রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে মেরুকরণ, শান্তি বিনির্মাণ ও নতুন বিশ্বব্যবস্থার পদধ্বনি  

দে লো য়া র  জা হি দ
রাশিয়ার সাথে শান্তি আলোচনার পাশাপাশি ইউক্রেন তার অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইউক্রেন বলছে, তারা পুনরায় পুরো কিয়েভ অঞ্চলের  নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনী ইউক্রেনের ডনবাস এবং দক্ষিণ অঞ্চল দখল করতে সংশোধিত কৌশল গ্রহণ করেছে। এর
সমর্থন মিলে  গোয়েন্দা মূল্যায়নের বরাতে যেখানে কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছে, যে মে মাসের শুরুর দিকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস ও অন্যান্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দিকে মনোযোগ রাশিয়ার । রাশিয়া মৌখিকভাবে কিয়েভের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে যে ইউক্রেনে
র প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভলোদমির পুতিনের মধ্যে খুব সম্ভব তুরস্কে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে করে যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় অগ্রগতি তথা বিরোধ নিষ্পত্তিতে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা অপসারণ বা তাদের লক্ষ্য (ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত) রাষ্ট্র দ্বারা অব্যাহত
শান্তিপূর্ণ সাধনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্তরে বজায় রাখার প্রক্রিয়াগুলির শুরু হবে বলে আশা করছেন বিশ্লেষকরা।

গবেষকরা সতর্ক যে এখানে দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা একটি বিপজ্জনকভাবে সরল অনুশীলন হতে পারে। পশ্চিমা, উন্নত আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তথাকথিত 'তৃতীয় বিশ্ব'-এ দ্বন্দ্বকে সহজ করতে পারে এমন লোকেদের অনিবার্য সংগ্রাম হিসাবে যারা এতদিন জাতিগত, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পার্থক্যের
কারণে সহাবস্থান করতে পারে না বলে মনে করতেন তাদের পর্যবেক্ষণ হোঁচট খেয়েছে।  দ্বন্দ্ব প্রতিরোধ এবং সমাধানের  পদ্ধতিতে অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণগুলির  চেয়েও এখন ইউক্রেন কে ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যেমন
সুদানের সংঘাত, যেখানে মুসলিম উত্তর এবং খ্রিস্টান দক্ষিণের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে একটি ব্যাখ্যা থেকে আখ্যান উদ্ভূত হয়েছে। সেখানে গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্তর্নিহিত আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং প্রান্তিকতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার পরিবর্তে জটিল শান্তি প্রক্রিয়ার গতিশীলতা বিশ্লেষণ
 এবং কীভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলি কার্যকরভাবে শান্তি চুক্তির অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত এবং প্রয়োগ করা হয়েছিল তা দেখা যায় দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার পরেও। .

যারা আন্তর্জাতিক সংঘাত সমাধান এবং শান্তি বিনির্মাণের বিষয়ে গবেষণা ও কাজ করেন তারা একটি কার্যকর সমস্যা-সমাধান প্রক্রিয়ার জন্য সাতটি ধাপকে অবশ্যি বিবেচনায় নিবেন, তন্মধ্যে :
➧সমস্যাগুলিকে  চিহ্নিত করা ও সমস্যা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেয়া ।
➧সবার স্বার্থ বুঝা  …
➧সম্ভাব্য সমাধান (বিকল্প) তালিকাভুক্ত করা …
➧বিকল্পগুলিকে মূল্যায়ন করা  …
➧একটি বিকল্প বা বিকল্প নির্বাচন করা . …
➧চুক্তি(গুলি) নথিভুক্ত করা । …
এছাড়াও আকস্মিক পরিস্থিতি, পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়নে বিষয়ে সম্মতি নেয়া।

ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে রাশিয়ার বিরুধ্যে গোটা বিশ্বকে এক কাতারে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা এবং তাদের সর্বক্ষেত্রে প্রতিরোধের মার্কিন পরিকল্পনা অব্যাহত রয়েছে। ইউক্রেনকে আরও ৩০০ মিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দিচ্ছে পেন্টাগন জানিয়েছে বিবিসি অর্থের সহায়তা প্যাকেজে থাকছে- লেজার ও নির্দেশিত রকেট সিস্টেম, অত্যাধুনিক ড্রোন, হামভি গাড়ি, রাতে দেখার চশমা, মেশিন গান এবং চিকিৎসা সামগ্রী। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঁচ সপ্তাহেরও বেশি আগে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর এখন পর্যন্ত কিয়েভকে ১.৬ বিলিয়ন ডলার দিচ্ছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীকে আরও সুসংহত করার জন্য একটি চুক্তি প্রক্রিয়ার শুরুর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ওয়াশিংটন এই সামরিক সহায়তা প্যাকেজ দিচ্ছে। রুশ এবং বেলারুশিয়ান প্রতিরক্ষা, মহাকাশ এবং সামুদ্রিক খাতে ১২০টি সংস্থার ওপর শুক্রবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ। বাণিজ্য সচিব জিনা রাইমন্দো বলেছেন, ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত তার দেশ এবং অর্থনীতিকে বৈশ্বিক বাণিজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। শুক্রবারের পদক্ষেপ সেই বিচ্ছিন্ন তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে।.


ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে রাশিয়ার বিরোধিতা না করে ভুল করছে ভারত জানিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপনিরাপত্তা-বিষয়ক উপদেষ্টা দিলীপ সিং দুই দিনের সফরে ভারত এসে বলেছেন, ‘চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন করলে রাশিয়া বাঁচাবে না।’--- মার্কিন উপদেষ্টা সতর্কবার্তা দেন, কোনও দেশ যদি রাশিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংকের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বজায় রাখে, সেটাও ভাল চোখে দেখবে না আমেরিকা। সূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস ও দ্য হিন্দু।

অন্যদিকে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। এবার সংস্থাটি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৪ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। বিবিসিকে এই কথা জানিয়েছেন ডব্লিউটিওর মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো ইওয়েলা। মধ্যম মেয়াদে বিশ্বে মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন তিনি।


ডব্লিউটিওর মহাপরিচালক বলেন, ‘করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থায় যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তা চলমান থাকবে। খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে। আমাদের খাদ্যপণ্যসংকটের সময় ঘনিয়ে এসেছে, যদিও রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্ববাজারের ২ দশমিক ৫ শতাংশ
খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে থাকে।’

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিনিদের একক আধিপত্য এখন চ্যালেঞ্জ এর মুখে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যবস্থায় নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের পুনঃজাগরণ ও পরাশক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় রাশিয়া মরিয়া হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়াজুড়ে তাদের একক আধিপত্য তৈরি, ন্যাটো সামরিক জোটের সম্প্রসারণ, ইউরোপের রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কার এবং এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অংশীদারিত্ব  এর নতুন সমীকরণ-মেরূকরণ শুরু হয়েছে। আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, সাবেক যুগোস্লাভিয়া, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সেটা এখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। বিপুল সম্পদ নষ্ট ও  লাখ লাখ মানুষ এর মৃত্যু লুটপাট ও জনপদ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। কোটি মানুষ দেশান্তর ও গৃহহীন হয়েছে। বিশ্বশান্তি ও সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নেওয়ার পথে এখন ভারত, চীন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি সৌদি আরব, মেক্সিকো, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম রাশিয়ার বিরুদ্ধে একতরফা নিষেধাজ্ঞাকে মানছে না. বিশ্বরাজনীতির গতি প্রকৃতিতে ও নতুন মেরূকরণ স্পষ্ট হচ্ছে বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনেজুয়েলা, সিরিয়া ও কিউবা মার্কিন এবং পশ্চিমা শক্তির তথা ন্যাটো জোটের বিপরীতে। দুই পরাশক্তির ভারসাম্য ও প্রতিযোগিতার মাঝে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের  শান্তি বিনির্মাণ প্রক্রিয়া ঝুলে রয়েছে। একটি পরিপূরক পন্থা সহ সম্প্রসারিত ক্ষেত্র তৈরিতে মার্কিন সরকারের সদ্বিচ্ছা ছাড়া রাশিয়া–ইউক্রেন শান্তি আলোচনা সফল হবেনা।

লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, জন হাওয়ার্ড সোসাইটি অফ ম্যানিটোবা, সাবেক বোর্ড অব ডিরেক্টরস মেম্বার প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা) নিবাসী।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন