রাজু আহমেদ। কলামিস্ট। |
স্যার’কে কেন্দ্র করে জাতি দ্বি-খন্ডিত হয়নি; তিন-খন্ড হয়েছে! আমলাদের কেউ স্যার বলতে হবে না-এমন যুক্তি দেয়নি এবং শিক্ষকদের কেউ স্যার ডাকবোই এমন দৃঢ়তাও দেখায়নি। তবে সবচেয়ে সুখে আছে তিন নম্বর দল! তাঁরা দু’গ্রুপের বাকবিতন্ডা দেখে মহাখুশি! এই শালাদের দু’গ্রুপের জন্যই রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধার খর্বিত অংশ তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে-জনতার মত! আমলারা সবার নাকের ডগায় ছড়ি ঘোরাচ্ছে এবং শিক্ষকরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেটে বাধ্য করছে-এটাও জনতার মত! আমলা এবং শিক্ষক-কারো বেতনই হালাল হচ্ছে না-এহেন ফতুয়া দেয়া লোকের সংখ্যা এদেশে প্রায় পঞ্চাশ কোটি! বিশ্বাস না হলে আপনি গণনা করতে শুরু করেন।
গুটিসংখ্যক আমলা ছাড়া বেশিরভাগের সন্তানরা বাবা-মায়ের পরিচয়ের হামভরা দেখায়। যে সকল মনীষীর পরিবারের চর্চা প্রচলিত রীতি-সংস্কারের উর্ধ্বে তাদের সন্তানরা নিজ যোগ্যতায় মানুষ হচ্ছে; বড় বড় মানুষ হচ্ছে। কেউ কেউ তাঁর পদ-চেয়ারকে এমনভাবে ব্যবহারে করছে যেন আশেপাশের মানুষগুলোকে মশামাছি তুল্য মনে হয়। আবার কেউ কেউ এমন আছেন, যাদের সাথে দু’দন্ড আলাপ করতে পারা, পরিচিত হওয়া মহান সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাঁরা তাদের কর্ম ও সততায় সমাজে আলো ছড়াচ্ছেন।
শিক্ষক জাতি বিনির্মানের কারিগর। তবে এমন শিক্ষকের কী এই সমাজে অভাব যারা শিক্ষক না হয়ে দালালদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হলে জাতি ধ্বংস থেকে রক্ষা পেত। আদর্শবান শিক্ষকদের সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে নিম্নগামী। নয়তো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ চুকানো হর্তা-কর্তারা সুযোগ পেয়েই সর্বপ্রথম ছুড়ি শিক্ষকদের স্বার্থেই কেন মারেন? শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে দলাদলি দেখেছে, রাজনীতির ফায়দা কুড়িয়ে বিপক্ষকে দমন করতে দেখেছে, ক্লাসে কম পড়িয়ে অন্যরুমে পড়ার নিমন্ত্রন জানাতে দেখেছে!
যে কর্মকর্তার মেয়ে স্কুলের ক্লাসরুমে ঝাড়ু দিতে নারাজি হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জনগণকে তাঁর মায়ের দাপট জানিয়েছেন এবং মাও সেখানে ক্ষমতার মশাল উঁচিয়ে অংশগ্রহন করেছে কিংবা যে শিক্ষক বাবা তাঁর ব্যক্তিগত ইগোকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছোট্ট মেয়েটিকেও আন্দোলনে নামিয়েছে-অপরাধ কার থেকে কার কম, এই বিচার করার সক্ষমতা সাধারণ মানুষ হারিয়েছে। তবে এটুকু স্পষ্ট হচ্ছে, যে বাতাস বইছে তা অনেকটা উন্নত দেশের সংস্কৃতি নিয়ে আসবে। আপনি-তুমি-তুই কিংবা সেবা দাতা এবং সেবা গ্রহীতার যে কেউ যে কাউকে ইচ্ছা হলে স্যার ডাকতে পারবে-আর বাধ্য করা যাবে না। যতোটুকু যাবে না তার চেয়ে বেশি এটা আর উচিত হবে না!
এখন আমলাদের স্যার ডাকা যাবে না-এ আন্দোলন প্রবল হচ্ছে। কিছুদিন পর শ্রেণিকক্ষেও আর শিক্ষক-শিক্ষিকাকেও স্যার ডাকতে পারবো না-শিক্ষার্থীদের থেকে এমন আওয়াজ উঠবে। মুলত, স্যার ডাকা কিংবা না ডাকায় সমস্যা না। মূল সমস্যা হচ্ছে, একজন আরেকজনকে অধীন মনে করছে এবং অন্যজন যে অধীনতা দেখিয়ে দিচ্ছে। কে বড়-কে ছোট কিংবা যদি সমকক্ষ হয় তবে একজন আরেকজনকে কেন স্যার ডাকতে বাধ্য হবে?-প্রশ্ন এটাই। যারা স্যার ডাক শুনতে চান কিংবা অন্যকে বাধ্য করতে চান তারা কি সমকক্ষ কিংবা অধীন কাউকে স্যার ডাকতে অভ্যস্থ? আমাদের সংস্কৃতিতে, আমরা কেবল শুনতে অভ্যস্থ; বলতে নই! যে স্যার ডাকতে চায় না তাকে দু’বার স্যার ডাকুন। তৃতীয়বার থেকে আজীবন সেই স্যার ডাকবে!
সংবিধানে যা আছে তা স্যার/কর্মকর্তা সাব্যস্ত করে না বরং নিজেকে যা মনে করতে নির্দেশ করে তা আমরা যে হাবভাব নিয়ে চলি এবং যে ভাষায় সেবাগ্রহীতাকে স্বাগত জানাই তারা বিপরীত।। বিভিন্ন সময়ে যে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে জনাব, স্যার, মহোদয়, ম্যাডাম এইরূপ সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে; কখনোই বাধ্যতামূলক করা হয়নি। কিছু কিছু সম্বোধন মনের ভাষা থেকে আগত যা আসলে বাধ্য করে আদায় করা যায় না। তবে অফিশিয়াল সৌন্দর্যের জন্য স্যার/ম্যাডাম ডাকলে কারো জাত অজাতে ছুঁইবে এমন ধারনা না থাকুক।
মনে হচ্ছে, বর্তমান সময়ে যতগুলো সংকট তার মধ্যে স্যার সম্বোধন কেন্দ্রিক জটিলতা সবচেয়ে তুচ্ছ এবং হাস্যকার ব্যাপার। অথচ এটাতেই রঙচঙ মাখানো হচ্ছে বেশি। কার বিরুদ্ধে কাকে দাঁড় করানো হচ্ছে? লাভ কী? এতে আন্দোলনকারী এবং অভিযুক্ত কারোরই ওজন বাড়ছে না বরং হুহু করে কমছে। কারো সামনে স্যার বলা কিংবা না বলার চেয়ে পেছনে চৌদ্দগুন বেশি গালি উচ্চারিত হচ্ছে! বিশ্বাস না হলে, কর্মকর্তাদের পাগল’ ডাকতে আইন করুন। কিছু মানুষ বলবে, নাহ! পাগল ডাকতে বাধ্য করা যাবে না। ভাবছেন, এটা ভালোবেসে? মোটেই না। বরং আরও খাটো করতে!
এই দেশে শিক্ষিতজন এবং সভ্যের দাবীদাররাই নিজেদের নিরক্ষর ও অসভ্য হিসেবে পরিচয় করাচ্ছেন। হয়তো মোহে নয়তো দ্রোহে! যারা প্রকৃত নিরক্ষর ও কাজে-সাজে অসভ্য তারা হাসছে আর বলছে, আমরাই তো ভালো। এইসব কামড়া-কামড়ি আমাদের মধ্যে নাই; আমরা শুধু পশুর মাংস কাচা চিবিয়ে খাই!
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন