেবে নির্ধারিত হয়। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানী লি: একটি সরকারি মালিকানাধীন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী এবং এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাওয়ার হাব। এ কোম্পানির ০৮ টি ইউনিটের বর্তমান মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৬৯০ মেগাওয়াট। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান জ্বালানী হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয়। পার্শ্ববর্তী মেঘনা নদীর পানি ব্যবহার করা হয় এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাষ্প তৈরি এবং শীতলীকরণের জন্য। কৃষি সেচের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে অাশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডিসচার্জ চ্যানেলের পানি। শুষ্ক মৌসুমে আশুগঞ্জ, সরাইল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রায় ৩৬,০০০ একর জমি সেচের জন্য ব্যবহার করা হয় এ ডিসচার্জ চ্যানেলের বিপুল পরিমাণ পানি।
এছাড়াও ছোট এই নগরীতেই রয়েছে আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড বা আশুগঞ্জ সারকারখানা নামে পরিচিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইউরিয়া সারকারখানা যা ১৯৮১ সালে মেঘনা নদীর তীরে চরচারতলা এলাকায় ৫৩৬.১৩ একর জায়গা নিয়ে স্থাপিত হয়। কারখানা সংলগ্ন মেঘনা নদী থেকেই ইউরিয়া সার উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল পানির যোগান দেয়া হয় । অারেক প্রধান কাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাসের যোগান অাসে নিকটবর্তী গ্যাসক্ষেত্র থেকে। এ কারখানায় উৎপাদিত ইউরিয়া সার দেশের বিভিন্ন জেলার ডিলারদের কাছে সরবরাহ করা হয়।
এ শহরে রয়েছে স্বনামধন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানকার শিক্ষার্থীরা তাদের কৃত্বিত্বের স্বাক্ষর রাখছে দেশে-বিদেশে। ছান্দসিক কবি অাব্দুল কাদিরের জন্মভূমি এখানেই। বইপিপাসু মানুষদের জন্য রয়েছে সমৃদ্ধ পাঠাগার। অাশুগঞ্জ এর মাটিতে জন্ম হয়েছে অসংখ্য গুণীজনের। শুধু এখানেই শেষ নয়, অাশুগঞ্জে রয়েছে সচেতন যুব সমাজ। যাদের হাতে গড়ে উঠেছে অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার জন্য 'অাশ্রয় বিদ্যাপীঠ', জরুরি প্রয়োজনে রক্তদানের জন্য সংগঠন 'ব্লাড ফর অাশুগঞ্জ' ও 'রক্তযোদ্ধা সংগঠন'। ভালো কাজে যুবকদের উৎসাহদানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে 'অালোকিত যুব সমাজ' নামের একটি সংগঠন। অাশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন 'এটেক্সা' সমাজসেবায় রাখছে উল্লেখযোগ্য অবদান। উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে কয়েকটি হাসপাতালও রয়েছে এখানে। ভোজনরসিক দের রসনার স্বাদ মেটাতে রয়েছে ছোটবড় অসংখ্য রেঁস্তোরা।
লেখক: মো. মিকাইল আহমদ
শিক্ষার্থী, অাইসিএমএবি, ঢাকা।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন