জিবিনিউজ 24 ডেস্ক//
কাস্টমসে কর্মরত বাবা অবসরে যাওয়ার পর সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন সাংবাদিক সোহানা পারভীন তুলি। সেই সঙ্গে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছোট ভাই মোহাইমিনুল ইসলামের পড়াশোনা চালাতেও সাহায্য করতেন তুলি।
দুই ভাই-বোনের মধ্যে তুলি বাবা-মার বড় সন্তান। শুধু আর্থিকভাবে নয় পরিবারের ভালো মন্দসহ সব কিছুর দায়িত্ব ছিল তুলির ওপর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করা তুলি সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক কালের কণ্ঠে কাজ করছেন। সর্বশেষ ২০২১ সালে তুলি অনলাইন গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনের চাকরি ছাড়েন। এরপর কিছু দিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। সম্প্রতি একটি অনলাইন শপ খুলে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তিনি।
হঠাৎ করে তুলির এই চলে যাওয়ায় ছন্দপতন হয়েছে পরিবারটির। তুলির মৃত্যুতে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে তার পরিবার। তার মৃত্যুর খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা-মা যশোরের গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর ছোট ভাই মোহাইমিনুল মাথার ওপর ছাদের মতো বড় বোন হারিয়ে দিশাহারা। কোনোভাবেই যেন এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারছেন না তুলির পরিবার।
এ বিষয়ে তুলির ছোট ভাই মোহাইমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, তুলি আপু আমার মাথার ওপর ছাদের মতো ছিলেন। বাবা অবসরের যাওয়ার পর আপুই সংসারের হাল ধরেছিলেন। আমার পড়াশোনার খরচেও সহযোগিতা করতেন। তার এভাবে চলে যাওয়া আমরা কেউ মেনে নিতে পারছি না। তার এমন পরিণতি দেখে মা বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আপুর সঙ্গে যখন আমার শেষ কথা হয় তখন বলেছিল, ছুটি পেলে বাবা মাকে দেখতে যশোর যাবেন। কিন্তু আপুর আর জীবিত অবস্থায় যশোর যাওয়া হল না। লাশ হয়ে যশোর গিয়েছেন।
মোহাইমিনুল আরও বলেন, আপুর দাফন যশোরে শেষ হয়েছে। আমরা নানাভাবে শুনতেছি তুলি আপু আত্মহত্যা করেছেন। আপু যদি আত্মহত্যা করেই থাকেন তাহলে আমরা জানতে চাই এর পেছনে কারো প্ররোচনা আছে কি না। কেন না একজন মানুষ তো এমনি এমনি আত্মহত্যা করতে পারে না।
এদিকে রায়েরবাজারের মিতালী রোডে ভাড়া বাসায় সাংবাদিক সোহানা পারভীন তুলির মরদেহ উদ্ধারের তৃতীয় দিন পার হয়ে গেলে আজ। এখনো প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা তুলি আত্মহত্যা করেছেন। আর যদি তুলি আত্মহত্যাই করে থাকেন তাহলে এতে কারো প্ররোচনা আছে কি না তদন্ত করে দেখছে পুলিশ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পুলিশের তদন্ত এখন পর্যন্ত এক জাগায়ই থেমে আছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে তুলি আত্মহত্যা করেছেন। তবে আত্মহত্যার পেছনে তুলির কাছের কারও প্ররোচনা আছে কি না সেটা এখন তদন্ত করছে পুলিশ। এক্ষেত্রে তুলির মোবাইল ফোনের কললিস্ট পর্যালোচনা করছে পুলিশ। এছাড়া মোবাইল ফোনের ফরেনসিকও করা হচ্ছে।
আরও জানা যায়, সাংবাদিক তুলির মরদেহ উদ্ধারের হওয়ার পর পুলিশের কাছে অনেক তথ্য এসেছে। যা এখন যাচাই-বাছাই করছে। তবে তুলি হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে এমন কোনো তথ্য পুলিশের হাতে এখনো আসেনি। তথ্য না থাকলেও সম্ভাব্য সব বিষয়কে সামনে রেখেই পুলিশ তদন্ত করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে তুলির মৃত্যু আসলে কিভাবে অথবা কি কারণে হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুলিশ ভিসেরা নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষার ও ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদনের অপেক্ষা করছে।
এ বিষয়ে হাজারীবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, তুলি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। আর এটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি। আগামীকাল ফরেনসিক প্রতিবেদন পেতে পারি। তবে তুলি আত্মহত্যা করে থাকলে এর পেছনে কারও প্ররোচনা আছে কি না তা আমরা জানার চেষ্টা করছি। আমরা বিভিন্ন তথ্য পেয়েছি, এসব তথ্যের আলোকে আমাদের তদন্ত চলছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের ধানমন্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আব্দুল্লাহ আল মাসুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাংবাদিক তুলির মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় আমরা এখন পর্যন্ত একজনকে ডেকে এনে কথা বলেছি। আমাদের কাছে থাকা বিভিন্ন তথ্যের যাচাই-বাছাই চলছে। তুলির মরদেহ উদ্ধারের পেছনে আসল সত্য জানার চেষ্টা করছি।
এদিকে তুলির মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) এক সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জিজ্ঞাসাবাদ করা ওই সাংবাদিক আর তুলির মধ্যে ২ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক চলছিল। ঘটনার আগের দিন মঙ্গলবার (১২ জুলাই) ওই সাংবাদিক নিজ মোটরইকেলে করে তুলির বাসায় আসেন। পরে ১ ঘণ্টা পর ওই বাসা থেকে বের হয়ে যান। সেই বের হয়ে যাওয়ার পর তুলি তার মোবাইল ফোন থেকে ওই সাংবাদিককে ম্যাসেঞ্জারে একাধিক ম্যাসেজ করেন। কিন্তু সেগুলোর কোনো উত্তর না দিয়ে ওই সাংবাদিক ডিলিট করে ফেলেন। এতে পুলিশের মনে সন্দেহ জাগে তাদের মধ্যে কোনো মনমালিন্য হয়েছিল কি না। তবে জিজ্ঞাসাবাদে ওই সাংবাদিক মনমালিন্য হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
আরও জানা যায়, জিজ্ঞাসাবাদ করা ওই সাংবাদিকের খোঁজ তুলির বাসার নিরাপত্তাকর্মীর মাধ্যমে পায় পুলিশ। বাসাটির নিরাপত্তাকর্মী ওই সাংবাদিকের ব্যবহার করা মোটরসাইকেলের নম্বরটি পুলিশকে দেয়। পরে পুলিশ মোটরসাকেলের নম্বরটি সূত্র ধরে ওই সাংবাদিকের বাসার ঠিকানা সংগ্রহ করে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বৃহস্পতিবার নিয়ে আসে। তাকে প্রায় ১ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে। এছাড়া তুলি মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় ডিএমপির হাজারীবাগ থানায় হওয়ায় ইউডি মামলার তদন্ত শেষে না হওয়া পর্যন্ত ওই সাংবাদিক ঢাকা না ছাড়ার জন্য নির্দেশে দেয় পুলিশ।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, মামলার তদন্তের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বিষয়ে ওই সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে। পুলিশের কাছে থাকা তথ্যের সঙ্গে ওই সাংবাদিককের দেওয়ার তথ্যের গরমিল পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তারা এসব তথ্য এখন যাচাই-বাছাই করে দেখছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের ধানমন্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আব্দুল্লাহ আল মাসুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাংবাদিক তুলির মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় হাজারীবাগ থানায় একটি ইউডি (অপমৃত্যু) মামলা হয়েছে। ইউডি মামলা হলেও আমরা সব বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত করে যাচ্ছি। মামলাটির তদন্তের স্বার্থে একজনকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমাদের কাছে থাকা কিছু তথ্যের সঙ্গে ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিভিন্ন তথ্যের ক্রস চেক করা হচ্ছে।
১৩ জুলাই (বুধবার) দুপুরে রাজধানীর রায়েরবাজারের মিতালী রোডের একটি ভাড়া বাসা থেকে সোহানা পারভীন তুলির ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
তুলির মরদেহ উদ্ধারের প্রাথমিকভাবে পুলিশ জানায়, তুলি আত্মহত্যা করেছে। তুলির ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক ছিল। বাসার অন্য কোনো জায়গা দিয়ে কোনো ব্যক্তির বের হওয়ার পথও ছিল না। এছাড়া তুলির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন