ফারহানা বেগম হেনা ||
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা শত বছরের পরনো ত্রিপুরা মহারাজার কাছারি বাড়িটি। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত এই বাড়িটি বর্তমানে কোন রকমে দাড়িয়ে থেকে জানান দিচ্ছে ইতিহাসের স্নিতি হ্নীন্নের কথা। এক সময়ের সুন্দর্যে ভর পুর এই বাড়িটির সুন্দর্য আজ আর চোখে পড়েনা। অবহেলা আর অযত্নের কারনে দৃষ্টিনন্দন ত্রিপুরা মহারাজার কাছারি বাড়িটি এক প্রকার পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।বাড়িটিকে দেখলে মনে যেনো ভূতুরে একটি বাড়ি।আজ সময়ের বিবর্তনে অযত্ন ও অবহেলায় স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক এই কাছারি বাড়িটি এখন ধ্বংসের মুখে।বাড়িটি দেখে মনে হয় এটি কোন মহারাজার কাছারি বাড়ি নয় যেনো এটি একটি ভূতুরে বাড়িতে পরিনত হয়েছে।বর্তমানে কাছারি বাড়িটির হাল এমন হয়েছে যে বাড়িটির চারিদিকের দেয়াল গুলো দিনের পর দিন অযত্নে অবহেলায় ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে প্রায়।বাড়ির দেয়ালে ধরেছে শেওলা এছাড়াও বাড়িটির চারপাশেই আগাছায় ভর করে আছে ও ময়লা-আবর্জনার স্তুপও পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। বর্তমানে বাড়িটি দেখে বুঝার কোন উপায় নেই যে এই বাড়িটি এক সময়ের মহারাজার কাছারি বাড়ি ছিল।কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে এই বাড়িটি অর্ধ মৃত অবস্থায় থেকেও ইতিহাসের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যতা কে বহন করে চলছে কালের সাক্ষী হয়ে।
ইতিহাসের পাতা থেকে এই মহারাজার কাছারি বাড়িটি সম্পর্কে নানা বিষয় জেনে অতি আগ্রহ নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আজও ছুটে আসেন পর্যটকরা মহারাজার কাছারি বাড়িটি একনজর দেখার জন্য ও বাড়িটির ইতিহাস জানার জন্য। কিন্তু সঠিকভাবে কাছারি রাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে শত বছরের কালের সাক্ষী শ্রীমঙ্গলের ঐতিহাসিক মহারাজার কাছারি বাড়ির ইতিহাস।
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৮৯৮ সালে তৎকালীন ত্রিপুরা মহারাজা কর্তৃক এতদ্ঞ্চলের প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য শহরের মধ্যভাগে প্রায় দেড় বিঘা জমির ওপরে চুন-সুরকি দিয়ে ঐতিহাসিক এই কাছারি বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২০ ফুট প্রস্থে ১২ ইঞ্চি চওড়া দেওয়াল দ্বারা নির্মিত হয় ভবনটি। অষ্টাদশ শতাব্দী হতে পর্যায়ক্রমে ত্রিপুরার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মাণিক্য দেববর্মন বাহাদুর এবং আধুনিক ত্রিপুরার স্থপতি মহারাজা বীর চন্দ্র মাণিক্য দেববর্মন বাহাদুর ও তার পুত্র মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্য দেববর্মন বাহাদুর ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এতদঞ্চলে তাদের রাজত্বকালে এখান থেকেই তাদের প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন। বর্তমানে এই কাছারী বাড়িটি স্থানীয় ভূমি অফিসের সীমানায় অন্তভূক্ত করা হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহরের হবিগঞ্জ রোডের ভূমি অফিস সংলগ্ন কাছারি বাড়িটি ঘুরে দেখা যায়,ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অংশ হিসেবে কালের স্বাক্ষী হয়ে দীর্ঘকাল ধরে অযত্ন-অবহেলায় জরাজির্ন হয়ে পড়ে আছে ভবনটি। ৩টি কক্ষের ৮টি দরজা ও ৯টি জানালার একটিরও অস্থিত্ব নেই আজ। রং উঠে গিয়ে কালছে আকার ধারণ করা বিশাল এই ভবনের মধ্যভাগ বরাবর বড় ফাঁটল দেখা দিয়েছে। কেবলমাত্র সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুরাকীর্তির নিদর্শনের ঐতিহাসিক এ কাছারি বাড়িটি এখন তার যৌবন-যৌলুজ হারিয়ে ধ্বংসিত হয়ে দিনে দিনেই কালের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে।
ঐতিহাসিক এই বাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে ভগ্ন অবস্থায় তার অস্তিত্ব কে জানান দিতে আজও কোন মতে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের এমন ইতিহাস ঐতিহ্য,সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক স্থান গুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করার জন্য সরকারি পর্বেক্ষণ কেন্দ্র আছে কিন্তু ঐতিহাসিক এই মহারাজার কাছারি বাড়িটি দেখে মনে হয় না যে এই বাড়িটিকে যথাযথ ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করার জন্য কেউ আছেন।
বৃহত্তর সিলেট ত্রিপুরা উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জানান,এই বাড়িটি কে টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক আন্দোলন করার পর ২০১৬ জুন মাসে তৎসময়ের শ্রীমঙ্গল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো.নুরুল হুদা এই কাছারী বাড়িটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে ভবনটিতে নতুন করে রঙের কাজ করান।কিন্তু পরবর্ত্তীতে এই কাজের আর কোন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি।এই কাছারী বাড়িটি সংরক্ষণ করে ত্রিপুরা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে বৃহত্তর সিলেটের ত্রিপুরাদের সংস্কৃতির ইতিহাসকে রক্ষা করা যেতো।এ ব্যাপারে ত্রিপুরা মহারাজার স্মৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক এবং তার রাজত্বকালে নির্মিত কালের সাক্ষী হিসেবে ভবনটির আদিরূপ অক্ষুন্ন রেখে তা পুণঃসংস্কার করে এখানে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করা হলে বৃহত্তর সিলেটের ক্ষুদ্র ত্রিপুরা সমাজ জাতি সত্ত্বার ইতিহাস-ঐতিহ্য,শিল্প-কৃষ্টি ও সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার সুযোগ পাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সিলেট অঞ্জলের ১৬ টি ত্রিপুরা পল্লীর ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা,সংস্কৃতি ও উন্নয়ন,ভূমি সমস্যা ও সমাধানসহ কাছারি বাড়ি সংরক্ষণ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের করা হলে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি,ইতিহাস ও ঐতিহাসিকে রক্ষা করা যেত।পাশাপাশি এই দর্শনীয় স্থানটিকে পর্যটন স্থান হিসেবেও গড়ে তুলা যেত এতে করে যেমন মহারাজার কাছারি বাড়িটি ফিরে পেত তার প্রাণ তেমনি পর্যটকদের মাধ্যমে রাজস্ব আয়ও হতো।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা ভূমি ও পত্নতাত্তিক কার্যালয়ে বার বার লিখিত ও মৌখিক ভাবে যোগাযোগ করা হলেও এর কোন সুফল পাওয়া যায়নি।তবে ত্রিপুরা কাছারি বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য সরকারের চিন্তাভাবনা থাকলেও এ ব্যাপারে এখনও কোন পরিকল্পনা গৃহীত হয়নি।এতে করে দিনে দিনে ধ্বংস হতে চলেছে মহারাজার কাছারি বাড়ি।
স্থানীয় এলাকাবাসীর কাছে বাড়িটির সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন,কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক এই কাছারি বাড়িটি এখন অর্ধ মৃত ভগ্ন অবস্থায় রয়েছে যা মোটেই আমাদের কাম্য নয়। আমরা ইতিহাস থেকে অনেক কিছুই জানতে পারি এবং তা থেকে শিক্ষা ও নিতে পারি তাই ইতিহাসকে বাচিঁয়ে রাখা উচিৎ। ইতিহাস ছাড়া কোন মানুষ ই তার নিজের অস্তিত্ব কে খুঁজে পেতে পারে না তাই আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে ইতিহাসর রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিৎ।
অযত্ন আর অবহেলার কারণে কালের বিবর্তনে আমাদের অনেক ইতিহাস ঐতিহ্যই আজ হারিয়ে গেছে। বর্তমানে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে এই প্রজন্মের অনেক ছেলে,মেয়েই আছে যারা আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেনা। সচেতন মহলের উচিৎ যে আমাদের জন্য না হোক আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য হলেও আমাদের এই ইতিহাস ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা ও নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস ঐতিহ্যকে তুলে ধরা।একজন সচেতন নাগরীক হয়ে এই দায়ীত্ব যেমন আপনার আমার ও দেশ পরিচালনায় যারা আছেন তাদেরও।
অচিরেই যদি এই ঐতিহাসিক কাছারি বাড়িটির যথাযথ ভাবে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা ও সংস্কার করার উদ্যোগ না নেয়া হয় তা হলে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই ঐতিহাসিক বাড়িটি হারিয়ে যাবে চিরতরে।ইতিহাস,ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যকে বহণ করা শ্রীমঙ্গলের জমিদার বাড়িটিকে আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখা উচিৎ।মহারাজার কাছারি বাড়িটিতে এমন অনেক ঐতিহাসিক পুরাকীর্তির নিদর্শন ছিল যা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ বিলিন হওয়ার পথে যা আমাদের জন্য মোটেই কাম্য নয়। আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে হলেও আমাদের এই ঐতিহাসিক ঐতিহ্য কে টিকিয়ে রাখা দরকার।স্থানীয় এলাকাবাসীরা বলেন,কতৃপক্ষের কাছে আমাদের জোড়ালো দাবি এখনো যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেটাকেই অচিরেই যথাযথ ভাবে যেনো রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করার ব্যবস্থা নেন।
এই ঐতিহাসিক বাড়িটিকে দেখার ও কাছারি বাড়ি সম্পর্কে জানার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আজও ছুটে আসেন পর্যটকরা। ইতিহাস ঐতিহ্যকে জানতে আসা পর্যটকদের সামনে শ্রীমঙ্গলের এই কাছারি বাড়ি ও ত্রিপুরা মহারাজার সম্পর্কে সঠিকভাবে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে পর্যটক ও আমাদের আগামী প্রজন্মের সকলেই এই ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্য কে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতে পারে তাদের প্রজন্মের কাছে। তাই পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আগেই কতৃপক্ষের কাছে জোড়ালো অনুরোধ করেন যাতে এই ইতিহাস ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন