জিবিনিউজ24ডেস্ক//
ইতালির দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে নৌকাডুবির এক ঘটনায় অন্তত ৫৮ জন অভিবাসীর প্রাণহানি ঘটেছে। উন্নত জীবনের আশায় বিপজ্জনক ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অভিবাসীদের ইউরোপে পৌঁছানোর মরিয়া চেষ্টা ফুটে উঠেছে রোববারের এই দুর্ঘটনায়।
প্রত্যেক বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার অভিবাসী নানা দুর্যোগ, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট থেকে পালিয়ে উন্নত জীবনের আশায় এই পথ বেছে নেন। এই অভিবাসীদের অনেকেই কোনো রকমে পৌঁছাতে পারলেও কারও কারও ঘটে যায় সলিল সমাধি। যেসব দেশ থেকে অভিবাসীরা ইউরোপে যাওয়ার এই প্রাণঘাতী পথ বেছে নেন, সেসব দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশও।
তবে এই অভিবাসীদের সিংহভাগই উত্তর আফ্রিকা থেকে যাত্রা করেন। ইতালির সরকার অভিবাসীদের বিপজ্জনক সমুদ্রপথ পাড়ি দেওয়ার লাগাম টানার চেষ্টা করছে। কেন এই বিপজ্জনক যাত্রা, কোন কোন দেশ থেকে বেশি সংখ্যায় যাচ্ছেন অভিবাসীরা চলুন জেনে নেওয়া যাক।
• অভিবাসীদের আগমন
ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইতালিতে নৌকায় চেপে পৌঁছেছেন ১৩ হাজার ৬৭ জন অভিবাসী। যা ২০২২ সালের একই সময়ের ৫ হাজার ২৭৩ জন এবং তার আগের বছরের ৪ হাজার ১৫৬ জনের তুলনায় অনেক বেশি।
চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ইতালিতে পৌঁছানো অভিবাসীদের মধ্যে অন্তত ৮৬১ জন শিশু রয়েছে; যাদের সঙ্গে কোনও অভিভাবক পাওয়া যায়নি।
এর আগে, গত বছর মোট এক লাখ ৫ হাজার ১২৯ জন অভিবাসী ইতালিতে পৌঁছান; যা ২০২১ সালের ৬৭ হাজার ৪৭৭ ও তার আগের বছরের ৩৪ হাজার ১৫৪ জনের তুলনায় বেশি। তবে দেশটিতে অভিবাসীদের পৌঁছানোর রেকর্ড হয়েছিল ২০১৬ সালে। ওই বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এক লাখ ৮১ হাজার ৪৩৬ জন অভিবাসী ইতালিতে যান। ২০২২ সালে দেশটিতে অভিভাবকহীন শিশু অভিবাসী পৌঁছেছিল ১৩ হাজার ৩৮৬ জন।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলেছে, ২০২২ সালে ৫১ শতাংশ অভিবাসী লিবিয়া থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছান। এছাড়া দেশটিতে ৩১ শতাংশ অভিবাসী তিউনিসিয়া এবং ১৫ শতাংশ তুরস্ক থেকে যান। একই বছর ইতালিতে পৌঁছানো মোট অভিবাসীদের মধ্যে বাকিরা লেবানন, আলজেরিয়া এবং সিরিয়া থেকে যাত্রা করেছিলেন।
• অভিবাসীরা কোন কোন দেশের নাগরিক
চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ইতালিতে অভিবাসীদের পৌঁছানোর শীর্ষ দেশগুলো হল গিনি (১ হাজার ৬৫৪ জন), আইভরিকোস্ট (১ হাজার ৫১১ জন), পাকিস্তান (৯৯৭জন), তিউনিসিয়া (৮৪৬জন), মিসর (৪৯০জন) এবং বাংলাদেশ (৪৪৭ জন)।
২০২২ সালে ইতালিতে পৌঁছানো অভিবাসীদের শীর্ষ দেশের তালিকায় ছিল মিসর (২০ হাজার ৫৪২ জন), তিউনিসিয়া (১৮ হাজার ১৪৮ জন), বাংলাদেশ (১৪ হাজার ৯৮২ জন), সিরিয়া (৮ হাজার ৫৯৪ জন) এবং আফগানিস্তান (৭ হাজার ২৪১ জন)।
• মৃত এবং নিখোঁজ
জাতিসংঘের নিখোঁজ অভিবাসী প্রকল্প ২০১৪ সাল থেকে মধ্য-ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত অথবা নিখোঁজ হয়েছেন বলে জানিয়েছে। অভিবাসীদের প্রাণহানি এবং নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ভূমধ্যসাগরকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক পথে পরিণত করেছে।
চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরের এই পথে ২২০ জনেরও বেশি অভিবাসী মারা গেছেন অথবা নিখোঁজ হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
• অভিবাসীদের যাত্রা ঠেকানোর উদ্যোগ
২০১৭ সালে ইতালির তৎকালীন মধ্য-বামপন্থী সরকার অনিয়মিত অভিবাসন, মানবপাচার প্রতিরোধ ও সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে লিবীয় কর্তৃপক্ষের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এই চুক্তির ফলে ইতালিতে অভিবাসীদের পৌঁছানোর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পায়।
তবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সেই সময় এই চুক্তির নিন্দা জানিয়ে বলেছে, চুক্তির পর হাজার হাজার অভিবাসীকে বন্দী শিবিরে আটকে রেখে নিয়মিত নির্যাতন করে লিবিয়া।
এর পরের কয়েক বছর ইতালিতে অভিবাসীদের পৌঁছানোর সংখ্যা কমে যায়; যার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল করোনাভাইরাস মহামারি। তবে ২০২২ সালে ইতালির নির্বাচনে দেশটির ডানপন্থী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জর্জিয়া মেলোনি জয় পাওয়ার পর অভিবাসীদের ইতালিতে পৌঁছানোর হার আবারও বৃদ্ধি পায়। যদিও দেশটির সরকার অভিবাসীদের ঢেউ কমিয়ে ফেলার অঙ্গীকার করেছে।
• এখন পর্যন্ত মেলোনি কী করেছেন?
তার সরকারের প্রথম কাজগুলোর একটি ছিল উদ্ধারকারী জাহাজের জন্য বিতর্কিত আইন প্রবর্তন করা। এসব উদ্ধারকারী জাহাজ অভিবাসীদের জন্য ডি-ফ্যাক্টো ট্যাক্সি পরিষেবা হিসাবে কাজ করে। কিন্তু এই উদ্ধারকারী জাহাজগুলোর সমুদ্রে অবস্থানের সময় সীমিত করার চেষ্টা করেন মেলোনি।
দেশটির সরকার জাহাজগুলোর মিশনের ব্যয় নিজেদেরকে পরিশোধ করে দূরবর্তী বন্দরে নোঙ্গর করতে বাধ্য করে। মেলোনির সরকারের এই পদক্ষেপ উদ্ধারকারী জাহাজের কার্যক্রম মারাত্মকভাবে সীমিত করে ফেলে। তারপরও অভিবাসীরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) লিবিয়ার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন মেলোনি। ২০১৬ সালে তুরস্কের সাথে ইইউর স্বাক্ষরিত চুক্তির আদলে নতুন করে লিবিয়ার সাথে চুক্তির ওই আহ্বান জানান তিনি।
চুক্তি অনুযায়ী, আঙ্কারাকে শরণার্থীদের ভরণ-পোষণের অর্থপ্রদান করে ব্রাসেলস এবং অভিবাসীদের ইউরোপে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগও নেওয়া হয়। তবে অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের চুক্তির কোনও সম্ভাবনা নেই।
এদিকে, মেলোনি ও তার মন্ত্রীরা ইতিমধ্যে লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া এবং মিসর সফর করেছেন। তাদের এই সফরের লক্ষ্য ছিল দেশগুলোর সাথে অভিবাসনসহ বিভিন্ন ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর করা।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন