দে লো য়া র জা হি দ ||
দেশের উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে দেশের উচ্চশিক্ষার যে চিত্র তুলে ধরেছে তা রীতিমত ভয়াবহ ও উদ্বেগের। এর কারণ হিসেবে উঠে এসেছে বিচারিক ক্ষমতা নেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের। আইনগত অক্ষমতা ও কর্তৃত্বহীনতার স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক এ সংস্থা।
দেশের অর্ধশতাধিক পাবলিক ও ৯৫ টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম প্রতিফলন ঘটেছে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে। ১৭ দফা সুপারিশ সহ বার্ষিক এ প্রতিবেদনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়ে ২০২১ সালের ইউজিসি কার্যক্রমের ওপর তৈরি ৪৮তম এ প্রতিবেদন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতা, গতিশীলতাতো এখন স্বপ্নের ও অতীত, সু-শাসন ও মানসম্মত শিক্ষার প্রত্যাশা শুধুই কল্পনা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ কে বলা চলে স্থবির ও অকার্যকর। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাচার ও দুঃশাসন যেন দানাবেদে উঠেছে, নিশ্চিতভাবে একাডেমিক, প্রশাসনিক এবং আর্থিক বিষয় অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা এখন নিয়মিত । এরই মাঝে ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন নিয়ে এসেছে একগুচ্ছ সুপারিশমালা, শিরোনাম হয়েছে সংবাদপত্রের। ” বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে ‘স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন’ চায় ইউজিসি (প্রথম আলো, জানুয়ারি ১২, ২০২৩) দুর্নীতি রোধে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে স্বতন্ত্র কমিশন প্রস্তাব (দৈনিক শিক্ষা, জানুয়ারি ১২, ২০২৩)” তথ্য সূত্রে প্রকাশ, “দেশে উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তেও অনেক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এসব অনিয়মের প্রতিকার মিলছে না। দু-একটি উদাহরণ ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না।” পটভূমি পর্যালোচনায় দেখা যায় বিগত একযুগের ব্যর্থতার এ দায়ভার বর্তায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপর।
মুখে মুখে দুর্নীতির কথা না বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিলে ব্যবস্থা: প্রধানমন্ত্রী, এ শিরোনামের সংবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে অহেতুক দুর্নীতির কথা বলা হচ্ছে। মুখে মুখে দুর্নীতির কথা না বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ওয়াদা ভোলে না, প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। জাতির পিতা যে স্বনির্ভরতার পথ দেখিয়েছিলেন, সেই পথেই হাঁটছে বর্তমান সরকার।
১৪ জানুয়ারি শনিবার গণভবনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথসভায় তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে অহেতুক দুর্নীতির কথা বলা হচ্ছে। যারা এসব বলে বেড়াচ্ছে, তারাই চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ। শুধু মুখে বললে হবে না, কোথায় দুর্নীতি হয়েছে, তা স্পষ্ট করে জানাতে হবে। (১৫ জানুয়ারি, প্রথমআলো নর্থ আমেরিকান এডিশন)
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে ইউজিসির স্বতন্ত্র কমিশন গঠনের প্রস্তাব: দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে পারবে? শীর্ষক নিবন্ধে প্রকাশ, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির স্বতন্ত্র কমিশন গঠনের প্রস্তাব কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সর্বোত্তম অনুশীলন কিনা তা ভেবে দেখার পূর্বে ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট এর অধীন বিতর্কিত সকল নিয়োগ প্রতিরোধে ইউজিসির গৃহীত পদক্ষেপ এবং সংঘটিত দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে অবশ্যই জনগণের জানা থাকা দরকার।(বিশ্লেষণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩)
গোটা ২০২১ সাল, পাবলিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছিল একটি ক্রান্তিকাল। দৈনিক ইত্তেফাক, মে ২৬, ২০২২ লিখেছে, আইন মানছে না অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়! বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’ মানা বাধ্যতামূলক। আর এই আইন সঠিকভাবে পালন করছে কি না, তা তদারকির জন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইন মানছে না, পাশাপাশি ইউজিসির নির্দেশনার বেশির ভাগ অগ্রাহ্য করছে। মূলত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিকদের ‘রাজনৈতিক’ প্রভাবের কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে এই তদারকি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে অনিয়ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা।”
দৈনিক যুগান্তর (জুলাই ২৬, ২০২২) আমার নিবন্ধ “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন- নিয়োগ নৈরাজ্য ও আইন অমান্যতা” বাংলাদেশের সিংহভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) ও প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও ট্রেজারারসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া ছাড়া এগুলো সিদ্ধান্তহীনতা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন’ (ইউজিসি) প্রদত্ত তথ্য দেখা যায়, ১০৪ টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪০ টিতে ভিসি পদ খালি রয়েছে, ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো প্রো-ভিসি নেই এবং ৪৯ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের পদ শূন্য রয়েছে। (সূত্রঃ ডেইলি সান) সূত্রটি আরও জানায়, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট-২০১০-এর ২৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে যে- প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি, কোষাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রারের মতো ব্যক্তিদের স্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক।…উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে অচলাবস্থা গুলো দূর করার উদ্যোগ নেওয়া, নিয়োগ নৈরাজ্য ও আইন অমান্য-তার প্রতিকারে কঠোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।...দৈনিক যুগান্তর (আগস্ট ৫, ২০২২) “একাডেমিক উৎকর্ষতা ও দক্ষ প্রশাসনিক নেতৃত্ব মানবসম্পদ উন্নয়নের আলোকবর্তিকা” শিক্ষা নিয়ে দুই হাজার একুশ সালে আমার ডজনখানেক আর্টিকেলের আরো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোতে রাষ্ট্রপতির (চ্যান্সেলর) ভূমিকা এবং ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারার নিয়োগ তাদের নির্বাচন পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা বিবেচনা করে যে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রতিনিধিত্ব, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং অংশগ্রহণের নামে প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সম্পর্কে সমালোচনামূলক সংকেত প্রদান করে; ইস্যুটি নিয়ে আরও মনোযোগ দেয়া দরকার কারণ এ মূল্যবোধগুলি সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মৌলিক ভিত্তি গঠন করে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন পদ্ধতিগুলি অন্বেষণ করলে আমাদের বর্তমান ব্যবস্থার বিচ্যুতিগুলো সহজে ধরা পড়ে।…শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেওয়া ও শিক্ষকতার মতো একটা পবিত্র ও মহান পেশা নিম্নস্তরে কোথায় নেমে যাচ্ছে এবং কেন নেমে যাচ্ছে তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার ও কাজ করার সময় এসে গেছে, বিলম্বে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের জারিকৃত নিয়োগ বিধি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত প্রবিধানমালার আলোকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের অনুষদ সদস্য (অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষক), রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, পরিচালক (আইকিউএসি) ও অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সকল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বেধে দেয়া নিয়ম-কানুন অনুসরণ না করার প্রবণতা অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির স্বতন্ত্র কমিশন গঠনের প্রস্তাব কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সর্বোত্তম অনুশীলন কিনা তা ভেবে দেখার পূর্বে ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট এর অধীন বিতর্কিত সকল নিয়োগকে প্রতিরোধে ইউজিসির গৃহীত পদক্ষেপ এবং সংগঠিত দুর্নীতি ও সজনপ্রীতির বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে ও পর্যালোচনা করা দরকার। স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকনোমি, স্মার্ট সোসাইটি-যতোকিছু বলিনা কেন এ শব্দগুলোর ভিতরে লুকিয়ে আছে প্রযুক্তিনির্ভর নির্মল ও স্বচ্ছ একটি শিক্ষাব্যবস্থা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল গ্রহণ করতে প্রয়োজন যুগ উপযুগি শিক্ষা, প্রয়োজন শিক্ষিত তরুণ জনশক্তি ও স্মার্ট সিটিজেনের, ভবিষ্যতের অদম্য অগ্রযাত্রায় শামিল হতে ও নতুন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে. উচ্চ শিক্ষায় দীর্ধ এক যুগের দ্বৈত শাসনের অবসান হওয়া দরকার, দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের।
[লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার, সভাপতি, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক, কানাডা নিবাসী]
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন