মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার ।।
৬ অক্টোবর ২০২০ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এর খতীব মাওলানা উবায়দুল হক এর ১৩ তম মৃত্যু বার্ষিক।
তিনি ইসলাম, দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী দেশী- বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতেন। এমনকি বাংলাদেশ সরকার নিয়ন্ত্রিত এই জাতীয় মসজিদের খতীব হওয়ার পর ও তিনি সরকারের নানা ধরনের ইসলাম বিরোধী কাজের প্রতিবাদ করতেন কঠোরভাবে। তার মধ্যে কোনো ধরনের ভয়ভীতি লক্ষ করা যায়নি। ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী আগ্রাসী শক্তির করাল গ্রাসে মুসলিম উম্মাহ্র জীবনস্পন্দন যখনই হয়েছে বিপন্ন, ঈমানী চেতনা যখন নিভু নিভু; তখনই কান্ডারী হয়ে এগিয়ে এসেছেন এমন কিছু সিপাহসালার যাদের স্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠের বলিষ্ঠ ও সাহসী হুঙ্কারে জনসাধারণের মাঝে দীনি জজবা ও প্রেরণার সৃষ্টি হয়েছে।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সম্মানিত খতিব, এদেশের তাওহিদী জনতার অভিভাক ও মুরুব্বী, জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হযরত মাওলানা উবায়দুল হক রহ. সেই মহামনীষীদের একজন। তিনি ছিলেন সত্যিকারে নায়েবে রাসুল। খাঁটি দেশেপ্রেমিক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ। মজলুম ও নির্যাতিত অত্যাচারিতদের পক্ষে জালেমের বিরুদ্ধে আপসহীন।
১৯৯৩ সালে খতমে নবুওয়ত আন্দোলন যখন তুঙ্গে। তৎকালীন বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর সাথে খতমে নবুওয়ত বিষয়ে আলোচনার জন্য ওলামায়ে কেরামের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে খতিব সাহেব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান।
মন্ত্রীর সাথে দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে খতিব সাহেব তার সিলেটি টোনে বললেন, ‘মন্ত্রী সাব! আপনি আল্লাহ এক, মুহাম্মদ সা. শেষ নবী এবং তারপর অন্য কোনো নবী আসবেন না— এ কথা বিশ্বাস এবং ঘোষণা করেন কি না?
মন্ত্রী বললেন, জী হাঁ! খতিব সাহেব আবার প্রশ্ন করলেন, এ বিশ্বাস যারা করে না, তারা মুসলমান কি না? মন্ত্রী বললেন, ‘না! তারা মুসলমান নয়।’ আমরা তো ভিন্ন কিছু চাই না। শুধু এটুকু রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করে দিন।
আরও অনেক কথা হলো। অবশেষে মন্ত্রী কাদিয়ানীদের অপব্যাখ্যা সম্বলিত কুরআনের তাফসিরসহ বিভিন্ন প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণার ওয়াদা করেছিলেন এবং তা আংশিক বাস্তবায়নও হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা উবায়দুল হক রহমাতুল্লাহি আলাইহির নবম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি সিলেট শহর থেকে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার দূরের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বারঠাকুরিতে ১৯২৮ সালের ২ মে, শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেন।
দারুল উলুম দেওবন্দে পড়াশোনার শেষ বছর ঢাকার বড়কাটারা হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসার মুহতামিম হজরত মাওলানা আবদুল ওহাব পীরজী হুজুর (রহ.)-এর আগ্রহে এবং দেওবন্দের শিক্ষকদের পরামর্শে খতিব সাহেব মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি তিন বছর শিক্ষকতা করার পর হজরত মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি ও মাওলানা এজাজ আলী (রহ.) ও অন্যান্য শিক্ষকের সাথে দেখা করার জন্য দেওবন্দ চলে যান।
মাওলানা এজাজ আলী (রহ.) তাকে উত্তর প্রদেশের শাহজাহানপুরের এক মাদরাসায় শিক্ষকতার জন্য পাঠিয়ে দেন। সেখানে কিছু দিন শিক্ষকতা করার পর মাওলানা এজাজ তাকে নিয়ে এসে করাচির হজরত মুফতি শফী (রহ.)-এর দারুল উলুম মাদরাসায় শিক্ষকতার জন্য পাঠিয়ে দেন।
হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর খলিফা এবং পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির শীর্ষনেতা হজরত মাওলানা আতহার আলী (রহ.) ও মাওলানা উবায়দুল হককে মুফতি শফী (রহ.)-এর অনুমতিক্রমে ঢাকায় নিয়ে এসে পার্টির রচনা ও প্রকাশনা বিভাগের দায়িত্ব দেন।
এ সময় মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকায় সিনিয়র শিক্ষকের একটি পদ শূন্য হলে মাওলানা উবায়দুল হককে এ পদে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
১৯৫৪ সালে তিনি তার শিক্ষক মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর অনুমতিক্রমে মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকায় যোগ দেন। মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকায় তিনি ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত হাদিস বিভাগের লেকচারার, ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তাফসির বিভাগে সহকারী মাওলানা, ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এডিশনাল হেড মাওলানা এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত হেড মাওলানা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
১৯৮৫ সালের ২ মে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সাল থেকে বেশ কয়েক বছর ঢাকার ফরিদাবাদ এমদাদুল উলুম মাদরাসায়, ১৯৮৬ ও ’৮৭ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসায় এবং ১৯৮৭ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিলেট কাসিমুল উলুম দরগাহে হজরত শাহজালাল (রহ.) মাদরাসায় শায়খুল হাদিসের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮৫ সাল থেকে কয়েক বছর তিনি ঢাকার ইসলামপুর ইসলামিয়া মাদরাসায় মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ঢাকা আজিমপুরের ফয়জুল উলুম মাদরাসার শায়খুল হাদিস ও মুহতামিমের দায়িত্বে ছিলেন।
জামেয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ ও কুমিল্লা কাসিমুল উলুম মাদরাসার মজলিসে শূরার সভাপতি, সিলেট জামিয়া সিদ্দিকিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান, মঈনুল উলুম হাটহাজারী, পটিয়া মাদরাসা এবং সিলেট জামেয়া কাসিমুল উলুম মাদরাসাসহ অনেক ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মজলিসে শূরার সদস্য ছিলেন। ঢাকা আলিয়া মাদরাসার হেড মাওলানার দায়িত্বে থাকাকালে তিনি ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিবের দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০০৭ সালের ৬ অক্টোবর আমৃত্যু এই দায়িত্বে ছিলেন।
ইসলামি দলগুলোর অভিভাবক এর দায়িত্ব করেছেন বিভিন্ন সঙ্কটকালে। দেশ ও জাতির আজকের এ দুর্দিনে তার মতো খতিবের আজ খুবই প্রয়োজন ছিল। ২০০৭ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশে সফররত ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ শাহরুখীর সম্মানে সেই অনুষ্ঠানে তার দাওয়াত ছিল। অনুষ্ঠানের শেষ দিকে হঠাৎ করে বুকে একটু ব্যাথা অনুভব করলে ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে রমজান মাসে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজকে তার মৃত্যু বার্ষিক উপলক্ষে মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট তার আত্মার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
( লেখকঃ বিশেষ প্রতিবেদক শ্যামল বাংলা ডট নেট ও শ্যামল টিভি, মহাসচিব জালালাবাদ ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন, সাবেক কাউন্সিলরঃ বিএফইউজে-বাংলাদেশ ও সদস্য, ডিইউজে )
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন