।। মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার ।।
করোনা নামের মহামারি অন্যান্য অঙ্গনের পাশাপাশি চরম ক্ষতিগ্রস্ত করেছে দেশের শিল্প-সাহিত্যসহ সংগীতাঙ্গনকেও। এ সংক্রান্ত খবর অনেকেরই অজানা। কণ্ঠ, যন্ত্রশিল্পীসহ গীতিকার-সুরকার এবং সংশ্লিষ্টদের গত মাস কয়েকের দিনাতিপাতের কিছু কিছু আমার জানা। সকলের আনন্দের খোরাক যোগানদারদের এই কষ্ট উল্লেখ করতেও মন কাঁদে। জাগে অনেক প্রশ্নও। শিল্পীরা সম্মানিত তাই তারা রাস্তায় নেমে তাদের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করতে পারছে না। আবার মুখ বুজেও সহ্য করতেও পারছেন না কেউ কেউ।
শিল্পচর্চা তাদের কাছে এখন সেকেন্ডারিও থাকছে না। যেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে টিকে থাকাই কঠিন। শিল্প তথা বিনোদন অঙ্গনের কথা চিন্তা করলে জবাব মেলে না। সবচেয়ে কম পারিশ্রমিক নিয়ে যে কাজ করছে, একজন প্রোডাকশন বয়, তার জন্য যা, বড় শিল্পির জন্যও তা। এই অঙ্গনটা যে গভীর সমস্যায় পড়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও পড়তে যাচ্ছে, এদের নিয়ে কেউ চিন্তা করছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসের আর্থিক ক্ষতি কাটাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। এর মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা। এছাড়াও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এর আগেও বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে সরকারের তরফ থেকে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এবারের মতো এতো বড় আকারের প্রণোদনা প্যাকেজ এর আগে আর দেয়া হয়নি। সেখানে শিল্পি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের হিস্যাটা বড় দুর্বল। জানেও না অনেকে। ব্যক্তিগতভাবে লেখালেখি, সাংবাদিকতার পাশাপাশি শিল্পিসমাজের সঙ্গে আমার একটা নিবিড় যোগাযোগ। কিছু চিরস্থায়ী গিট্টুবাজ ছাড়া দল মত নির্বিশেষে মানুষ আমার লেখা পড়ে। শিল্পিরা পছন্দ করেন। কেউ বিরোধী মতের হলেও আমার কথার সত্যতাকে গুরুত্ব দেয়।
সমাজ রাষ্ট্র নিয়ে লেখালেখি করলে অনেকেই অন্যান্য শিল্পীর দিকে আঙ্গুল তোলেন। বিভিন্ন অনিয়মে তাদের নীরব ভূমিকায় ক্ষুদ্ধ হন। একসময় এই শিল্পী ইন্ডাডিষ্টিকে আমারও খুব রাগ লাগতো। অনেক বিচার বিশ্লেষন করে দেখলাম আসলে তাদের উপায় নেই। বেশী সাহস দেখাতে গেলে কর্মহীন হয়ে যেতে পারেন। তাই তারা বিনয়ের নামে উটপাখী হয়ে আত্মরক্ষা করেন, আবার রোষানলের পড়ে যাওয়ার ব্যাপার আছে। সংস্কৃতি অঙ্গনে মাফিয়াদের কালো টাকা ঘুরে। কে কখন খরচের খাতায় চলে যায় সে ভয়তো আছেই। তাছাড়া এ দেশে শিল্পীদের নিরাপত্তায় কোন রকম পলিসি নেই। শিল্পীরা বিভিন্ন সময় চ্যারিটি করে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। আর শিল্পীদের জন্য একটাই আশ্রয়, সেটা প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিল। সেখান হাতে গোনা কিছু তারকা শিল্পী সাহায্য পায়। সেই সাহায্য পেতে হলে আবার লবিংও প্রয়োজন, সবাই পাবেনা। তারকা শিল্পীদের একটু সুবিধা বেশী, এতে সরকারের প্রচার প্রচারনাও চলে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকায় সবার হক থাকলেও পেটে রশি বেঁধেই ক্ষুধা নিবারন করতে হয় দারিদ্র্য আক্রান্ত প্রায় সব যন্ত্রশিল্পীদের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে শুরু বিভিন্ন সময়ে শিল্পীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাছাড়া বর্তমানে বিনোদনহীন এই ক্যাকটাসের দেশে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির কঠিন মুহূর্তে শিল্পীরাই সাধারন মানুষদের বিনোদিত করে মনে একটু শান্তি দিচ্ছেন। নিজস্ব সংস্কৃতি ছাড়া পৃথিবীর বুকে যে কোন জাতিই যাযাবর শ্রেনীর। সুতরাং নিজেদের অস্তিত্বকে সমুন্নত রাখতেই শিল্পীদের সম্মান করা উচিত। অপরাধ সব সার্কিটে সবচেয়ে বেশী, অনেকে মজা পান শিল্পীদের ব্যক্তিজীবনের কিচ্ছা চিবিয়ে খেয়ে। আমি গায়ক নই, এই শিল্পী সমাজে একজন একজন অন্ধভক্ত। ভাগ্য সহায় ছিল, তাই মহান আল্লাহর কৃপায় দেশের কিছু মানুষ আমাকে চেনে ভালবাসে দোয়া করে। এসবের যোগ্য নই জানি। আমি একজন সাধারন বাংলাদেশী,আপনাদের এক শুভাকাঙ্ক্ষী সঙ্গী। শিল্পীদের ভালবাসুন, তারা দেশের সম্পদ। পাশাপাশি চিহ্নিত করে রাখুন সুখের সময়ের বন্ধুদের, যারা শিল্পীদের মানসম্মান সমুন্নত রাখতে পারে না। যুগে যুগে এই দেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে মহাজ্ঞানী মহাজনদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকায়। সেই ভূমিকার প্রতি অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা সইবার সুবোধ-সুশীল আমি নই।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন