প্রয়াত: আব্দুন নূর মাষ্টার, যার জ্ঞানের পরিধি ছিল বিশাল

জিবি নিউজ ডেস্ক ।।

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পতন উষার ইউনিয়নের গোপীনগর গ্রাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এক প্রাচীন জনপদ। ছোটবেলা থেকেই এই গ্রামের লোকজনের সাথে আমার পরিচিতি রয়েছে। গ্রামের আদি বাসিন্দা হাজী সিকান্দার তালুকদারের উত্তরসূরী মরহুম মোহাম্মদ আমিল মাষ্টার সাহেবের কনিষ্ট ছেলে আব্দুন নূর মাষ্টার সাহেবের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় হাওর করাইয়ার ভূমি আন্দোলনের সূত্র ধরে। হাওর করাইয়ার ভূমি আন্দোলনের সময় আমি ও আব্দুন নূর মাষ্টার ছিলাম টগবগে তরুণ। কাজী জাফর (সাবেক মন্ত্রী) হায়দার আকবর খান রনো, তাঁর ভাই জনো, কুলাউড়ার রাজা সাহেব, কৃষক নেতা মফিজ আলী, প্রয়াত সৈয়দ মতিউর রহমান, এ্যাডভোকেট আব্দুস ছোবহান, নলিনী দে, আব্দুর রশিদ, ললিত মোহন দাস, আবু কায়সার খান, তারা মিয়া, বীর কটুসহ আরো অনেকের নেতৃত্ব ছিলো এই আন্দোলনে। জমিদারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিলো বলে স্থানীয়ভাবে অনেক লোকই কৃষকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। আমাদের স্লোগান ছিলো-
লাঙল যার জমি তার
দা যার ছন তার
হাওর করাইয়ার পথ ধরো, জমিদার খতম করো।
হাওর করাইয়ার বীর কটু লাল সালাম।

এভাবেই আমরা হাওর করাইয়ার কৃষক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলাম। পাকিস্তানের এই উত্তাল সময়েই আব্দুর নূর সাহেব শিক্ষকতায় যোগ দেন। পেশা হিশেবে শিক্ষকতা ছিলো তার উত্তরাধিকার। ছাত্র অবস্থায় নূর ভাই’র সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিলো ভাইভাই। পরবর্তীতে আত্মীয়তার সূত্রে আমাদের সে সম্পর্ক বদলাতে হয়। আব্দুন নূর মাষ্টার সাহেব স্বাধীনতার স্বপক্ষের একজন মানুষ হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় অনন্য একজন সংগঠক ছিলেন। যুদ্ধের সময় গোপীনগর গ্রাম ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট একটি নিরাপদ স্থান। সেখান থেকে তারা জেলার রাজনগর, কুলাউড়া ও কমলগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অপরেশন চালাতেন। যোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজটি নূর মাষ্টার সাহেব রাতের আঁধারে করতেন। এ খবর পেলো পাক বাহিনী। রাজাকারদের সাথে নিয়ে তাই তারা নূর মাষ্টারকে খোঁজাখুঁজি করতো। তিনি এসব প্রতিকূলতা কাটিয়ে চলতেন খুব বিচক্ষণতার মাধ্যমে। 

আব্দুন নূর মাষ্টার একজন চতুরমুখি মানুষ। তাঁর মেধার পরিধি অনেক বেশি। ব্যক্তি জীবনের সবক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ রয়েছে। জেলার চার থানায় ছিল  তাঁর সু-খ্যাতি। আব্দুন নূর মাষ্টার একজন শিক্ষক, শিক্ষানূরাগী, সমাজ সেবক, গ্রাম্য সালিশ বোর্ডের প্রথম সারির একজন বিচারক ,এমনকি একজন কৌসুলী দলিল লেখকও। তাঁর চতুর্মুখি যোগ্যতার কারণে ব্যক্তি জীবনে সকলের কাছে তিনি ছিলেন সমাদৃত। নূর মাষ্টার অতি অল্প বয়সেই সালিশ বিচারে প্রবেশ করেছিলেন। আমি নিজে দেখেছি জেলায় যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সালিশ বিচারে তিনির  প্রয়োজনীয় একান্ত,  বিষয় নিষ্পত্তিতে তাঁর বিচক্ষণতা, যুক্তি ও কৌশল সালিশ বৈঠকের উপস্থিতিকে চমক লাগাত। প্রায়ই দেখেছি অনেক সালিশ বৈঠকে তিনিই সিদ্ধান্ত দিতে হয়। এমনকি সালিশের উপস্থিতিও তাঁর দিকেই তাকিয়ে থাকেন। আজকের এই সমাজ ব্যবস্থায় আব্দুন নূর মাস্টারের বড়ই প্রয়োজন ছিল। তিনি ছিলেন একজন দানশীল ব্যক্তিত্ব। স্থানীয় পতনউষার উচ্চবিদ্যালয় ও অনেক মসজিদ মাদ্রাসায় তাঁর দান বিদ্যমান ছিল। শিক্ষার প্রচার প্রসারে কাজ করেছেন আমৃত্য। নিজ এলাকায় প্রতিস্টিত হয়েছে তার নামে আব্দুন নুর নুরজাহান চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়। 

 আব্দুন নূর মাষ্টার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন পরপারে, রেখে গেছেন তিনির নীতি ও আদর্শ। তার মৃত্যুতে আমি ব্যাথিত ও মর্মাহত। আজ সামাজিক ও সালিশ বিচার অঙ্গনে নূর মাষ্টারের বড়ই প্রয়োজন। উনার মৃত্যুতে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার ও সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের যে ক্ষতি হয়ে গেল তা কোন দিন পূরণ হবার নয়।

পরিশেষে মহান আল্লাহ কাছে উনার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

মোঃ মোসাহিদ উদ্দিন 
প্রবীণ রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও গ্রাম সালিশের বিচারক, কামারচাক, রাজনগর।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন