যেভাবে ২৪০ মিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য গড়লেন এক স্বৈরশাসকের মেয়ে

জিবিনিউজ24ডেস্ক//  

উজবেকিস্তানের সাবেক স্বৈরশাসক ইসলাম কারিমোভার মেয়ে গুলনারা কারিমোভা। যিনি নিজেকে পপ তারকা এবং কুটনীতিক হিসেবে পরিচয় দেন। লন্ডন থেকে ২৪০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে হংকংয়ে বিশাল এক সম্পদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। 

গুলনারা কারিমোভা এই অর্থ দিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি আর ব্যক্তিগত বিমান ক্রয় করেছেন। এই সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে তিনি ব্রিটেনের কোম্পানি ব্যবহার করেছেন। তার এই অর্থের উৎস্য ছিল ঘুষ এবং দুর্নীতি। মানবাধিকার সংস্থা ফ্রিডম ফর ইউরেশিয়ার এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই কাজের জন্য লন্ডন এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের কিছু অ্যাকাউন্টিং ফার্ম সহায়তা করেছে তাকে। এর ফলে অবৈধ সম্পদ মোকাবিলায় ব্রিটেনের প্রচেষ্টাকে আবারো নতুন করে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। বিদেশি অপরাধীরা যেভাবে ব্রিটেনের সম্পদ ব্যবহার করে অর্থ পাচার করছে সেটি বন্ধের জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা ফ্রিডম ফর ইউরেশিয়া বলছে, কারিমোভা যত সহজে যুক্তরাজ্যের সম্পদ অর্জন করেছে তা আসলেই ‘উদ্বিগ্ন’ হওয়ার মতো। এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে, যারা সম্পদ পাচারের জন্য এসব কোম্পানির হয়ে যারা কাজ করছিল তারা গুলনারা কারিমোভার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি জানতো না। এমনকি অর্থের উৎস যে সন্দেহজনক হতে পারে সেটিও তাদের ধারণা ছিল না। ব্রিটেনের যারা এই সেবা দিয়েছে তাদের কারো বিরুদ্ধেই তদন্ত বা জরিমানা করা হয়নি।

dhakapost

লন্ডন থেকে ২৪০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে হংকংয়ে বিশাল এক সম্পদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন গুলনারা কারিমোভা

একটা সময় মনে হয়েছিল গুলনারা কারিমোভা তার বাবা ইসলাম কারিমোভার উত্তরসূরী হবেন। ইসলাম কারিমোভা ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু করে ২০১৬ সালে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

গুলনারা কারিমভকে ‘গুগুশা’ নামে বিভিন্ন পপ ভিডিওতে দেখা গেছে। এছাড়া তিনি একটি গয়নার দোকান চালিয়েছেন এবং স্পেনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর ২০১৪ সালে তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। পরে জানা যায়, তার বাবা ক্ষমতায় থাকার সময়েই তিনি দুর্নীতির দায়ের গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার বাবা মারা যাওয়ার পরে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। ২০১৯ সালে গৃহবন্দীর শর্ত ভাঙার কারণে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

গুলনারা কারিমভের বিরুদ্ধে প্রসিকিউটররা অভিযোগ আনেন, তিনি একটি অপরাধী গোষ্ঠীর সাথে জড়িত; যারা ব্রিটেন, রাশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ১২টি দেশে এক বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফেলো এবং ফ্রিডম ফর ইউরেশিয়ার একজন গবেষক টম মেইনি বলেন, কারিমোভার ঘটনাটি সর্বকালের সবচেয়ে বড় ঘুষ আর দুর্নীতির ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। যদিও কারিমোভা আর তার সহযোগীরা এরই মধ্যে কিছু সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছেন, যেগুলো দুর্নীতির অর্থ দিয়ে অর্জিত হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

ফ্রিডম ফর ইউরেশিয়া সম্পদ ও ভূমি রেজিস্ট্রি রেকর্ড নিয়ে গবেষণা করে অন্তত ১৪টি সম্পদের উল্লেখ পেয়েছে; যা তিনি গ্রেফতার হওয়ার আগে যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, দুবাই এবং হংকংসহ বিভিন্ন দেশে সন্দেহজনক তহবিল ব্যবহার করে কিনেছিলেন।

আগামী ১৪ মার্চ এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে, যার শিরোনাম ‘উজবেক রাজকুমারীর ক্ষমতার পেছনে কারা ছিল?’ এই প্রতিবেদনে লন্ডন ও এর আশপাশের পাঁচটি সম্পদের বিবরণ দেয়া হয়েছে, যেগুলোর বর্তমান মূল্য ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড। এর মধ্যে রয়েছে বাকিংহাম প্যালেসের পশ্চিম দিকে বেলগ্রাভিয়াতে তিনটি ফ্ল্যাট, মেফেয়ারে বাড়ি এবং ১৮ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সারে ম্যানর হাউস যার সাথে একটি ব্যক্তিগত লেকও রয়েছে।

dhakapost

গবেষক টম মেইনি বলেন, কারিমোভার ঘটনাটি সর্বকালের সবচেয়ে বড় ঘুষ আর দুর্নীতির ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম

বেলগ্রাভিয়ার দু’টি ফ্ল্যাট ২০১৩ সালে কারিমোভা গ্রেফতার হওয়ার আগে বিক্রি করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে মেফেয়ারের বাড়ি, সারে ম্যানশন এবং বেলগ্রাভিয়াতে তৃতীয় ফ্ল্যাটটি জব্দ করা হয় গুরুতর জালিয়াতির অভিযোগে।

ফ্রিডম ফর ইউরেশিয়ার প্রতিবেদনে লন্ডন এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে কয়েকটি ফার্মের নাম উল্লেখ করা হয়, যেগুলো কারিমোভা বা তার সহযোগীরা সম্পদ বা ব্যক্তিগত জেটলাইনার কেনার প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করেছিল।

কারিমোভার প্রেমিক রুস্তম মাদুমারভ এবং আরও কয়েকজন যারা তার সন্দেহভাজন সহযোগী তাদেরকে দাপ্তরিক নথিতে ‘সুবিধাভোগী মালিক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি একটি আইনি শব্দ যা ব্যবহার করা হয়েছে আসলে যে ব্যক্তি যুক্তরাজ্য, জিব্রাল্টার এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে থাকা কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে তাকে বোঝাতে।

কিন্তু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা আসলে কারিমোভার ছায়া হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যারা এসব ফার্ম ব্যবহার করে কোটি কোটি ডলার পাচার করেছে।

কারিমোভার সাথে সংশ্লিষ্ট যুক্তরাজ্যের দুটি কোম্পানি পানালি লিমিটেড এবং ওডেনটন ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডকে হিসাবরক্ষণ বিষয়ক সহায়তা দিতো এসএইচ ল্যান্ডেস এলএলপি নামে একটি ফার্ম, যা আগে লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে ছিল।

২০১০ সালের জুলাইয়ের শেষের দিকে, এসএইচ ল্যান্ডস আরেকটি কোম্পানি রেজিষ্টার বা অধিগ্রহণ করে। এর লক্ষ্য ছিল ৪০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ব্যক্তিগত জেট কেনা; যার মালিক ছিলেন মাদুমারভ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, কারিমোভা আসলে এই কেনাকাটার পেছনে ছিলেন। যখন তহবিলের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞস করা হয় তখন এসএইচ ল্যান্ডস জানায়, ‘আমরা মনে করি এই ব্যক্তিগত সম্পদ নিয়ে যে প্রশ্ন এসেছে তা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।’ এই প্রশ্ন এসেছে কারণ জেট কেনার জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল তা মাদুমারভের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দেয়া হয়নি।

dhakapost

২০০৪ সালেও মস্কো টাইমস অভিযোগ তোলে, কারিমোভা উজদোনরোবিতা থেকে জাল রশিদের মাধ্যমে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছেন

লন্ডন ভিত্তিক ফার্মটি অবশ্য পরে জানায়, মাদুমারভের সম্পদ আংশিকভাবে এসেছে উজবেকিস্তানের একটি মোবাইল ফোন কোম্পানি উজদোনরোবিতা থেকে। এই কোম্পানির সাথে কারিমোভার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। ২০০৪ সালেও মস্কো টাইমস এক প্রতিবেদনে অভিযোগ তোলে, কারিমোভা উজদোনরোবিতা থেকে জাল রশিদের মাধ্যমে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছে। সাবেক এক উপদেষ্টা কারিমোভার বিরুদ্ধে ‘প্রতারণার’ অভিযোগ তোলেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যেহেতু এটা উজবেকিস্তানের মতো একটি দেশ যেখানে অর্থপাচার জবাবদিহিতার সম্ভাবনা কম সেখান থেকে এতো বড় অংকের অর্থের হস্তান্তর বিষয়ে এসএইচ ল্যান্ডসের উচিত ছিল এই ‘সুনির্দিষ্ট গ্রাহক সম্পর্কে তদন্ত করা। এর পটভূমি খতিয়ে দেখার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করা যে, তহবিল আইনসঙ্গত ছিল এবং এটি কোন অপরাধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করা হয়নি।

এসএইচ ল্যান্ডেস পানালি লিমিটেডের ২০১২ অর্থবছরের আর্থিক বিবৃতিও জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে কারিমোভার ঘনিষ্ঠ এক সহযোগী সেগুলোর অনুমোদন দিয়েছিল যার নাম গায়ান আভাকিয়ান এবং তখন তার বয়স ছিল ৩০ বছর।

এর আগের বছর বিবিসি একটি অভিযোগ প্রকাশ করেছিল যেখানে বলা হয়েছিল, উজবেকিস্তানে কয়েক মিলিয়ন ডলার জালিয়াতি এবং দুর্নীতি কেলেঙ্কারির’ কেন্দ্রে থাকা জিব্রাল্টারে নথিবদ্ধ তাকিলান্ট নামে একটি কোম্পানির মালিক ছিলেন আভাকিয়ান।

বিবিসিকে দেয়া এক বিবৃতিতে স্টিভেন ল্যান্ডস বলেন, এসএইচ ল্যান্ডস এলএলপি কখনোই গুলনারা কারিমোভার সাথে সংযুক্ত ছিল না। এসএইচ ল্যান্ডস এলএলপি রুস্তম মাদুমারভের পক্ষে কাজ করে।

‘এসএইচ ল্যান্ডস এলএলপি তার সব গ্রাহকদের পক্ষেই কাজ করে এবং যথাযথ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে এবং এটি যথাযথ মূল্যায়িত।’ ফ্রিডম ফর ইউরেশিয়ার টম মেইনি বলেন, যত সহজে কারিমোভা যুক্তরাজ্যে এতো সম্পদ কিনেছেন তা আসলেই উদ্বেগজনক।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন