জিবিনিউজ 24 ডেস্ক//
বুধবার সকাল ১০টা। রাজধানীর হাতিরঝিলের আঁকাবাঁকা সড়কে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলছে মোটরসাইকেল। বাইকের শব্দে ঝিলপাড়ের নিরবতা ভাঙে। বাইকের সাইলেন্সার দিয়ে ফট ফট, ঠাস ঠাস শব্দ করে আগুনের হলকা বের হচ্ছে। বিজয়োচিত উল্লাস তাদের চোখে মুখে। এখানে বেড়াতে আসা ভ্রমণপিপাসুদের কানে তালা লাগার জোগাড়! এসব বাইকার্সদের চেহারা দেখে যে কেউ বুঝবে এরা বয়সে কিশোর। কারও কারও মুখে এখনো দাঁড়ি-গোঁফের রেখা ওঠেনি। কিন্তু এই বয়সেই উঠে বসেছে বাইকের সিটে। হেলমেট পরার বালাই নেই এদের। এক একটি বাইকে তিন থেকে চারজন চড়ে সড়ক দাঁপাচ্ছে। ঈদের ছুটিতে ফাঁকা শহরে যেনো বেপরোয়া কিশোর বাইকাররা।
কিশোর-তরুণ বয়সী এসব বাইকারদের কারণে সড়কে মৃত মানুষের তালিকা লম্বা হচ্ছে। বেপরোয়া গতিতে বাইক চালানোয় অকালে মা-বাবার বুক খালি করে পরপারে পাড়ি জমাচ্ছে অনেক কিশোর।
শুধু হাতিরঝিল নয়, কিশোর বাইকারদের দাপট পুরো দেশজুড়েই। ঈদের আগের দিন থেকেই তারা সড়কে রাজত্ব করছে। পথচারী কিংবা রাস্তা পারাপার হওয়া মানুষের জন্য রীতিমতো ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর বাইকাররা। কেননা ফাঁকা রাস্তায় চোখের পলকে তারা ছুটে চলে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কখনো যে কার গায়ে বাইক উঠিয়ে দেয়, সেই ভয়ে ভীত পথচারীরা।
ঈদের দিন গতকাল মঙ্গলবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১৫টি দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এসব দুর্ঘটনার প্রাণ হারিয়েছেন ২০ জনেরও মতো। তাদের মধ্যে ১০ জনই বাইক আরোহী ছিলেন। তাদের মধ্যে বেশিভাগই কিশোর বয়সী। বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছেন তারা।
বন্ধুদের সঙ্গে বাইকে ঘুরতে গিয়ে মঙ্গলবার (৩ মে) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায় মারা গেছেন দুই যুবক। তারা হলেন-বরিশাল নগরীর ২৯ নম্বর ওয়ার্ড শাহপরান সড়কের বাসিন্দা শাজাহান মৃধার ছেলে নিরব এবং একই এলাকার নাছির হাওলাদারের ছেলে লিমন।
একই দিন ঢাকার ধামরাইয়ে বাইক নিয়ে ঘুরতে গিয়ে বাসচাপায় সিয়াম নামে এক কিশোর নিহত হয়েছে। সন্ধ্যায় নওগাঁর মান্দায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তোতা নামে আরেক বাইক আরোহী যুবক। তিনিও ঘুরতে বেরোনোর পর লাশ হয়েছেন।
ঈদের দিন ঘুরতে বেরিয়ে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বেউথা এলাকায় দুই মোটরসাইকেল সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন মহিদুর নামে এক তরুণ। একইদিন মাদারীপুরের রাজৈরে বাস-মোটরসাইকেল সংঘর্ষে রোমান মিনা নামে এক স্কুলশিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যু হয়েছে।
কিশোর বা তরুণ বয়সী এসব বাইকারদের কারণে সড়কে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কখন যে কে কোথায় বাইক উঠিয়ে দেয় সে আতঙ্ক কাজ করে মানুষের মধ্যে। এসব বাইকারদের ঠেকানো না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন সচেতন নাগরিকরা।
কিশোর বাইকারদের উৎপাত নিয়ে শ্যামপুরের বাসিন্দা মনির বলেন, প্রতি বছর ঈদ এলেই এসব বাইকার্সদের উৎপাত বাড়ে। বয়স কম, তাই এদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। বাবা, চাচা কিংবা মামার মোটরসাইকেল চেয়ে নিয়ে বাইক নিয়ে সড়কে নামে। সঙ্গে থাকে তিন চারজন। এদের বাইক চালানোর ধরন এতই বাজে যে দেখলেই রাগ-ক্ষোভ আসে মনে। ইচ্ছা করে ধরে এদের পেটাই।
শুধু মনির নয়, সচেতন নাগরিক হিসেবে ফাঁকা রাস্তায় কিশোর বাইকারদের উৎপাতে ভীত অনেকেই। এদেরই একজন মামুন। পুরান ঢাকার এই বাসিন্দা বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখছি, ঈদ এলেই রাস্তায় কিশোর ও তরুণরা বাইকের প্রতিযোগিতায় নামে। এরা নিজেরাও ঝুঁকিতে আছে। পথচলতিদেরও ঝুঁকিতে ফেলতে। এদের হাতে যারা বাইক তুলে দেয় তাদের সচেতন হওয়া উচিত। প্রিয় সন্তানকে অকালে সড়কে ঝরে যেতে না চাইলে হাতে বাইকের চাবি তুলে দেবেন না।
ঈদের ছুটিতে ঢাকায় যানবাহনের চাপ কম থাকায় মোড়ে মোড়ে নেই ট্রাফিক পুলিশ। তাই এদের থামানোর কেউ নেই যেন। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে তো চলছেই। এদের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা।
রাতে রামপুরা এলাকায় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বুথে টাকা তোলার জন্য যান বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী রেজা। সেখান থেকে মালিবাগ যাওয়ার জন্য সড়ক পার হচ্ছিলেন তিনি। দূরে একটি বাইক আসতে দেখে ভেবেছিলেন যানটি আসার আগেই সড়ক পার হতে পারবেন। কিন্তু সড়ক পারের চিন্তা করতে করতেই সাঁই করে কিশোর বয়সী তিন যুবক বাইক নিয়ে তার সামনে দিয়ে চলে যায়। এতে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন রেজা।
বেসরকারি এই চাকরিজীবী বলেন, ঢাকায় যখন যানজট থাকে, তখনই এসব কিশোর বাইকারদের উৎপাতে সড়কে চলা দায়। এখন সড়ক ফাঁকা পেয়েছে তাহলে তারা কেমন বেপরোয়া তা সহজেই অনুমেয়।
গত দুই দিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে যারা ভর্তি হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত।
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া জানান, গত দুই দিনে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যারা এসেছেন তাদের বেশিরভাগই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত। বয়সে এরা কিশোর কিংবা তরুণ।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সময়ে গণসচেতনতা তৈরিতে বিভিন্ন প্রচার চালিয়েছে। এখনো সেই প্রচার ও প্রচারণা অব্যাহত আছে। এছাড়াও ট্রাফিক বিভাগকে এ বিষয়ে বলা আছে। কারও ট্রাফিক লাইসেন্স থাকলে আমরা তাদের বাধা দিতে পারি না। তাদের মাথায় রাখতে হবে সবার আগে সেফটি দরকার। এ বিষয়ে সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার। পরিবারকে ভাবতে হবে তার সন্তান সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে পারে কিনা এবং তার হাতে গাড়ির চাবি দেওয়া ঠিক হবে কিনা। আমরা সচেতন না হলে দুর্ঘটনা বাড়বে আর একটি দুর্ঘটনা পুরো পরিবারের জন্য কান্না। এজন্য বলবো সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।’
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন