ডিসি সুলতানাকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ও প্রশ্নবিদ্ধ  বিশেষাধিকার

দেলোয়ার জাহিদ||

রাষ্ট্রপতির করুণা বিশ্বের প্রায়  প্রতিটি দেশেই চর্চা  করা হয়,  এটি তার একটি অধিকার। বাংলাদেশে ও রাষ্ট্রপতিকে  করুণার অধিকার সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ দ্বারা  অৰ্পন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের যেকোনো আদালতের রায়কে অগ্রাহ্য করে যে কাউকে ক্ষমা করার অধিকার  রাখেন। আধুনিক সভ্যতার শুরু থেকে রাষ্ট্রপতিকে এ বিবেচনামূলক সিদ্বান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়. বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবেশের  কারণে এ  বিশেষাধিকার নিয়ে মাঝে মাঝে  বিতর্কের ও সৃষ্টি হয়ছে । সাংবাদিক নির্যাতনকারীদের হোতা ডিসি সুলতানাকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক  ক্ষমা করার  প্রতিবাদে সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুল্বুল অত্যন্ত বিনয়াবনত হয়ে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন এ পত্রের সূচনায় তিনি বলেন "মহামান্য রাষ্ট্রপতি এ দেশের পেশাদার সাংবাদিকদের খুবই প্রিয় মানুষ।

রাষ্ট্রপতি বলে নয়, রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তিনি জনবান্ধব ও সাংবাদিকবান্ধব। কিন্তু সেই রাষ্ট্রপতির সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্তে গোটা সাংবাদিক সমাজ হতবাক, বিস্মিত ও আতঙ্কিত"।

উল্ল্যেখ্য জনাব মনজুরুল আহসান বুলবুল, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)  এর একজন সাবেক সভাপতি, সাবেক ভাইস চেয়ার, আইপিআই; সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব। যিনি সমাজে একজন বিনয়ী ও সদ্বজন হিসেবে পরিচিত। বিএফইউজে'র সাবেক সভাপতি হয়েও তিনি এসময়ে একজন নির্যাতিত সাংবাদিকের পক্ষে কলম ধরেছেন এর জন্য তাকে অনেক ধন্যবাদ।

গত ১ লা ডিসেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে  ঘটনাটির পটভূমি জানা যায় যে - "গত বছরের ১৩ মার্চ মধ্যরাতে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পুলিশ ছাড়া আনসার সদস্য নিয়ে জেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা দরজা ভেঙে আরিফুলের বাসায় ঢোকেন। এরপর তাঁকে মারধর করেন। পরে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে নিয়ে ‘বিবস্ত্র’ করে নির্যাতন করা হয় তাঁকে।"

আরিফুলকে আটক অভিযানে নেতৃত্ব দানকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, ‘অভিযানের সময় তার কাছ থেকে আধা বোতল মদ ও দেড় শ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে। এ অপরাধ স্বীকার করায় রাতেই আদালত বসিয়ে তাকে এক বছরের জেল দেওয়া হয়েছে এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’"

 কুড়িগ্রামের সে সময়ের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) সুলতানা পারভীনের যত সব  বিতর্কিত কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করার ফলশ্রোতিতেই  এ  সাংবাদিক নির্যাতন, নিপীড়ন ও অত্যাচারের ঘটনা  ঘটে। এতে একটি সাজানো মামলায় জেল দেয়া হয়  বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে। পরবর্তীতে যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের  তদন্তে বিষয়গুলো সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

সংবাদ সূত্রে প্রকাশ যে এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে বিষয়গুলো উল্লেখ করে শাস্তি হিসেবে তাঁর বেতন বৃদ্ধি দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। এ ছাড়া বলা হয়, তিনি ভবিষ্যতে এই মেয়াদের কোনো বকেয়া পাবেন না এবং এই মেয়াদ বেতন বৃদ্ধির জন্য গণনা করা হবে না। এনডিসি রাহাতুল ইসলামের তিনটি ইনক্রিমেন্ট কর্তন, আরডিসি নাজিম উদ্দীনকে নিম্ন ধাপে নামিয়ে দেওয়া এবং রিন্টু বিকাশ চাকমাকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এছাড়াও ঘটনার আদ্যোপান্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ২৩ নভেম্বর জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজমের জারি করা প্রজ্ঞাপনে ধারাবাহিকভাবে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সাংবাদিক নির্যাতনের জন্য অসদাচরণের দায়ে বিভাগীয় অভিযোগে ডিসি সুলতানা পারভীনকে শোকজ করা হয় (১৮/৩/২০২০)। প্রায় তিন মাস পর ২০২০ সালের ২৫ জুন তিনি লিখিত জবাব দেন। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত শুনানি নেওয়া হয় আরও প্রায় দুই মাস পর ২০২০ সালের ৯ আগস্ট। কিন্তু জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের আহ্বায়ক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব আলী কদর গত  ২ মে যে প্রতিবেদন দেন, তাতে ডিসি সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ‘প্রমাণিত হয়েছে’  বলে জানানো হয়। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সুলতানা পারভীনকে ‘গুরুদণ্ড’ দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়ে গত ৮ জুন দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়। ২২ শে জুন দেওয়া সুলতানা পারভীনের জবাব বিবেচনা করে ১০ আগস্ট ‘লঘুদণ্ড’ হিসেবে দুই বছরের বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। সুলতানা পারভীন ৬ সেপ্টেম্বর এই লঘুদণ্ডাদেশ মওকুফ করার জন্য রাষ্ট্রপতি সমীপে আপিল  করেন এবং গত ২৩ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি ‘সদয়’ হয়ে বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার দণ্ডাদেশ বাতিল করে ডিসি সুলতানাকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেন ।

বাংলাদেশের  সংবিধানের চতুর্থ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদের ৪৯ নম্বর ধারায় রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশের যেকোনো আদালতের রায়কে অগ্রাহ্য করে যে কাউকে ক্ষমা করার অধিকার  দেয়া হয়েছে  তা আমাদের অজানা নয় । এখানে দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে  ক্ষমতার অপপ্রয়াগ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের সাংবাদিক  সমাজ  তা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রাখে।

রাষ্ট্রপতির বিশেষাধিকারের এ আইন প্রয়োগ একটি অসাধারণ বিচারিক ক্ষমতা যা রাষ্ট্র প্রধান দ্বারা প্রয়োগ করা হয়। কোথাও কোথাও এটা ঐশ্বরিক ক্ষমতা যা সর্বশক্তিমান থেকে অর্পিত বলেও  মনে করা হয়।  ১৮00-দশকের শুরুতে ধর্মীয় সাহিত্যে এ বিষয়টি  সুপ্রতিষ্ঠিত হয় যে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ মানে মানুষের বিষয়ে দেবতার (ঐশ্বরিক) সম্পৃক্ততা (হস্তক্ষেপ)। … এ ধরনের  হস্তক্ষেপ, প্রায়শই কিছু না কিছু বিপর্যয় ডেকে আনে এবং পুরো ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ব করে তুলে !

ভারতের সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের অধীনে একজন অপরাধী ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে করুণার আবেদন করতে পারেন যিনি আইনের আদালতে সাজাপ্রাপ্ত। রাষ্ট্রপতির কাছে করুণার আবেদন হল শেষ সাংবিধানিক অবলম্বন  যা বাংলাদেশের মতো ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোতে ও রয়েছে।

ব্যতিক্রম কোন পরিস্থিতিতে কানাডা সরকার ও ফেডারেল অপরাধের সাথে জড়িত বা প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে  ক্ষমা মঞ্জুর করেন, যেখানে ফৌজদারি অপরাধের গুরুতর নেতিবাচক প্রভাবগুলি হ্রাস করার জন্য আইনে অন্য আর কোনও প্রতিকার দেয়া নেই। … ক্রাউনের একজন মন্ত্রীর সুপারিশ ক্রমে গভর্নর জেনারেল তার ক্ষমার বিশেষাধিকারটি প্রয়োগ করেন।

বিশ্ব জুড়ে ক্ষমা ক্ষমতার  বিশেষাধিকারটি নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন আমেরিকার  সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।  ডোনাল্ড ট্রাম্পের চূড়ান্ত কাজটি ছিল তার বিদায় লগনে ক্ষমা ক্ষমতার একাদশ-ঘণ্টার বির্তকিত অনুশীলন।  ১৪০ জনেরও বেশি লোককে ক্ষমা অনুদানের সর্বশেষ ঘোষণাটি সামনে আসার পর দেখা যায়,  ক্ষমার বিষয়ে ট্রাম্পের সামগ্রিক ট্র্যাক রেকর্ডটি রাষ্ট্রপতি পদের আদর্শ-বিধ্বংসী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচকরা এধরণের কাজকে বেঈমানি  ও  স্ব-সেবামূলক বলে উপহাস করেন । ট্রাম্পের ক্ষমা পাওয়ার সুবিধাভোগীদের অনেকেরই  হোয়াইট হাউসের সাথে ব্যক্তিগত সংযোগ ছিল, সেলিব্রিটি সমর্থক বা রাজনৈতিক মিত্রদের দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল, বা ট্রাম্পের সম্ভাব্য অপরাধমূলক অন্যায়ের অনুসন্ধানকারী তদন্তকারীদের সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করে আসছিলো। এর পরেই ক্ষমা পেয়েছিলেন তারা ।

ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ড্যানিয়েল কোবিল বলেছেন, "ট্রাম্প অনেক উপায়ে উভয় বিশ্বের সবচেয়ে খারাপের উদাহরণ রেখেছেন।" সেন্ট থমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক মার্ক ওসলার বলেছেন, "যারা ক্ষমা করার ক্ষমতা ব্যবহার করেছে তাদের মধ্যে ট্রাম্প সর্বনিম্ন নীতির  অনুসারী হবেন।" “তিনি একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া তৈরি করেছিলেন যার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের একটি ছোট গোষ্ঠীর উপর নির্ভর করেছেন - যাদের মধ্যে কিছু পিটিশনকারী যারা মামলা চালানোর জন্য অর্থও প্রদান করেছিলেন । এটি এমন একটি ব্যবস্থা যা ছিল দুর্নীতিকে আমন্ত্রণ জানানো ।

বাংলাদেশে এ আইনটির ব্যবহার নিয়ে  বিভিন্ন সময় নানাহ অভিযোগ  উঠেছে।  সরকার নিরপেক্ষতা ও ভালো বিবেক বজায় রেখে দেশে  ক্ষমাশীলতাকে  কার্যকর করবে এটা  মোটেই অপ্রত্যাশিত নয় বরং তা আমাদের  নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

মানবাধিকার পর্যবেক্ষনে বাংলাদেশের অবস্থানকে যেখানে প্রশ্নবিদ্ব করছে কতগুলো মানবাহিকার সংগঠন, যখন বাকস্বাধীনতার উপর কর্তৃত্ববাদী দমন-পীড়ন,ও  সমালোচকদের গ্রেপ্তার এবং মিডিয়া সেন্সরিং, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) অপপ্রয়োগ সহ গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যায় নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়মুক্তির ও অভিযোগ উঠেছে  ঠিক তখন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ কোন বিবেচনায়, কোন সময়ে ডিসি সুলতানাকে এ ক্ষমা করার ঘোষণা করলেন তা অবশ্যই  ভেবে দেখার বিষয়।

ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। গর্বিত বাংলাদেশের এ পথ চলায় যেখানে একের পর এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসছে, আসছে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব তথা প্রযুক্তিগত বিপ্লবের উদ্দেশ্য অর্জনের উদ্দীপনার ডাক সেখানে  আমরা রাষ্ট্রপতির করুণা নামের এ  হেয়ালীপনাকে মেনে নিতে পারি না।  যা একজন নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকারকে খর্ব করবে।

লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কানাডা ইউনিট কমান্ড নির্বাহী, প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা) নিবাসী।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন