জিবি নিউজ || লেস্টার ||
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, মুফতিয়ে আযম, উস্তাদুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসীন, পীরে কামেল, হযরত আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব ক্বিবলাহ (রহ.)’র ঈসালে সাওয়াব মাহফিল গত ৫ ফেব্রুয়ারী রোববার মধ্য ইংল্যান্ডের লেস্টার শহরে তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত দারুস সালাম মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করেন দুবাগী ছাহেবের লেস্টারের প্রবীণ ছাত্র আলহাজ আবু তাহের। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তাঁর বড় ছাহেবজাদা হযরত আল্লামা জিল্লুর রহমান চৌধুরী দুবাগী। বিশেষ অথিতির বক্তব্য রাখেন তাঁর মেজো ছাহেবজাদা হযরত মাওলানা ওলিউর রহমান চৌধুরী দুবাগী। মাহফিলে আরো বক্তব্য রাখেন দারুস সালাম মসজিদের ইমাম ও খতিব হযরত হাফিজ মাওলানা আব্দুল জলিল, মসজিদের সভাপতি আলহাজ মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ডঃ শফিকুল ইসলাম চৌধুরী, মসজিদের ট্রাস্টী প্রবীণ মুরব্বী আলহাজ্ব আব্দুর রহীম, কাউন্সিলর শহীদুল্লাহ খান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব ইকবাল ওয়াহিদ, মসজিদের সহ-সভাপতি আলহাজ্ব আজিজুর রহমান, আলহাজ্ব ফরিদ মিয়া, আলহাজ্ব আলী আশরাফ প্রমুখ। তাঁর ছাত্র-ছাত্রী, মুসল্লীয়ান, মুরীদীন, মুহিব্বীন ও সর্বস্তরের জনসাধারণ উপস্থিত ছিলেন।
বক্তারা স্মৃতিচারণ করে বলেন: হযরত আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব (রহ.) লেস্টার শহরে সবাইর কাছে তিনিঁ "বড় হুজুর" হিসেবে অধিক পরিচিত ছিলেন। লেস্টারের বাহিরে তিনি "লেস্টারের সাব" হিসেবে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন।
লেস্টার দারুস সালাম মসজিদ বিভিন্ন ভাবে ঐতিহাসিক, যেমন: ১৯৭৮ সালে দুবাগী ছাহেবের আগমনের পূর্বে লেস্টারে বাংলাদেশী কমিউনিটির নিজস্ব কোন মসজিদ মাদ্রাসা বা কমিউনিটি সেন্টার ছিল না। তিনি লেস্টারে আসার পর বাংলাদেশী জনগণকে উৎসাহ উদ্ধীপনা দিয়ে মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আগ্রহান্বিত করেন। পরবর্তীতে এই মসজিদকে কেন্দ্র করে লেস্টারে বাংলাদেশী কমিউনিটির অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা, কমিউনিটি সেন্টার এবং সংগঠন হয়েছে। আল্লামা দুবাগী ছাহেব (রহ.) ছিলেন যুক্তরাজ্যে জৈনপুরী/ফুলতলী মতাদর্শের প্রথম আলিমে দ্বীন। বৃটেনে তিনি সর্বপ্রথম এ মসলকের ভিত্তিস্থাপন করেন। যুক্তরাজ্যে এ মসজিদ জৌনপুরী/ফুলতলী মসলকের সর্বপ্রথম মসজিদ। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাজ্যে সর্বপ্রথম এই মসজিদে দারুল কিরাত প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এই মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা বৃটেনের বিভিন্ন শহরে কিরাত প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করে লেস্টারের সুনাম অর্জন করেছেন। এমনকি ফুলতলী ছাহেব লেস্টারের ছাত্র-ছাত্রীদের কোরআন তিলাওয়াতের কথা গর্ব করে বলতেন অনেক আলেম উলামাদের চেয়ে এদের কোরআন তিলাওয়াত অধিক শুদ্ধ। আল্লামা দুবাগী ছাহেব (রহ.) শুধু বাচ্চাদেরকে বিশুদ্ধ কোরআন শিক্ষা দেননি, একইসাথে সাথে তিনি বয়স্কদেরকে ও শুদ্ধ কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন, এমনকি বয়স্কদের মধ্যেও কেউ কেউ শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব (রহ.) থেকে ইলমে কেরাতের সনদ ও অর্জন করেছেন।
সৈয়দপুরে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এর উপর নির্মম হামলার পর ১৯৮০ সালে দুবাগী ছাহেব যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরের মুরব্বিয়ানকে নিয়ে লেস্টার শহরে এক সভার আয়োজন করে বিলাতে সর্বপ্রথম আনজুমানে আল-ইসলাহ প্রতিষ্ঠা করেন। বৃটেনে তিনি ফুলতলী মসলকের নীতিনির্ধারক ছিলেন। তাই দুবাগী ছাহেবের কারণে লেস্টারই ছিল এ মছলকের হেডকোয়াটার বা প্রধান কেন্দ্র। ইউকে আনজুমানে আল-ইসলাহর প্রথম সভাপতি (মরহুম হাজী আবু তালিব) ও সেক্রেটারী (মরহুম মাস্টার আব্দুল কুদ্দুস) লেস্টারের লোক ছিলেন। ১৯৭৮ সালে ফুলতলী ছাহেব (রহ.) প্রথমবারের মত যুক্তরাজ্যে আগমণ করলে লেস্টারেই অবস্থান করেছিলেন। এছাড়া এই মসজিদে যুগশ্রেষ্ঠ অনেক ওলিআল্লাহ এসেছেন যেমন, আল্লামা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বিস্কুটি সাহেব (রহ.), শায়খুল হাদিস আল্লামা হবিবুর রহামন ছাহেব (রহ.), শায়খুল হাদিস আল্লামা আব্দুল জব্বার গুটারগ্রামী ছাহেব (রহ.), ফুলতলীর ছাহেবজাদাগন সহ উপমহাদেশের প্রখ্যাত পীর মাশায়েখ।
হযরত আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রত্যেক জুম্মায় ওয়াজ-নসীহত ছাড়া ও প্রতিদিন আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দারসে হাদিস এবং ইসলাহী নসিহত তথা আমল-আখলাক সংশোধনের নসিহত করতেন। অত্যন্ত সহজবোধ্যভাবে কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াসের সমন্বয়ে তাঁর প্রগাঢ় আলোচনা গভীর ইলমি মাহফিলে পরিণত হতো। বিভিন্ন দেশের ইসলামি গবেষকগণও তাঁর মাহফিলে উপস্থিত হয়ে জ্ঞানার্জন করতেন। রুটিন করে প্রতি রোববারে কোরআন থেকে তাফসীর করতেন। প্রতি বৃহস্পতিবারে নিয়মিত খানেকা তথা জিকিরের মাহফিল করতেন।
মানুষকে তিনি শরীয়ত ও তরিকতের সঠিক দিক নির্দেশনা দিতেন। বয়ান ও লিখনীর মাধ্যমে দ্বীনের খেদমতে সারাটা জীবন অতিবাহিত করেছেন। তিনি নানা মাসালা মাসাইল হাতে লিখে লিফলেট আকারে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন এবং প্রায় শতাদিক কিতাব লিখে গেছেন। যে কোন কঠিন মাসলায় তাঁর দালিলিক সমাধান সর্বদলীয় ওলামায়ে কেরামের কাছে ঐক্যমতে গ্রহণযোগ্য ছিল। তাঁর প্রচেষ্টায় লেস্টারের মুসল্লিদের আমল আখলাক দেখে বড় বড় আলেম উলামা ও অবাক হতেন, এবং বলতেন দুবাগী ছাহেব লেস্টারের মুসল্লীদেরকে গড়ে তুলতে সফল হয়েছেন। তাঁর আমল-আখলাক, নম্রতা-ভদ্রতা, ইবাদত-বন্দেগী ইত্যাদিতে তিনি একজন সত্যিকারে আল্লাহর ওলী ছিলেন। যেমন, হাদিস শরীফে এসেছে যেসব মনীষাগণের চেহারা দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ আসে তারাই হলেন ওলীআল্লাহ।
হযরত আল্লামা দুবাগী ছাহেব (রহ.) ছিলেন উস্তাযুল উলামা, প্রখ্যাত মুফতি, শায়খুল হাদীস, মুফাসসির ও উঁচু মার্গীয় সাত কেরাতের ক্বারী। তাকওয়া ও পরহেজগারীসহ বহুগুণের অধিকারী এমন বিশিষ্ট বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব ক্ষণজন্মা হয়ে থাকেন। অনেক যুগ কিংবা শতাব্দীর পর এমন বিরল গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্বকে পাওয়া যায়। তাদের কারো সংস্পর্শে আসা মহা সৌভাগ্যের বিষয় হয়ে থাকে।
তাঁর লেস্টারের সফল আলোকিত ছাত্র -ছাত্রীরা আলেম উলামা, ডাক্তার, ইঞ্জিয়ার, একাউন্টেন্ট, জজ, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিবিদ এবং উচ্চ পদস্থ সরকারী আমলা হিসেবে বেশ সুনাম ও সুখ্যাতির সাথে খেদমতে খালক করে যাচ্ছেন। সর্বদিক দিয়ে তিনি একজন সফল ব্যক্তি ছিলেন, তাঁর সন্তানগণ সবাই ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কবরে শুয়ে শুয়ে তিনি পেতে থাকবেন সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব।
হযরত আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব (রহ.)’র ইন্তেকালে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বৃটেনে বাংলাদেশ দূতাবাস, বিশ্বের মুসলিম-অমুসলিম অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশের আলিম-ওলামা, নানান কমিউনিটির নেতৃস্থানীয়গণ, বড় বড় ইসলামী সংগঠনের প্রধান ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ যেভাবে শোক প্রকাশ করেছেন এবং তাদের শোকাহত শ্রদ্ধাঞ্জলি বা অভিব্যক্তি জানিয়েছেন তা একজন বাঙালি আলিম-শায়েখের ক্ষেত্রে ছিল বিরল। এমনই বিরল সম্মানজনক স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব (রহ.) এবং এটি লেস্টারবাসীর জন্য ও সম্মানের বিষয় কারণ তিনি “লেস্টারের সাব” ছিলেন।
সর্বশেষে এ মহতী অনুষ্ঠানে মীলাদ পাঠান্তে দোয়া পরিচালনা করেন দুবাগী ছাহেবের সুযোগ্য বড় ছাহেবজাদা আল্লামা জিল্লুর রহমান চৌধুরী দুবাগী।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন