দে লো য়া র জা হি দ |||
বাংলাদেশ গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জাতিগত নির্মূল ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও তাদের কাজে উস্কানি দেয়া সহ জনগণকে রক্ষা করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে দৃশ্যমান উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রয়োজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বসভার সদস্যদের ১৯৭১ এ বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়া। ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বিপ্লবী সরকারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ নামের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে বাঙালিরা । ২৫ মার্চ ১৯৭১-যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি বেসামরিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও কর্মীদের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি সামরিক অভিযান শুরু করে এবং পরিকল্পিত ভাবে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিন্ন করে দেয়ার উদ্দেশে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় তখন ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ১৯৭০ সালের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নিয়ে একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় বাঙালিদের উপর। বাংলাদেশে থেকে ১০ মিলিয়ন উদ্বাস্তু দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ৩ মিলিয়ন মানুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের ধূসরদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, ধর্মীয় চরমপন্থী জামাত ও এর সহযোগীদের নিয়ে মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে। যেমন: রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামসকে সাথে নিয়ে বাঙালি বেসামরিক, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী, বুদ্ধিজীবী, যুবক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পরিকল্পিত ভাবে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নীকান্ড, লুটপাট ও নৃশংসতায় লিপ্ত ছিলো । যা সাড়া বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখেছে।
"গণহত্যা যুক্তরাষ্ট্র মনে রাখতে পারে নি, কিন্তু বাংলাদেশ তা ভুলতে পারে নি" তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে লক্ষ লক্ষ লোক নিহত হয়েছিল, কিন্তু শীতল যুদ্ধের ভূ-রাজনীতি অরক্ষিত মুসলমানদের অরক্ষিত করে রেখেছিল ( লরেন বাসোনাল, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬) .
বাংলাদেশ তার ৫০ তম বিজয় দিবস উদযাপন করেছে, ওয়াশিংটন ডিসি মেট্রো অঞ্চলের বাংলাদেশ সম্প্রদায়ের সদস্য ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতির দাবিতে গত ১৮ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসের সামনে একটি বিক্ষোভ করেছে, । তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ইউএস-ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটি (এইচআরসিবিএম)-এর নির্বাহী পরিচালক প্রিয়া
সাহা এবং এইচআরসিবিএম ওয়াশিংটন ডিসি মেট্রো এরিয়া কো-অর্ডিনেটর প্রাণেশ হালদার। বিক্ষোভকারীরা গণহত্যার স্বীকৃতি সংক্রান্ত প্ল্যাকার্ড বহন করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালিরা ও এ ধরণের বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে।
গণহত্যা কনভেনশন (অনুচ্ছেদ ২) গণহত্যাকে এভৱে সংজ্ঞায়িত করে যে "নিম্নলিখিত যে কোনো কাজকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে, একটি জাতীয়, জাতিগত, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সংঘটিত হয়…"
-দলের সদস্যদের হত্যা;
-গ্রুপের সদস্যদের গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা;
-ইচ্ছাকৃতভাবে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে এর শারীরিক ধ্বংস আনতে গণনা করা জীবনের গ্রুপ অবস্থার উপর আঘাত করা;
-গ্রুপের মধ্যে জন্ম রোধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা আরোপ করা;
-গ্রুপের শিশুদের জোর করে অন্য গ্রুপে স্থানান্তর করা।
-কনভেনশন নিশ্চিত করে যে গণহত্যা, শান্তি বা যুদ্ধের সময়ে সংঘটিত হোক না কেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি অপরাধ যা কনভেনশনের পক্ষগুলি "প্রতিরোধ এবং শাস্তি" (অনুচ্ছেদ ১) গ্রহণ করে। গণহত্যা প্রতিরোধ ও বন্ধ করার প্রাথমিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
গণহত্যা দিবসটি জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশনের তাৎপর্য স্মরণ করিয়ে দেয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৮-এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল - ২০১৫ সালে। বিশ্ব গণহত্যা স্মরণ দিবসের ঠিক ৬৭ বছর আগে এ চুক্তি হয়েছিলো। জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন গণহত্যার ঘটনা সংজ্ঞায়িত করে, এর বিচার এবং শাস্তির জন্য একটি আইনি কাঠামো প্রদান করে। রাফেল লেমকিন, পোলিশ-ইহুদি
বংশোদ্ভূত এক আইনজীবীর কঠোর প্রচারণার পরে ১৯৪৮ সালে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। লেমকিন গণহত্যা শব্দটিও তৈরি করেছিলেন, যা গ্রীক শব্দ থেকে মানুষের (জেনোস) এবং হত্যার জন্য ল্যাটিন প্রত্যয় (-cide) থেকে এসেছে।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের রায় মেনে না নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যুগপৎ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দাবি প্রবল হয়ে ওঠে বাঙালির মধ্যে। তবে স্বাধীনতার পর দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও তা হোঁচট খেয়েছে বারবার। বজায় থাকেনি এর ধারাবাহিকতা। ফলে আজও প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি গণতন্ত্র। রাজনীতিতে ঐকমত্যের অভাব ও অসহিষ্ণুতাও এর বড় কারণ। অন্তত জাতীয় ইস্যুগুলোয় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্য থাকা প্রয়োজন হলেও কোনো শাসনামলেই তা দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থই হয়ে উঠেছে মুখ্য।
১৯৭১ সালের ১৩ জুন, যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমস-এর একটি নিবন্ধ বাঙালীদের বিদ্রোহের উপর পাকিস্তানের দমন, নিপীড়ন ও বর্বরতার খবর প্রকাশ করে। এটি প্রতিবেদকের পরিবারকে আত্মগোপনে বাধ্য করে এবং ইতিহাস পরিবর্তন করে।...অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, একজন পাকিস্তানি রিপোর্টার লিখেছেন যা যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমস-এ মুদ্রিত, এটি ১৯৭১ সালে তার বিচ্ছিন্ন পূর্ব প্রদেশকে দমন করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের মাত্রা প্রথমবারের মতো বিশ্ব দরবারে তোলে ধরে।...ঠিক কতজন নিহত হয়েছে তা কেউ জানে না, তবে নিশ্চিতভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। স্বাধীন গবেষকরা মনে করেন যে ৩০০,০০০ থেকে ৫০০,০০০ এর মধ্যে মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে এ সংখ্যা দাঁড়ায় তিন মিলিয়ন।
গৌরবময় বিজয়ের গেলো সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা স্মরণ করেছি চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের উত্থানকে। স্মরণ করেছি অগণিত মানুষের আত্মত্যাগকে, স্মরণ করেছি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে । স্মরণ করেছি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের ও বীরঙ্গনা মা-বোনদের। প্রত্যয়ী হয়েছি বাংলাদেশে গণহত্যা, জাতিগত নির্মূল, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের অপরাধকে তুলে ধরার। স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ দশকে আমরা আমাদের লক্ষ্য ও প্রত্যাশা পূরনের স্বীকৃতিও আদায় করে নিয়েছি। বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি।
লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কানাডা ইউনিট কমান্ড নির্বাহী, প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা) নিবাসী।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন