দে লো য়া র জা হি দ ||
‘শান্তির সংস্কৃতি’ ধারণা নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ; দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রেক্ষাপট রচনার পথিকৃৎ বাংলাদেশ; স্বাধীন জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে সার্বভৌম আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয় লাভকরী অনন্য যএক দেশ এ বাংলাদেশ। সে দেশেরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। গত ১০ ডিসেম্বর বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের সাত কর্মকর্তার ওপর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপের্ ঘোষণার প্রদানের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করেছে বাংলাদেশ। এ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন মার্কিন ডেমোক্র্যাট দলের শীর্ষ নেত্রী ন্যান্সি পেলোসিসহ আরো ঊর্ধ্বতন ছয় নেতা। অধিকতর এক শুনানিতে এ ধরনের অভিমত পোষণ করেছেন মার্কিন ডেমোক্র্যাট দলের এ প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ। এ নিষেধাজ্ঞা পুনর্মূল্যায়ন শুনানির ফলাফলের উপর এ সিদ্ধান্তটি আশু পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়া শুরু হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র । বাইডেন প্রশাসনের আরোপিত এ নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করাই আমেরিকান গণতন্ত্রের সৌন্দর্য !
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য মার্কিন অনুদান অব্যাহত রাখতে খুব শিগগির ওয়াশিংটনে সম্মতিপত্র পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ । যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত রূপরেখার ওই সম্মতিপত্রে বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়টি যাতে সুরক্ষিত থাকে, সে বিষয়গুলোও সেখানে উল্লেখ থাকবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ছাড়া এশিয়ায় মার্কিন সহায়তার বৃহত্তম প্রাপক দেশে এ বাংলাদেশ। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ সংকটের সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে এখন পর্যন্ত $৩৬ মিলিয়ন ডলারের ও বেশি সহায়তা প্রদান করেছে। বাংলাদেশ সরকারের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে মার্কিন নানাহ সহায়তা - এর মধ্যে খাদ্য উৎপাদন, আরও রাস্তা নির্মাণ, এবং আরও দক্ষ শিক্ষক, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী এবং সৈন্য প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে সহায়তা করে। একথা অনিস্বীকার্য্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটে বাংলাদেশের পার্শ্বে দাঁড়ানো সবচেয়ে বড় দাতা দেশ, বার্মা থেকে আসা এক মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থীকে গ্রহণ করা স্বাগতিক বাংলাদেশের সাথে মানবিক সহায়তা প্রদান করে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কি বার্তা দিচ্ছে বাংলাদেশকে (প্রথম আলো, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১) একটি নিবন্ধে লিখেছিলাম যে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস এবং আমাদের আবেগের বিষয়ে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৭২ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার ও প্রতিশ্রুতি দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার প্রধান মিত্র দেশ হলো বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক সহযোগিতা রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবেশ সহ ওবামা প্রশাসনের প্রধান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন উদ্যোগে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারী ছিলো । বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ওপর জোর দিয়ে আসছে।
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছেন, বাংলাদেশের সবার সঙ্গে যুক্ততার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। সম্পর্কের পরের ৫০ বছরের অগ্রযাত্রা আরও অনেক বেশি স্থিতিশীল হবে ( ২১ নভেম্বর, প্রথম আলোকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকার). অপর এক প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন "বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে আমরা এর নিজস্ব গুরুত্ব ও কৌশলগত বিবেচনার দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখি। আমাদের এই সম্পর্কের নিজস্ব একটা ভিত্তি রয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিককে আমরা বৃহত্তর প্রেক্ষাপট থেকে দেখি, যেখানে কাউকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গটি নেই। আমরা বারবার এটা বলে আসছি। এই অঞ্চলে বসবাসরত সবার পাশাপাশি এই অঞ্চলের আশপাশে যারা আছে, তাদেরও আমরা এতে রাখছি। আমাদের কাছে এর বিস্তৃতি পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগর, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সব দেশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশসহ আমাদের প্রতিবেশী থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশ।"
চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যখন নতুন একটি শীতল যুদ্ধের ধারণার জন্ম দিয়েছে , যখন ভারত-চীন সম্পর্ক ও অস্থিতিশীল, যখন কানাডার মত দেশ ও চীনের সাথে তাদের বৈদেশিক নীতি অনুশীলনের কৌশলগত প্রয়োজনীয়তাগুলিকে পুনর্নির্মাণ করতে শুরু করছে ঠিক তখন বাংলাদেশ তার উদ্ভাবনী ও সময়োপযোগী বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি অনুসরণ করে ভূ-অর্থনীতিতে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করছে।
আমেরিকান গণতন্ত্রে ভিন্নমত পোষণ এর সংস্কৃতি অতি পুরোনো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, ঢাকায় কনসাল জেনারেল, আর্চার কে ব্লাড এর নেতৃত্বে আমেরিকান নাগরিকরা বাঙালি বেসামরিক, ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার বিবরণ দিয়ে একটি সিরিজ টেলিগ্রাম পাঠায়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সাথে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মৈত্রী তার কারণে তারা নিক্সন প্রশাসন গণহত্যাকে উপেক্ষা করার নীতি এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী পররাষ্ট্র নীতি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নকে একটি উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলো। তিনি ছিলেন স্বাধীনতাত্তোর মার্কিন-বাংলাদেশ সম্পর্ক গড়ে তোলার পথিকৃৎ।
বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতি, নিরাপত্তা, শাসন এবং উন্নয়ন সহ অনেক ক্ষেত্রে তাদের সহায়তার হাতকে প্রশস্ত করেছে। বাংলাদেশের সাথে ২০১৯ সালের জুনে একটি অংশীদারিত্বের সংলাপ অনুষ্টিত হয় দুই দেশের সরকার স্থায়ী অংশীদারিত্বের বিষয়গুলো সেখানে পুনর্নিশ্চিত করেছে, নিরাপত্তা, উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা এবং দুর্যোগে ত্রাণ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার কথা ও সেখানে তুলে ধরা হয়েছে । দুটি সরকারই একটি মুক্ত, উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের এক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। ইউএস-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন সরকার-থেকে-সরকার স্তরের বাইরে গিয়ে : দুই দেশের জনগণ থেকে জনগণ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে ডেমোক্রেট নেতাদের ভিন্নমতের চর্চা থেকে আমাদেরও অনেক কিছু শেখার আছে। বাংলাদেশের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে এ নিষেধাজ্ঞার যথার্থতা যাচাই করার জন্য পুনরায় যে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন একে স্বাগতম । এ সিদ্ধান্ত পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়াকে যেন কোনো হঠকারী রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা না হয়. তা মনে রাখতে হবে. মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের উর্ধ্বে কিছু নয়। কুটনৈতিক পেশাদারিত্ব ও আইনি কৌশল নিয়ে এ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে।
লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কানাডা ইউনিট কমান্ড নির্বাহী, প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা) নিবাসী।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন