মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের গণহত্যার ইস্যু ভারত কর্তৃক নিরাপত্তা পরিষদে,  সংযতবাক  দেশের গণমাধ্যম

 

দে লো য়া র  জা হি দ ||

দি ইকোনোমিক টাইমসের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা -বাসস জানায় যে  চলতি বছর ‘প্রটেকশন অব সিভিলিয়ানস ইন আর্মড কনফ্লিক্ট: ওয়ারস ইন সিটিজ - প্রটেকশন অব সিভিলিয়ানস ইন আরবান সেটিংস’ এর ওপর আয়োজিত ইউএনএসসি’র প্রথম উন্মুক্ত বিতর্কের অংশ নিয়ে ২৫ জানুয়ারি জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি টিএস তিরুমূর্তি সন্ত্রাসে মদদ দেয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় শাসকগোষ্ঠীকে দোষারোপ করেছেন। তিরুমূর্তি বলেন, ‘ভারত ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার বিচার চাইছে। ওই ঘটনায় প্রায় ৩০ লাখ লোককে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের কয়েকটি উদ্যোগ সত্ত্বেও, এখনো আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তান সেনা
কর্মকর্তাদের বিচার হয়নি।’ তিনি বলেন, অন্যান্য অনেক দেশও বেসামরিক মানুষের সুরক্ষার কথা বিবেচনা না করেই সামরিক অভিযান চালিয়েছে অথবা ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গনহত্যার  (বর্তমানে বাংলাদেশ) মতো ইচ্ছাকৃতভাবেই বেসামরিক মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে।" ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে (ইউএনএসসি) উত্থাপন করে বিচার চেয়েছে (২৭ জানুয়ারি, ২০২২, বাসস) .:

বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি, দৈনিক যুগান্তর, ০৩ জানুয়ারি ২০২২ এক নিবন্ধে লিখেছিলাম "গণহত্যা  দিবসটি জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশনের তাৎপর্য স্মরণ করিয়ে দেয়।  জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৮-এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল ২০১৫ সালে।  বিশ্ব গণহত্যা স্মরণ দিবসের ঠিক ৬৭ বছর আগে এ চুক্তি হয়েছিল। জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন গণহত্যার ঘটনা সংজ্ঞায়িত করে, এর বিচার এবং শাস্তির জন্য একটি আইনি কাঠামো প্রদান করে। রাফেল লেমকিন, পোলিশ-ইহুদী বংশোদ্ভূত এক আইনজীবীর  কঠোর প্রচারণার পর ১৯৪৮ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। লেমকিন গণহত্যা শব্দটিও তৈরি করেছিলেন, যা গ্রিক শব্দ থেকে মানুষের (জেনোস) এবং হত্যার জন্য ল্যাটিন প্রত্যয় (cide) থেকে এসেছে।"

'৭১ এ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা ছিলো একটি জঘন্যতম অপরাধ যা জোরপূর্বক একটি জনগোষ্ঠীকে তার ভাষা, সংস্কৃতি, স্মৃতিস্তম্ভ এবং স্বতন্ত্র গুণাবলী থেকে বঞ্চিত করে। নিরাপত্তা পরিষদে তিরুমূর্তি দ্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলার কথাটি স্মরণ করিয়ে ওই ভয়াবহ হামলায় ১৫টির বেশি দেশের ১৬৬ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। তিনি আরো বলেন, ‘কয়েক দশক ধরে আন্ত:সীমান্ত সন্ত্রাসবাদে জর্জরিত ভারত সব সময় বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী প্রচেষ্টায় সম্মুখভাগে থেকেছে।’ … সশস্ত্র সংঘাত গুলোকে অবশ্যই জাতিসংঘের শর্ত অনুয়ায়ী আন্তর্জাতিক আইন ও নীতির আলোকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় মীমাংসা করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের গণহত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ এ ইস্যু যখন নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করেছে ভারত তখন সংযতবাক আমাদের দেশের গণমাধ্যম। ভারতীয় উপমহাদেশের. দীর্ঘ-পরিসরের ভারত প্রভাবশালী একটি দেশ হিসেবে নিজেদের ভূমিকাকে জাহির করতে শুরু করেছে এটা প্রত্যাশিত যে ভবিষ্যতে ত্রিভুজাকার প্রতিযোগিতা বন্ধুত্ব ও আনুগত্যের জন্য ভারত, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস হবে এশিয়া, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে চীন ও সোভিয়েত স্বার্থ।

নরম্যান নাইমার্ক নামের একজন আমেরিকান ইতিহাসবিদ, লেখক যিনি আধুনিক পূর্ব ইউরোপীয় ইতিহাস, গণহত্যা এবং জাতিগত নিধনে বিশেষজ্ঞ, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এবং হুভার ইনস্টিটিউশনের একজন সিনিয়র ফেলো যাকে জার্মানি অফিসার্স ক্রস অফ দ্য অর্ডার অফ মেরিটে ভূষিত করেছে তিনি গণহত্যাকে "সঠিক" সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্বতার কথা বলেন । একই সময়ে, এটি সম্পর্কে চিন্তা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় ও বাতলে দেন গণহত্যার অপরাধের প্রতিরোধ এবং শাস্তি সংক্রান্ত ডিসেম্বর ১৯৪৮  সালের জাতিসংঘ কনভেনশন দিয়ে শুরু করা- অনুচ্ছেদ দুই-এ, গণহত্যাকে "একটি জাতীয়, জাতিগত, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে করার কাজ" হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। গত দেড় দশকে আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেই সংজ্ঞা আরও প্রসারিত হয়েছে। ইতিহাসবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরাও এর কিছু পরিমার্জন করেছেন।

পাক সেনাবাহিনীর মতাদর্শ নৈতিকভাবে ছিল নিন্দনীয় তারা বাঙালি জনগণকে ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানের সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগ ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করে ছিল - যা ছিল অভূতপূর্ব অনুপাতের একটি অপরাধমূলক কাজ এবং যার জন্য তারা অবশ্যই দায়ী ছিল। পাকিস্তানি ধরনের গণহত্যা, সবচেয়ে জঘন্যতম - আন্তর্জাতিক আইনে একে বলা যেতে পারে "অপরাধের অপরাধ"।

যুদ্ধাপরাধের যে কোনও উদাহরণকে অবশ্যই আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) নিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আন্তর্জাতিক আইনে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ বলে চিহ্নিত । তাদের এত গুরুতর বলে মনে করা হয় যে এ ধরনের অপরাধের জন্য কোন সীমাবদ্ধতার সময়কাল নেই - যার অর্থ হলো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর যতই সময় অতিবাহিত হোক না কেন তার বিচার করা যেতে পারে এবং শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। অক্ষ শক্তি (নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিস্ট ইতালি এবং ইম্পেরিয়াল জাপান) ছিল আধুনিক ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধের সবচেয়ে পদ্ধতিগত অপরাধী এর সাথে যুক্ত হতে পারে  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের গণহত্যা।


লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কানাডা ইউনিট কমান্ড নির্বাহী, প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা) নিবাসী।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন