সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষায় কৃষকের হাহাকার

জিবিনিউজ 24 ডেস্ক//

সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার হাওরপাড়ের মানুষ আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় দিন পার করছে। পাহাড়ি ঢলের পানি থেকে ফসল বাঁচাতে হাওর এলাকার কৃষক প্রাণপণ চেষ্টা করছে। জেলাটি হাওর অধ্যুষিত হওয়ায় এখানে বছরে একটি মাত্র ফসল ফলে। আর এই ফসল ফলাতে হাওরপাড়ের মানুষকে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়।

দিরাই উপজেলার টাংনির হাওরের ভেঙে যাওয়া ফসল রক্ষা বাঁধ গত তিন দিনের টানা স্বেচ্ছাশ্রমে অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত অবস্থায় এসেছে। তপ্ত রোদে ঘাম ঝরানো এই কাজে ছিলেন কয়েক শ লোক। ছিলেন অনেক কৃষক। শুক্রবারও দিনভর কাজ করেছেন তাঁরা। তাঁদের প্রাণপণ চেষ্টায় রক্ষা পেয়েছে হাওরের প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির ধান।

 

শুধু টাংনির হাওর নয়, গত এক সপ্তাহে পাহাড়ি ঢলের ঝুঁকিতে পড়া কৃষকের কষ্টের ফসল রক্ষায় জেলার ৩৯টি হাওরের বিভিন্ন বাঁধের শতাধিক স্থানে সংস্কারকাজ করতে হয়েছে; যা চলছে এখনো। এ কাজে পাউবো, স্থানীয় প্রশাসন প্রয়োজনীয় কিছু সরঞ্জাম দিলেও বেশির ভাগ স্থানেই স্থানীয় লোকজন, বিশেষ করে কৃষকেরা স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন।

দিরাইয়ের মতো শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরের মোহনখল্লী এলাকায় ধসের ঝুঁকিতে থাকা বাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে রক্ষা করেছেন স্থানীয় কৃষকেরা। বাঁধের নিচ দিয়ে ছিদ্র হয়ে পানি ঢুকতে শুরু করেছিল। এই হাওরে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল রয়েছে। হাওরটিতে পানি ঢুকতে শুরু করলে আতঙ্কে অনেক নারী-শিশু কাঁদতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত বাঁধটি রক্ষা পাওয়ায় আপাতত স্বস্তি ফিরেছে তাঁদের মধ্যে।

শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যেমন হাওরের বাঁধে বাঁধে দৌড়াচ্ছি, তেমন কৃষকেরাও আছেন। ঢল আসার পর অন্তত ১০টি স্থানে কাজ করতে হয়েছে। কৃষকেরা না থাকলে প্রশাসন বা পাউবোর পক্ষ থেকে এভাবে তাৎক্ষণিক কাজ করা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।’

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পাহাড়ি ঢলে এ পর্যন্ত জেলার ৬টি হাওরে ৪ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এবার জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। কোনো কোনো হাওরে আতঙ্কে কাঁচা, আধা পাকা ধানই কাটছেন কৃষকেরা। এ পর্যন্ত জেলার ৩৮৫ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম।

দিরাইয়ের কুলঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান একরার হোসেন জানান, ‘টাংনির হাওরের জারলিয়া এলাকার বাঁধটি ভাঙে গত বুধবার বিকেলে। আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের পাঁচ থেকে ছয় শ মানুষ জড়ো হয়ে বাঁধ রক্ষার লড়াইয়ে নামেন। টানা তিন দিনের চেষ্টায় এখন এটি ঝুঁকিমুক্ত।’

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক গোলাম রব্বানী জানান, খরচার হাওরের একটি বাঁধ স্থানীয় ১০টি গ্রামের মানুষ কাজ করে রক্ষা করেছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তাও ছিলেন। কিন্তু যাঁরা লাখ লাখ টাকার ওই বাঁধ দায়সারাভাবে নির্মাণ করেছেন, বিপদের সময় তাঁদের পাওয়া যায়নি।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাবমতে, এবার জেলায় বাঁধ নির্মাণে ১২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২৭টি প্রকল্পের কাজ গত ১৫ মার্চের মধ্যে শেষ হয়েছে। যদিও এই কাজের শেষ সময় ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। এপ্রিলের শুরুতেই পাহাড়ি ঢল নামায় এসব বাঁধ ঝুঁকিতে পড়ে। শনিবার প্রথম বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যায় টাঙ্গুয়ার হাওরে। এরপর আরও পাঁচটি হাওরে ফসলহানি ঘটেছে।

সুনামগঞ্জে হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, ‘মানুষ চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। প্রশাসন, পাউবো বিপদে পড়লেই তখন মানুষকে ডাকে। বাঁধের নির্মাণকাজ শুরুর সময় যদি মানুষকে ডাকা হতো, পরামর্শ নেওয়া হতো, তাহলে এই সমস্যায় পড়তে হতো না।’

এদিকে ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’–এর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক বলেন, ‘মূল সমস্যা, বাঁধের কাজে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই। যত দিন কাজে দুর্নীতি–অনিয়ম বন্ধ না হবে, তত দিন হাওরে সমস্যা থাকবেই।’

কৃষকসহ সব মানুষের চেষ্টায় এখনো সুনামগঞ্জের বড় বড় হাওরের ফসলের কোনো ক্ষতি হয়নি জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমরা সবাইকে নিয়ে দিনরাত মাঠে আছি। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো ঝুঁকি কাটেনি।’

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন