মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার ।।
এমন সব অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমনের জন্য যে টাকার শ্রাদ্ধ হয়ে চলছে তাতে মানুষের হতবাক হওয়ার বদলে বিনোদন পাওয়া যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে খিচুড়ি রান্না শেখার মতো দুয়েকটা ট্যুর চক্ষুলজ্জার খাতিরে বাতিল হলেও বাকিগুলো বেখবরই থেকেছে। সংবাদে বা আলোচনায় না আসায় সেগুলোতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা হজম হয়ে যাচ্ছে নীরবে-নিমিষে। তা করোনার মাঝে এবং পূর্বাপরেও। অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষাসফর ইত্যাদি নামে গত কয়েক বছরে বিদেশে প্লেজার ট্যুরে টইটম্বুর সরকারি কর্মকর্তারা। আর ফাও বা বিনা পয়সায় বিনোদিত জনগন।
‘ডাইলে-চাইলে খিচুড়ি’তে মহাওস্তাদদের আর কী অভিজ্ঞতা লাগে? খিচুড়ি নিয়ে অনেক প্রবাদ, প্রবচন, চিরন্তন বাণী রয়েছে বাঙালি সমাজে। এমন কি গল্প-সাহিত্যেও। প্রয়াত কমেডিয়ান টেলিসামাদের গাওয়া ও অভিনীত ‘ডেগেরও ভিতরে ডাইলে-চাইলে উৎরাইলে গো সই’-গানটি এক সময় শোনা যেতো পথেঘাটে। সময়ের ব্যবধানে খিচুড়ি আবারো আলোচিত। একদিকে করোনা পরিস্থিতি, আরেকদিকে কথা চালাচালি বেশি হওয়ায় ‘খিচুড়ি রান্না’কে পরে ‘মিডডে মিল’ অভিজ্ঞতা নাম দেয়া হলেও শেষমেষ স্থগিত বা বাদ দিয়েছে। বাদ না দিলে বা সফরটা সেরে ফেললেই বা কী হতো? বড় জোর কয়েকদিন হালকা কথাবার্তা বা মশকরা পর্যন্তই হতো।
কি করে খিচুরি রান্না করতে হয় এবং কিভাবে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের মাঝে তা বিতরণ করতে হয় এবং কিভাবে বাজার থেকে চাল ডাল লবন কিনতে হয় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্যে পর্যায়ক্রমে একহাজার অফিসারকে বিদেশ পাঠানোর প্রজেক্ট তৈরি করাও কম অভিজ্ঞতার বিষয় নয়। খরচও কম। হাজার বা শত কোটি নয় মাত্র ১৫ কোটি টাকা।
স্কুলের কোমলমতি শিশুদের বিদেশি মানের খিচুরি খাওয়ানোর চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘোরা অফিসাররা নিশ্চয় বড় ধীমান। তাদের বিদ্যাবুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। প্রাইমারি পর্যায় ফেলে না রেখে তারা আরো উচ্চাসনের দাবিদার হয়ে যাচ্ছেন যৌক্তিকভাবে। গোটা দেশকে খিচুড়ি বানাতেও বাধা আসবে না তাদের। চুরি-খিচুরিতে হাতপাকাদের নিয়ে হৈ চৈ করে ফায়দা আসবে না-এমন একটি শীতল বার্তা কিন্তু রয়েছে। খিচুড়ি তো সামান্য ঝামেলারই কাজ। চাল-ডাল, তেল-জল-লবনের বিষয় রয়েছে। তারা ভাত রান্না শিখতে বিদেশ গেলেই বা কী করার ছিল। এরইমধ্যে রাষ্ট্র ও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের অভয় দিয়ে বলা হয়েছে, কে কী বললো তা শোনার দরকার নেই। তাদের ভালো কাজের ফলে উন্নয়ন কাজ বেগবান হচ্ছে বলে প্রশংসাও করা হয়েছে। অতএব বার্তা পরিস্কার।
মশা মারা বা পুকুর কাটা শিখতে তারা নানান দেশে গেছেন। যাবেন। ছাগল চরানো, ইংরেজিতে দরখাস্ত লেখা, টয়লেট ফ্ল্যাশ করা, মশারি টানানো, গরুর প্রজনন, লিফট দেখার মতো শিক্ষা-অভিজ্ঞতা প্রকল্প নেয়ার ব্ল্যাঙ্ক চেক তাদের কাছে কোনো বিষয় নয়।প্রশ্ন হচ্ছে- অবিশ্বাস্য-অকল্পনীয় নানা দক্ষতার জন্য বিদেশিরা কেন আসছে না বাংলাদেশে? মাত্র ১০ হাজার টাকায় একটি বটি বা একটি ড্রাম কেনার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও মিলবে? ৯ কোটি টাকার মধ্যে ৮ কোটি টাকাই লোপাটের আপটুডেট জ্ঞান নিতে কেন বাংলাদেশে ছুটে আসছে না ? পরীক্ষা না করে করোনার সার্টিফিকেট দেওয়ার বিদ্যার্জনের জন্যেও কেন কেউ আসে না?
করোনা ভাইরাসের সঙ্গে কিভাবে ফাইট করতে হয়, সেটার অভিজ্ঞতার রসদও আছে বাংলাদেশে। এ মহামারিতে সংক্রমণের ভয়ে বিশ্বের দেশে দেশে জাতীয় ও স্থানিয় নির্বাচন স্থগিত হলেও বাংলাদেশ ভিন্নতার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। এর আগে আলু চাষ দেখতে, পুকুর খনন শিখতে, ক্যামেরা বা মোবাইল কিনতে সরকারি টাকায় দল বেধে বিদেশ যাওয়ার খবরগুলো মানুষকে নন-স্টপ বিনোদন দিয়েছে। এগুলোর সঙ্গে আরো রয়েছে পরামর্শক ফি, গাড়ি কেনা ও ভবন নির্মাণে যাচ্ছেতাই কাণ্ড, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশ কেনা, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩৭ লাখ টাকায় পর্দা কেনা, গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের জন্য সাড়ে ৫ হাজার টাকার বই ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায় কেনা, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুহতারাম ডিজির পবিত্র কুরআন শরীফ না ছেপে টাকা হজম করে দেয়া, স্বাস্থ্য অধিদফতরে তিন কোটি টাকার যন্ত্র ২৫ কোটি টাকায় কেনা বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক আবজলের লোপাটের মতো কতো কাণ্ড! এমন অভিজ্ঞতা নিতে কেন ছুটে আসছে না বিদেশি জ্ঞানপিপাসুরা?
এর আগে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে তেলজাতীয় ফসলের চাষ শিখতে ও মৌ পালনে প্রশিক্ষণ নিতে ৪০ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানো এবং ৩৬ কর্মকর্তাকে শিক্ষা সফরে পাঠানোর একটি প্রস্তাব যায় পরিকল্পনা কমিশনে। শেষ পর্যন্ত ওই প্রকল্পে বিদেশ সফরে কর্মকর্তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। গরুর প্রজনন দেখতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের একটি প্রস্তাব গত মাসে বাতিল করা হয় তীব্র সমালোচনার মুখে। গরুর প্রজননজ্ঞান অর্জনে এসব কর্মকর্তার চারটি দেশে যাওয়ার কথা ছিল। যেখানে সরকারের প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় হতো। একইভাবে ফল উৎপাদন শিখতে বিদেশ সফরের জন্যও একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। ‘ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পে’ বিদেশ সফর এবং প্রশিক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি ১০ লাখ টাকা।
গত বছর ডিসেম্বরে বোয়িংয়ের একটি বিমান ডেলিভারি আনতে মন্ত্রণালয় ও বিমানের ৪৫ কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে গিয়েছিলেন। এর আগে একটি ক্যামেরা কিনতে তিনজনের বিদেশ যাওয়ার ঘটনায়ও সমালোচনা হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে নতুন সড়ক নির্মাণের প্রশিক্ষণ নিতে, দেশের সব কারাগারে স্বজন লিংক স্থাপনে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা ও আর্জেন্টিনা সফর, আলু চাষ দেখতে ইউরোপ, লিফট দেখতে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আট শিক্ষক ও কর্মকর্তার সুইজারল্যান্ড ও স্পেন এবং ফ্ল্যাট দেখতে থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর যাওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
গ্রহণযোগ্য যে জ্ঞান বাংলাদেশে নেই, সে বিষয়ে জানা বা প্রশিক্ষণের জন্যে অবশ্যই বিদেশে যাওয়া যেতে পারে বা যাওয়া উচিত। কিন্তু, বাংলাদেশের বাস্তবতা দাঁড়িয়ে গেছে এমন, প্রশিক্ষণের নামে বিদেশে যাওয়া হলেও, তা মূলত ভ্রমণ বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে।
এমন ঘটনা যত সংখ্যক ঘটেছে, তার অতি সামান্য কিছু অংশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, জনগণ জানছেন। জানছেন না এমন আরও বহু ভ্রমণ বিলাসিতা ও কেনাকাটা একই সূত্রে গাঁথা। তারা যেমন বিল্ডিং দেখতে বিদেশ যেতে চান, তেমনি দুই শত টাকার একটি বটি ১০ দশ হাজার টাকা দিয়ে, ১৫০ টাকার একটি তালা সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা, ১২০০ টাকার পর্দা ১৮ হাজার টাকায় কেনেন, কেননা প্রস্তাব দিতে পারেন। কেনাকাটার ক্ষেত্রে ও যা ঘটে, প্রকাশ হয় বালিশ - বটি - পর্দা - ড্রামের মতো অতি সামান্য কিছু।
[ লেখকঃ বিশেষ প্রতিবেদক ; শ্যামল বাংলা ডট নেট ও শ্যামল টিভি, সাবেক কাউন্সিলর ; বিএফইউজে-বাংলাদেশ, সদস্য ডিইউজে জাতীয় প্রেস ক্লাব, ও প্রকাশকঃ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা ]
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন