যেভাবে আড়াই সেকেন্ডের নিরাপত্তা গলদ প্রাণ কাড়ে শিনজো আবের

জিবিনিউজ 24 ডেস্ক//

ঘাতক প্রথম গুলি ছোড়ার পর দ্বিতীয় গুলির মাঝে ব্যবধান ছিল আড়াই সেকেন্ড। প্রথম গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও দ্বিতীয়টি ঠিক পিট বরাবর ঢুকে যায়। আর এতে মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। কিন্তু প্রথম গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পরপরই যদি দেহরক্ষীরা শিনজো আবের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতেন অথবা তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতেন তাহলে প্রাণ হারাতে হতো না তাকে।

জাপানের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে এমন মন্তব্য করেছেন দেশটির আট নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। জাপানি এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত ৮ জুলাই দ্বিতীয় গুলি থেকে আবেকে রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতা জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী হত্যাকাণ্ডে ধারাবাহিক নিরাপত্তা ত্রুটি ছিল বলে মনে হয়।

জাপানে বন্দুক সহিংসতার ঘটনা প্রায় বিরল এবং দেশটির রাজনীতিকরা হালকা নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে একেবারে জনগণের কাছে গিয়ে প্রচারণা চালান। সেই জাপানের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর নারায় এক ব্যক্তি বাড়িতে তৈরি অস্ত্র দিয়ে গুলি চালিয়ে আবেকে হত্যা করেন; যা দেশটির জনসাধারণকে হতবাক করে দিয়েছে।

    প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদাসহ জাপানি কর্তৃপক্ষ আবের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি ছিল বলে স্বীকার করেছে এবং পুলিশ বলছে, তারা এই ঘটনা তদন্ত করছে।

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি ঘটনাস্থলের ছয়জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলেছে এবং ঘাতকের গুলি ছোড়ার আগে সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিস্তারিত ধারণা পেতে বিভিন্ন দিক থেকে ধারণ করা একাধিক ভিডিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে।
dhakapost
প্রথম গুলি ছোড়ার পর ধোঁয়া তৈরি হয়। আর এই ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে আবের আরও কাছাকাছি চলে আসেন হামলাকারী

ফুটেজ দেখা যায়, ৬৭ বছর বয়সী আবে একটি সড়কের ট্রাফিক আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছেন। কিন্তু তার যে নিরাপত্তা দল ছিল তাদের আকস্মিক হামলার বিষয়ে তেমন কোনও প্রস্তুতি দেখা যায়নি। কোনও ধরনের তল্লাশির মুখোমুখি হওয়া ছাড়াই হামলাকারী ৪১ বছর বয়সী তেতসুয়া ইয়ামাগামি বাড়িতে তৈরি একটি অস্ত্র নিয়ে আবের কয়েক মিটারের মধ্যে চলে আসেন। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি এদিক-সেদিক তাকিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। আবের বক্তৃতা শুনে হাততালিও দেন।

জো বাইডেন যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন তখন তাকে নিরাপত্তা দিয়েছিলেন গ্লোবাল থ্রেট সলিউশনের প্রধান কেনেথ বোম্বাস। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের পেছন দিকে একেবারে বাধাহীনভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন হামলাকারী। দেহরক্ষীদের উচিত ছিল সেটি দেখা এবং তাকে বাধা দেওয়া।’

যুক্তরাষ্ট্রের এলিট বাহিনী নেভি সিল এবং গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা জন সল্টিস। তিনি বর্তমানে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংস্থা প্রোসেগারে কর্মরত আছেন। তিনি বলেন, আবের চারপাশে দেহরক্ষীদের ‘নিরাপত্তার এককেন্দ্রিক বলয়’ ছিল বলে মনে হয়নি। এমনকি ভিড়ের মধ্যে জনসাধারণের ওপর তাদের কোনও ধরনের নজরদারিও ছিল না।

    তদন্তকারী সূত্রের বরাত দিয়ে দেশটির দৈনিক দ্য ইয়োমিউরি শিমবুন বলছে, ‘প্রথম গুলি ছোড়ার আগে হামলাকারী তেতসুয়া ইয়ামাগামি আবের প্রায় ৭ মিটারের মধ্যে চলে আসেন। পরে দ্বিতীয় গুলি ছোড়েন তিনি; যা আবেকে আঘাত হানে। আর এই গুলি ছোড়েন পাঁচ মিটার দূর থেকে।’

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে আবের প্রচারণা কর্মসূচির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত নারা পুলিশ রয়টার্সকে এক বিবৃতিতে বলেছে, আবের সুরক্ষায় ‘নিরাপত্তা সমস্যাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শনাক্ত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ পুলিশ বিভাগ। তবে এই বিষয়ে আর মন্তব্য করতে রাজি হয়নি নারা পুলিশ।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, প্রথম গুলির পর আবে একটু ঘুরে তার বাম কাঁধের দিকে তাকান। এ সময় দু’জন দেহরক্ষী আবে এবং বন্দুকধারীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একজন একটি পাতলা কালো ব্যাগ ওপরে তুলে ধরেন। অন্য দু’জন হামলাকারীর দিকে এগিয়ে যান। প্রথম গুলি ছোড়ার পর ধোঁয়া তৈরি হয়। আর এই ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে আবের আরও কাছাকাছি চলে আসেন হামলাকারী।

নিহন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট ও টেররিজম বিশেষজ্ঞ মিৎসুরু ফুকুদা বলেছেন, আবের নিরাপত্তা দল মুহূর্ত পরেই হামলাকারীকে জাপটে ধরে এবং তাকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু আবেকে রক্ষার পরিবর্তে হামলাকারীর দিকে যাওয়াটা ‘ভুল কৌশল’ ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাজধানী টোকিওর পার্শ্ববর্তী শহর সাইতামার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ইয়াসুহিরো সাসাকি। এক সময় দেশটির ভিআইপিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। সাসাকি বলেন, ‘সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছিল, কিন্তু বিপদের কোনও বোধ ছিল না। গুলির ঘটনায় সবাই চমকে গিয়েছিল এবং আবের কাছে কেউই যাননি।’

ভিআইপি রাজনীতিবিদদের দেহরক্ষীদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা টোকিও পুলিশ নারা পুলিশের কাছে আবের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। জাপানের স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা দ্য ন্যাশনাল পুলিশ এজেন্সি (এনপিএ) বলেছে, পুলিশ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় আবে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এই ধরনের গুরুতর ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য কঠোর পদক্ষেপ বিবেচনাধীন রয়েছে। একই সঙ্গে তারা নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা ব্যবস্থা পর্যালোচনার জন্য একটি দল গঠন করেছে।

রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে এনপিএ বলেছে, ‘শুধুমাত্র ঘটনাস্থলের প্রতিক্রিয়াই নয়, বরং নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা, কর্মকর্তাদের মোতায়েন, মৌলিক নিরাপত্তা প্রক্রিয়া এবং এনপিএ যেভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল তাতেও সমস্যা দেখা গেছে।’
dhakapost
আবের চারপাশে দেহরক্ষীদের ‘নিরাপত্তার এককেন্দ্রিক বলয়’ ছিল না বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা

ইয়ামাগামি বর্তমানে টোকিও পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। যে কারণে তার কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স। এছাড়া তিনি কোনও আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন কিনা সেটিও জানা যায়নি।

‘এড়ানো যেত’

টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভাগের স্পেশাল অ্যাসল্ট টিমের সাবেক সার্জেন্ট ও নিরাপত্তা পরামর্শক কোইচি ইতোর মতে, আবে কথা বলার সময় ফুটেজে চারজন দেহরক্ষীকে দেখা যায়। স্থানীয় রাজনীতিবিদ মাসাহিরো ওকুনি এই দেহরক্ষীদের সংখ্যা নিশ্চিত করেছেন। হামলার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন তিনি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যখন বক্তৃতার জন্য এগিয়ে আসেন, তখন তার পেছনের দিকে ইয়ামাগামিকে হাততালি দিতে দেখা যায় ভিডিওতে। ফুটেজে দেখা যায়, ইয়ামাগামি আবের পেছনের দিকে হেঁটে এগিয়ে গেলেও সাথে সাথে কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ও বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা মার্কিন কূটনৈতিক নিরাপত্তা পরিষেবার একজন সদস্য বলেছেন, দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আবের একজন নিবেদিতপ্রাণ দেহরক্ষী থাকা উচিত ছিল। মার্কিন এই এজেন্ট বলেন, ‘আমরা তার (আবের) বেল্ট এবং কলার ধরতাম, আমাদের শরীর দিয়ে ঢাল তৈরি করে তাকে দূরে সরিয়ে নিতাম।’
আবের দেহরক্ষী দল যদি মাত্র দুই-এক সেকেন্ডের মধ্যে তার কাছে পৌঁছানোর মতো দূরত্বে থাকত, তাহলে পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন হত।
টোকিও পুলিশের সাবেক সুপারিনটেনডেন্ট জেনারেল কাতসুহিকো ইকেদা

সাবেক সার্জেন্ট ও নিরাপত্তা পরামর্শক কোইচি ইতো বলেছেন, যদি দেহরক্ষী দল সতর্ক থাকত এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখত তাহলে প্রথম গুলিটি ঠেকানো যেত। তিনি বলেন, এমনকি যদি তারা প্রথমটি মিস করেও ফেলত তারপরও দ্বিতীয় গুলির আগে যেহেতু দুই সেকেন্ডের বেশি বিরতি ছিল; তারা অবশ্যই এটি ঠেকাতে পারত। আবেকে যদি যথাযথভাবে সুরক্ষা দেওয়া যেত, তাহলে ঘটনাটি নাও ঘটতে পারত।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন