রাশিয়া-ইউক্রেনের শান্তিপ্রিয় অবস্থানের সমঝোতা হতে হবে আলোচনার টেবিলে

দে লো য়া র  জা হি দ

বিশ্ব মিডিয়ায় খবরের শীর্ষে রয়েছে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা। ইউক্রেনের মানবিক সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ববাসী। মেক্সিকো ও ফ্রান্সের প্রস্তাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ মানবিক সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য এক জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। কূটনীতিক একটি সূত্র জানায় , জরুরি এ বৈঠক শেষে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য সম্ভাব্য একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসবে। প্রস্তাবে ইউক্রেনে রুশ শত্রুতার অবসান, মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবাহ এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়টি রয়েছে যদিও এ প্রস্তাব পাশে যুক্তরাষ্ট্র বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা চায় ইউক্রেনে মানবিক সংকটের জন্য রাশিয়া দায়ী স্পষ্টত  তা উল্লেখ থাকতে হবে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁর সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে একটি টেলিফোন আলাপে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, আলোচনা অথবা যুদ্ধ, যেভাবেই হোক রাশিয়া লক্ষ্য অর্জন করবে।---ফরাসি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে ইউক্রেনের পারমাণবিক কেন্দ্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাগিদ দেন। ইউক্রেনের দাবি, রুশ গোলাবর্ষণে জেপোরোজিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আগুন ধরে গিয়েছিল।---তবে আগুনের ওই ঘটনার জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করেছে ক্রেমলিন।
পুতিন আরও বলেছেন, রবিবার মারিউপোল এবং ভলনোভাখা শহরে 'যুদ্ধবিরতি' ভেস্তে যাওয়ার কারণ হলো, ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদীরা বেসামরিক মানুষজনকে যেতে বাধা দিয়েছে, বরং এই সুযোগে তারা শক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালিয়েছে।---এর আগে রেডক্রস জানিয়েছিল, কীভাবে বেসামরিক মানুষজনকে সরিয়ে নেয়া হবে, তা নিয়ে দুই পক্ষ একমত হতে না পারায় তারা কাজ শুরু করতে পারেনি সূত্র বিবিসি


ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে সবচেয়ে বড় একটি প্রচলিত সামরিক আক্রমণ। ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় মর্যাদার বিপ্লবের পর, রাশিয়া ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করে এবং রাশিয়ান-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী ডনবাসের দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনীয় অঞ্চলের অংশ দখল করে, এ অঞ্চলে একটি চলমান যুদ্ধ শুরু করে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যেকার উত্তেজনা একটি  নাটকীয় মোড় নিয়েছিলো যখন  ভ্লাদিমির পুতিন  প্রথমত পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং তারপর সেখানে "শান্তি রক্ষার জন্য" রাশিয়ার সৈন্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় রাশিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২ তারিখে ইউক্রেনে একটি পূর্ণ-স্কেল হামলা শুরু করে.  দেশটির গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর ইতিমধ্যে রুশ বাহিনী দখল নিয়েছে, রুশ অভিযানের তীব্রতা যেমন প্রতিদিন বেড়ে চলেছে, তেমনি ইউক্রেনের বাহিনীও বলছে যে তার রুশ হামলাকে ঠেকাতে সমর্থ এবং তাদের প্রতিরোধ আরো জোরদার হচ্ছে ।

ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক ভাষণটি তুমুল আলোচনা-বিতর্ক-ও বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে উঠেছিলো  তিনি ভাষণে তার "বহুদিনের চেপে রাখা ক্ষোভ, ক্রোধ, ধৈর্যচ্যুতি এবং হুমকির সুর" প্রকাশ করেছেন বলে  - মন্তব্য করেছেন বিবিসির সারাহ রেইন্সফোর্ড। পুতিন দ্যর্থ ভাষায় বলেছেন
"ইউক্রেন প্রকৃতপক্ষে কোন রাষ্ট্র নয়" এখন যা ইউক্রেন তা আসলে 'প্রাচীন রুশ ভূখণ্ড সম্পূর্ণতই বলশেভিক কমিউনিস্ট রাশিয়ার সৃষ্টি। এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর  এবং লেনিন ও তার সহযোগীরা রাশিয়ার ঐতিহাসিক ভূখণ্ডকে ভাগ করে ছিঁড়েখুঁড়ে নিয়ে সবচেয়ে খারাপভাবে এ কাজটা করেছিলেন।

রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল করতে পশ্চিমা দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলেছে। সামরিক শক্তি দিয়ে ইউক্রেনকে সহযোগিতা করার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই দ্বিধান্বিত। " রাশিয়ার বাহিনী ইউক্রেনের অধিকাংশ এলাকা দখলে নিলেও লড়াই চালিয়ে যেতে পশ্চিমারা প্রবাসে ইউক্রেন সরকার গঠনের চিন্তাভাবনা করছে। পশ্চিমা দেশগুলোর কর্মকর্তাদের সূত্রের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রসদ ও মনোবল ঘাটতিতে থাকা রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। কিন্তু যুদ্ধ মাত্র দুই সপ্তাহে গড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কর্মকর্তারা মনে করছেন, রুশ বাহিনী প্রাথমিক দিককার ক্ষতি শিগগিরই সামলে নেবে এবং এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি রক্তাক্ত লড়াই শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে গড়ে ওঠা ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখার জন্য পরিকল্পনা করছে পশ্চিমারা। কর্মকর্তারা সেই পরিকল্পনার বিস্তারিত না জানালেও কিয়েভের সম্ভাব্য পতন বিবেচনায় নিয়েই তাঁরা ইউক্রেনের প্রবাসী সরকার গঠনের পরিকল্পনা নিতে শুরু করেছেন। রুশ বাহিনীর
বিরুদ্ধে এই লড়াই হতে পারে গেরিলা যুদ্ধ" (প্রথমআলো, মার্চ ৭)

ইরাকে ধ্বংসযজ্ঞের চেয়ে ইউক্রেনে ক্ষয়ক্ষতি কম: সাবেক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা
যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা ১৯৯১ ও ২০০৩ সালে ইরাকে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল সে তুলনায় ইউক্রেনে কম ক্ষয়ক্ষতি করেছে রুশ বাহিনী। এমন বক্তব্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) ডগলাস ম্যাকগ্রেগর। তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন।---ম্যাকগ্রেগর গত শুক্রবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স বিজনেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই কথা বলেন। এ বিষয়ে রোববার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রাশিয়ার স্পুতনিক নিউজ।---ম্যাকগ্রেগর বলেন, ইউক্রেনের সেনারা সে দেশের বেসামরিক নাগরিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। যেমনটি মধ্যপ্রাচ্যে করেছিল জঙ্গিরা।( মার্চ ৬, প্রথম আলো)

জেনেভায় আলোচনার মাধ্যমে এ সংকট নিরসনে ব্যর্থতার মূল কারণ ছিলো যুদ্ধ পূর্ব রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অনড় এক অবস্থান। ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রনের স্থান ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রভাববলয়ের বাইরে যেতে দিতে নারাজ। রাশিয়া থেকে মোট তেল-গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশই   ইউরোপে যায় ইউক্রেনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত গ্যাস পাইপলাইনগুলো ব্যবহার করে। মূলত ইউক্রেনে শুরু হওয়া যুদ্ধ, ন্যাটো জোটের সামরিক প্রভাব বৃদ্ধির ছক ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে কোনো ভাবে এ যুদ্ধকে প্রলম্বিত করা হবে. শান্তি ও সংঘর্ষের বিষয়ে আমাদের গবেষণায় তা'ই  প্রতিভাত হচ্ছে।

জাতিসংঘ বলছে, যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের ১৫ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের চার্টার উল্লেখ করেছে যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল "পরবর্তী প্রজন্মকে যুদ্ধের কবল থেকে বাঁচানোর জন্য।" দুঃখজনকভাবে, ১৯৪৬ সালের সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে ২৫০ টির বেশি সশস্ত্র সংঘাত হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য আর্টিকেল ১৬ ন্যায়পরায়ণ, শান্তিপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের প্রচার, সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রকে জনগণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রচার করার আহ্বান জানায়। এর কিছু প্রাথমিক লক্ষ্যগুলির মধ্যে রয়েছে অস্ত্র প্রবাহ হ্রাস করা এবং সংগঠিত অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করা, সেইসাথে বিশ্বব্যাপী সকল প্রকার সহিংসতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা। বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের  শান্তিপ্রিয় অবস্থানের সমঝোতা শেষ পর্যন্ত হতে হবে আলোচনার টেবিলেই সুতরাং বিশ্ব নেতৃত্বের উচিত এ হত্যা ও ধ্বংস যজ্ঞ  থামাতে এখনই এগিয়ে আসা।


লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, জন হাওয়ার্ড সোসাইটি অফ ম্যানিটোবা, সাবেক বোর্ড অব ডিরেক্টরস মেম্বার প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা) নিবাসী।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন