১০ম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা
ভাষা সৈনিক অলি আহাদ রাজনীতির নক্ষত্র
।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া ।।
আমাদের ইতিহাসের নানা বাকে নানা ঘটনা জড়িয়ে আছে। এসকল ঘটনার রয়েছে নায়ক, খলনায়কসহ নানা চরিত্র। ইতিহাসের প্রয়োজনেই তাদের জন্ম। তাদের কারণেই ইতিহাস হয়েছে সমৃদ্ধ। তেমনই ইতহাসের এক উজ্জল নক্ষত্রের না হচ্ছে ভাষা বীর, ভাষা সৈনিক অলি আহাদ। একজন চীর বিপ্লবী, চির বিদ্রাহী রাজনীতিকের নাম। জীবনের ইতিহাসে আপোষ নাই বললেই চলে।
বায়ান্নর ভাষা সংগ্রামে জীবনবাজি রেখে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, ভাষাসৈনিক অলি আহাদ ছিলেন তাদেরই অন্যতম। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি আদায় করেই তিনি থেমে ছিলেন না, পরবর্তীকালে স্বাধীকার, স্বাধীনতা, অধিকার আদায়ের আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন।
অলি আহাদের মত মেধাবী রাজনীতিবিদ এই মাটিতে খুব কমই জন্মগ্রহন করেছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকেও তিনি কোনো নিশ্চিত পেশাকে বেছে নেননি। তিনি জনগনের মুক্তির জন্য বেছে নিয়েছিলেন রাজনীতিকে। আজকের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে এই অসম্ভব মেধাবী, জ্ঞানী মানুষটির রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলোচনা করলে প্রশ্ন জাগে তিনি কি আসলে সফল ছিলেন রাজনীতিতে ? নাকি তার জীবন ব্যর্থ একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রমাণ করে? কারণ, আজকের বাস্তবতায় এমপি-মন্ত্রী হওয়াটাই হলো রাজনৈতিক সফলতা হিসাবে বিবেচ্য। সেটা যে কোন উপায়ে বা যে কোন রাস্তায়। সে রাস্তা যতটাই আদর্শহীন বা অন্ধকারই হোক না কেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে তাকেই প্রথম কারাগারে যেতে হয়। ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কারণে ২৯ মার্চ, ১৯৪৮ তৎকালীন সরকার তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের জন্য বহিষ্কার করে। তিনি বি.কম সম্পন্ন করলেও তৎকালীন সরকার তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.কম করতে দেয়নি। দীর্ঘ ৫৮ বছর পর ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়।
এছাড়া ১৯৪৭-১৯৭৫ সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনের শেষ ভাগে তিনি ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সক্রিয় এই রাজনীতিবিদ জীবনের শেষ সময়ে পর্যন্ত সেই দলেরই সভাপতি ছিলেন। একই সঙ্গে আশির দশকের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘ইত্তেহাদ’-এর সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া জাতীয় রাজনীতিতে তার অভিজ্ঞতা সংবলিত গ্রন্থ “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫” এর প্রণেতা তিনি।
ভাষা সৈনিক অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইসলামপুরে। তাঁর পিতা আবদুল ওহাব ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে ১৯৪৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে গণভোটে তিনি ত্রিপুরা জেলার চার সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের কারণে ১৯৪৬ সালে আইএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.কমে ভর্তি হন। কলেজ জীবনেই তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসাবে রাজনীতিতে যুক্ত হন। সেখান থেকেই তার রাজনীতি শুরু।
১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ১৯৫২-এর রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদকও তিনি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের জন্য তাকে প্রথম কারাগারে নিক্ষিপ্ত করে পাকিস্তানি পুলিশ। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.কম পড়ার সুযোগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে।
ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের নায়ক ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদ তার জীবনের দীর্ঘ ১৯ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। রাজনীতি করেছেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে। তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধায় নুরুল আমিন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। নবাবপুরে আওয়ামী লীগ অফিসে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। সংগ্রাম পরিষদের সভায় আবদুল মতিন, অলি আহাদ ও গোলাম মওলা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ভোট দেন। ছাত্ররা ১০ জনে অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা শুরু করলে ছাত্রদের সাথে পুলিশের খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে অনানুষ্ঠানিক ভাবে শহীদ শফিউর রহমানে পিতা আর ২৬ ফেব্রুয়ারি আবুল কালাম শামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেছিলেন। ইতিমধ্যে পুলিশ নিরাপত্তা আইনে আবুল হাশিম, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ, পুলিন দে, অধ্যাপক পৃথ্বিশ চক্রবর্তী, অলি আহাদ প্রমুখকে গ্রেফতার করে। নুরুল আমিন সরকার ভাষা আন্দোলনকারীদের ‘ভারতের চর’, ‘হিন্দু’, ‘কমিউনিস্ট’ ইত্যাদি আখ্যা দেয়।
অলি আহাদ এক সময় আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ৷ ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক মেরুকরণের সময় তিনি মাওলানা ভাসানীর সাথে প্রগতিশীলদের পক্ষে যোগ দেন। তিনি চিরদিন গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বপক্ষে সংগ্রাম করেন। সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন কালে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী জনমত গঠন করেন ৷ তার রচিত ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ নামক গ্রন্থটি এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল ৷
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি আধিপত্যবাদ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন ৷ মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বাস্তবায়নের জন্য শাসকদের উপর তিনি চাপ সৃষ্টি করেন ৷ তৎকালীন সরকারের ভূল রাজনীতি, অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দুঃশাসন বিরোধী এক তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারি করে সভা সমিতি বন্ধ করার প্রতিবাদে জনাব অলি আহাদ ২৮ জুন ১৯৭৪ তারিখে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টে বেঞ্চ ৯ অক্টোবর ১৯৭৪ তারিখে ১৪৪ ধারা জারিকে অবৈধ ঘোষণা করেন ৷ কিন্তু ইতিমধ্যে ৩০ জুন ১৯৭৪ তারিখে বিশেষ ক্ষমতা আইনে সরকার তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে শাসকগোষ্টি। তিনি ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সৃষ্ট একদলীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ান। বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে পরিচালিত সকল সংগ্রামে অকুতোভয় এই লড়াকু জননায়ক আজীবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আশির দশকে সামরিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপোসহীন ভূমিকার কারণেও তিনি নিগৃহীত হন।
তাকে একাধিকবার গ্রেফতার করে কারাগারে আটকে রাখা হয়। শুধু তাই নয়, তার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ইত্তেহাদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অলি আহাদ ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামে একটি দল গঠন করেন। দলটি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোটের শরীক হয়।
ঔপনিবেশিক আমল থেকে পাকিস্তান আন্দোলন এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়- সে এক সুবিস্তৃত ইতিহাস। ইতিহাসের এই ধারায় রাজনীতির পথ পরিক্রমায় পরিচালিত হয়েছে বহু আন্দোলন, বহু সংগ্রাম। এই আন্দোলন ও সংগ্রামে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত থেকে অনেকেই নানা ভূমিকা পালন করে গেছেন। কিন্তু আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, প্রতিটি সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে আপোষহীন ভূমিকা পালন করেছেন, তেমন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অস্তিত্ব গোটা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় খুবই বিরল। অলি আহাদ হচ্ছেন তেমনি এক বিরল নেতৃত্ব। তিনি একই সঙ্গে যেমন আপোষহীন তেমনি দৃঢ়চিত্তের মানুষ ছিলেন।
অলি আহাদ শুধু একটি নাম নয়, অলি আহাদ একটি সংগ্রামের নাম- সংগ্রামী ইতিহাসের একটি অনন্য অভিধা। অনেকেরই হয়ত অজানা যে, মুসলিম লীগের স্বেচ্ছাচারী শাসনের প্রতিবাদে প্রথম আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পরে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার পিছনে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে পাক- মার্কিন সিয়াটো সেন্টো চুক্তির বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথেও সৃষ্টি হয় অলি আহাদের বিভেদ। অবশ্য মাওলানা ভাসানীর অবস্থানকে সমর্থন জানাতে গিয়েই অলি আহাদ সেদিন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিরোধে জড়িয়ে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগেই থেকে গেলেন; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে আবার সাধারণ সম্পাদক হলেন; আর অলি আহাদ নীতির প্রশ্নে আপোষহীন থাকার কারনে দল থেকে ছিটকে পড়লেন।
সেই থেকে শুরু হলো আপোষহীনতার পথে অলি আহাদের যাত্রা। রাজনীতি সংগ্রামের দুর্গম গিরি মরু কান্তার, পেরিয়ে তাঁর সেই যাত্রা আজীবন অব্যাহত ছিলো। যেখানইে স্বৈরাচারী একনায়ক, কিংবা যেখানেই গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে- দেয়া কোন ফ্যাস্টিক শাসক, সেখানেই তাদের গণবিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে অলি আহাদের কন্ঠ বর্জনির্ঘোষ। তাঁর সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ্’ সকল আগ্রাসন আধিপত্যবাদ আর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছিল এক দ্রোহের বহ্নিশিখা। কিন্তু শাসকদের নগ্ন হস্ত ঐতিহ্যবাহী ইত্তেহাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে মোটেও দেরি করে নাই। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের পক্ষ থেকে কোন না কোন সময়ে অলি আহাদকে ক্ষমতার ভাগ দেওয়ার প্রলোভনও কম দেওয়া হয় নাই। কিন্তু তিনি অবলীলায় তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ক্ষমতারোহণের প্রথম পর্যায়েই অলি আহাদকে মন্ত্রিত্বের পদ দিতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান কিংবা হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সবাই তাকে চেয়েছিলেন ক্ষমতার পাশে রাখতে। কিন্তু ক্ষমতার হাতছানি কোন সময় অলি আহাদকে তাঁর বিদ্রোহী ভূমিকা থেকে টলাতে পারে নাই। ফলস্বরুপ এমন একটি সরকার ছিলনা যে, সরকার অলি আহাদকে কারাগারে আটক করে নাই।
রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কষ্টিপাথরে যাচাই করলে অলি আহাদ শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই নন; একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের সকল গুনও তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। টগবগে যৌবন থেকে শুরু করে গত অর্ধশতাব্দীকাল রাজনৈতিক অঙ্গনে দৃপ্ত পদচারণায় নীতির প্রশ্নে অটল ও অবিচল থেকে তিনি প্রমাণ করেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণ বড় কথা নয়। বড় কথা হল নীতির প্রশ্নে নিরাপোষ থাকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা; এবং আগামী বংশধরদের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ গঠনের স্বার্থে বর্তমানকে অবহেলায় বিসর্জন দেওয়া।
১৯৮২- এর পর অলি আহাদ একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যাঁকে এরশাদের সামরিক সরকার বিশেষ সামরিক ট্রাইবুন্যালে বিচারের সম্মুখীন করেছিল। সে দিন সামরিক আদালতে দাড়িঁয়ে অলি আহাদ অকুতোভয়ে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তা আজও আমাদের সকল সংগ্রামের প্রেরনা হতে পারে। অলি আহাদের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ’ ছিল ছাপার অক্ষরে এক জীবন্ত দ্রোহ। ১৯৮৪ সালের ৮ই অক্টোবর ৭নং সামরিক আদালতে প্রদত্ত অলি আহাদের সেই ঐতিহাসিক জবানবন্দীর একটি অংশ নিম্নে উদ্ধৃতি করা হলো : -
“আমার বিবেক আর আজীবন রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের কাছে বিশ্বস্ত থেকে আমি বলতে চাই যে, তাত্ত্বিক কিংবা আদর্শগত কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই সামরিক আইন প্রশাসন আমার কাছে গ্রহনীয় নয়, যিনিই এটা জারী করুন না কেন; হোন তিনি জেনারেল আইয়ুব, অথবা জেনারেল ইয়াহিয়া অথবা লেঃ জেনারেল জিয়াউর রহমান অথবা মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর কিংবা লেঃ জেঃ এইচ. এম. এরশাদ। বিচারাসনে উপবিশষ্ট হওয়া মাননীয় আদালতের ক্ষমতার উৎস হচ্ছে ১৯৮২ সনের ২৪ শে মার্চের মার্শাল ল প্রক্লামেশন। যেহেতু সামরিক আইন একটি বাস্তবতা; সেহেতু আমাকে মাননীয় আদালতকে মানতে হয়। আধুনিক ইতিহাস রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে জেনারেলদের অধিষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের শাসন তাদের স্ব স্ব দেশ ও জনগণের জন্যে বয়ে এনেছে বিপর্যয়। দৃষ্টান্ত স্বরুপ বলা যায়, নবাব সিরাজুদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফর আলী খান বাংলাকে দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ করার জন্য দায়ী। এই শৃংখলের পথ ধরেই ভারত ১৯০ বছর ধরে পরাধীনতার শৃংখলে শৃংখলিত হয়। নেপোলিয়ন বোনাপার্টি ফ্রান্সের বিপর্যয় ডেকে আনে। জার্মানীর হিটলার সভ্যতাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে। গণতান্ত্রিক সিস্টেমেও জেনারেলদের শাসন আকর্ষণীয় কিছু নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল আইসেন হাওয়ার (আইখ) সোভিয়েত রাশিয়ার আকাশে ইউ-২ গোয়েন্দা বিমান পাঠিয়ে ১৯৬০ সনে প্যারিসে অনুষ্ঠিতব্য রাষ্ট্র প্রধানদের শান্তি- সম্মেলন বিপর্যয় করে ফেলেন। জাপানের জেনারেল তোজো তার দেশকে উপহার দিয়েছেন পরাজয় আর বিপর্যয়। সাম্প্রতিক কালের সমর- নায়কদের শাসনের ইতিহাসও চরম ব্যর্থতার আলেখ্য। জেনারেল আইয়ুব, আর্জেন্টিনার জেনারেল গলতিয়ারী, বার্মার জেনারেল নেউইনের শাসন এই নির্মম বাস্তবতারই প্রমাণ বহন করে।”
ক্ষমতার রাজনীতিতে দৃশ্যতঃ অলি আহাদ সফল ব্যক্তি নন। কিন্তু গণমানুষের কল্যাণে, জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের ভূমিকা বিশ্লেষণে তাঁর সফলতা ঈর্ষনীয়। একজন রাষ্ট্রনায়কের যে গুণাবলী থাকার কথা তার সবটুকুই তাঁর চরিত্র ও চিন্তায় বিদ্যমান ছিল। তাঁর সান্নিধ্যে একঘন্টা কাটাতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাস পাঠ নেয়ার জ্ঞান অর্জন করা যেত। তাঁর মুখ নৃ:সৃত প্রতিটি বাক্যইে ছিল অনুসন্ধিৎসু মনের চিন্তা ও সৃষ্টিলীল রচনার অবমিশ্রি উপাদান। বিশ্ব রাজনীতির প্রতিটি ঘটনা শুধু তাঁর নখদর্পনে নয়, চলমান ঘটনাবলীর ব্যাপারে তার বিজ্ঞ-বিশ্লেষণও সত্যি চমৎকার ছিল। শেষ জীবনের কিছুটা সময় তার সান্নিধ্য আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া। আমার অনেক বড় সৌভাগ্য। কিন্তু, দু:খজনক হলেও সত্য তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারছি না। ব্যর্থতার গ্লানি আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে।
মহান রাজনৈতিক নেতা অলি আহাদ ২০ অক্টোবর ২০১২ ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। অলি আহাদকে যারা চির বিদ্রোহী বলেন, তারা ভুল কিছু বলেন না। সেদিকের বিচারে অলি আহাদ যেন জাতীয় কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতারই মূর্তপ্রতীকঃ যাঁর –“শির নেহারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!”
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জনাব অলি আহাদকে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৪ প্রদান করা হয়৷
অলি আহাদদের মত বীর ভাষা সৈনিক ও সংগ্রামী রাজনীতিবিদদের কারণেই আমরা পেয়েছি মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার, পেয়েছি স্বাধীণ-সার্বভৌম এই বাংলাদেশ, পেয়েছি লাল সবুজে অঙ্কিত একটি পতাকা, একটি মানচিত্র। তাদের এ ঝণ কখনো শোধ হবার নয়। এ জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে এই সব বীর সেনানীদের।
জাতীয় অহঙ্কার, ভাষা বীর অলি আহাদের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীরতম শ্রদ্ধা। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন তাকে ক্ষমা করুন ও দান করুন জান্নাত।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন