মোঃ আবু হোসেন
ব্রিটেনে বাংলাদেশী কমিউনিটির অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব , বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা 'প্রবাসির কথা'র লেখক, সাংবাদিক, সামাজিক গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত নুরুল ইসলামের স্মরণে গত ২৮ শে জানুয়ারি বাংলাদেশী টিচার্স এসোসিয়েশন ইউকে এর উদোগে ভার্চুয়ালি এক শোক সভা ও দোয়া মাহফিলের অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় বক্তাগণ মরহুম নুরুল ইসলামের দেশে এবং প্রবাসে তার অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
মরহুম নুরুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত মেধাসম্পন্ন, সমাজের উন্নয়নের এক প্রতিকৃতি, অত্যন্ত জ্ঞানী, লোভ-লালসা বিহীন অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের অধিকারী।
মরহুম নুরুল ইসলাম তার শেষ জীবনে তার নিজস্ব গ্রামে দক্ষিণ সুরমার সদরখলা গ্রামে একটি বিরাট লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা তার কর্মময় জীবনের অন্যতম নিদর্শন। এজন্য জীবিত অবস্থায় তাঁর ই বন্ধু সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিতকে লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করার জন্য কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করতেন। উপস্থিত বক্তাগণ নুরুল ইসলামের কর্মজীবন এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনা সকলের সঙ্গে শেয়ার করেন।
১৯৫২ সালে ছাত্র জীবনে এমসি কলেজের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন । এবং দেশের চলমান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই পর্যায়ে তিনি ইস্ট পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করার পর এক ই সালে লিঙ্কনে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেতে গমন করেন।
তিনি বেশ কিছু কাল পর্যন্ত ব্রিটিশ রেলওয়ে অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এসময় তিনি বিলাতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের বিভিন্ন পদে নিযুক্ত ছিলেন। বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত ভাউচার সিস্টেম চালু এবং সমস্যা দূরীকরণে তারই প্রচেষ্টায় পাসপোর্ট চেকিং করাচির বদলে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।
একজন ফাউন্ডার মেম্বার হিসেবে পাকিস্তান হাউস প্রতিষ্ঠা তার অনেক পরিশ্রমের অবদান। যে কারণে তিনি ১৯৬৬ সালে আইয়ুব সরকারের আমলে দেশে গেলে পাকিস্তান বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হিসাবে তাকে জেলে অন্তরীণ করা হয় প্রায় দুই বছরের অধিক সময় এবং তার পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিয়ে নেওয়া হয়।
১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের সময় তাঁকে আওয়ামী লীগের ইলেকশন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টর যোগ দেন এবং পরবর্তী সময়ে যুগোস্লাভিয়া, ব্রিটেন ও ফ্রান্সে ভ্রমণ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্টিত 'প্রবাসী বাঙালি কল্যাণ বোর্ড' (১৯৭২- ১৯৭৪) এর সাধারন সম্পাদক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি বহুল প্রচারিত 'Daily Bangladesh Times' এর নিয়মিত কলামিস্ট ও সাংবাদিক ছিলেন ।
প্রবাসী বাঙ্গালীদের সুবিধার জন্য তিনি সিলেটে 'বাংলাদেশ ওভারসিস সেন্টারের' অন্যতম কারিগর ও ফাউন্ডার মেম্বার ছিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত এর সঙ্গে ওয়েজ আর্নার্স স্কিম সমস্যা সমাধানে কমিটির একজন সদস্য ও কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন ।
তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান লন্ডনে এলে জনাব নুরুল ইসলাম প্রবাসে বাঙ্গালীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাত করেন।
নুরুল ইসলাম সাহেব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত কাছের লোক ছিলেন । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুরোধে তিনি প্রবাসে চাঁদা তুলে আওয়ামী লীগের ইলেকশনের সুবিধার জন্য একটি গাড়ি উপহার দেন।
মরহুম নুরুল ইসলাম অত্যন্ত শিক্ষা দরদি ছিলেন। শিক্ষার উন্নয়নের জন্যই তিনি সিলেটে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং ব্লু বার্ড স্কুল প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য যে কোন সভায় তিনিই থাকতেন মধ্যমণি।
মরহুম নুরুল ইসলামের অনেকগুলো কাজের মধ্যে "প্রবাসীর কথা" অন্যতম। বাংলাদেশে ঢাকা ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি ছাড়া ও কলকাতা ইউনিভার্সিটি, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি, ও গৌহাটি ইউনিভার্সিটি সহ অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে "প্রবাসীর কথা" রেফারেন্স বই হিসেবে পড়ার লিস্টে রয়েছে। এই বইটি একটি ভিন্নধর্মী গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স বুক কিংবা ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০১২ সালে মাইগ্রেশন এর উপর "প্রবাসীর কথা" লেখা বইটি একটি যুগান্তকারী গ্রন্থ হিসাবে বাংলা অ্যাক্যাডেমি তাকে ফেলোশিপ প্রদান করে । নুরুল ইসলামের গবেষণামূলক ২য় বইটি " From Sojourner to Settler" ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে।
বাংলাদেশ টিচার্স এসোসিয়েশন ইউকে কর্তৃক আয়োজিত উক্ত শোকসভায় এসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আবু হোসেনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল বাসিত চৌধুরীর সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই সভাপতি দেওয়ান গৌস সুলতান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুর রকিব, বিটিএর কোষাধক্ষ্য মিসবাহ উদ্দিন আহমেদ, বিটিএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন আহমেদ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন, সাবেক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক চৌধুরী, বিশিষ্ট শিক্ষকবৃন্দ যথাক্রমে সৈয়দ রকিব আহমেদ, মঞ্জুর রাজা চৌধুরী, এ কে এম ইয়াহিয়া, সউদা মোমিন, আনহারুজ্জামান চৌধুরী, হোসনে আরা রহমান, রেহানা রহমান , আফিফা রহমান, রোকসানা গনি, শওকত মাহমুদ টিপু, মইন উদ্দিন আহমেদ , মুমিতুর রাজা চৌধুরী, এডভোকেট শাহ ফারুক আহমেদ, হাবিবুর রহমান মিল্লিক, সাবিতা সামসেদ , অধ্যাপক শাহজাহান, মনসুর রশিদ, সেলিনা রহমান, জেসমিন আরা, মিসবাহ আহমেদ এবং মরহুম নুরুল ইসলাম সাহেবের মেয়ে বিশিষ্ট শিক্ষক মুনজেরিন রশিদ, এবং তার ছেলে মুরসেলিন ইসলাম।
সভাপতি তার বক্তব্যে বলেন, উপস্থিত সকলকে মরহুম নুরুল ইসলামের অনেক ঘটনাবলী সকলের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। মরহুম নুরুল ইসলাম একজন কিংবদন্তি, অত্যন্ত মেধাসম্পন্ন, বাঙালি সমাজের উন্নয়নের কাজে তার জীবনের শেষ অংশটুকু ব্যয় করে যান। আমরা আমাদের কমিউনিটির অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন নুরুল ইসলাম কে হারিয়ে বাঙালি কমিউনিটি এক বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হলো। আলোচনা পর্ব শেষে বিশিষ্ট শিক্ষক মোঃ ফারুক হোসেন মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া পরিচালনা করেন।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন