কোকেনের ট্রানজিট রুট বাংলাদেশ, নতুন বাজার এশিয়া

গত কয়েক বছরে কোকেনের বেশ কয়েকটি বড় চালান ধরা পড়েছে বাংলাদেশে। প্রতিটি চালানই অন্য দেশে যাচ্ছিল। সর্বশেষ চলতি মাসের শুরুতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় দুই কেজি কোকেনসহ এক ভারতীয় নারীকে আটক করেন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ওই কোকেনের গন্তব্য ছিল নয়াদিল্লি।

গত বছরের শেষদিকে কাতারে বিশ্বকাপ চলার সময় কোকেনের একটি বড় চালান আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে জব্দ হওয়া ২৫০ গ্রাম কোকেনের ওই চালানটির গন্তব্য ছিল কাতার। ফুটবল বিশ্বকাপে আসা ইউরোপ ও আমেরিকার দর্শকদের কাছে বিক্রির জন্য নেওয়া হচ্ছিল ওই কোকেন।

কোকেন বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর ও ব্যয়বহুল মাদক। ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোকেন পাচার হয়। কোকেনের চোরাকারবারিরা সারা বিশ্বে অনেক সুসংগঠিত বলে মনে করা হয়। তাই কোকেনের চালান দেশে প্রবেশ করা শুরু করার পর থেকে চিন্তায় পড়েছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তারা এ বিষয়ে একটা সার্বিক তদন্তে নেমেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গত বছর রাজধানীর খিলক্ষেত ও সর্বশেষ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জব্দ হওয়া দুটি চালানই বিদেশে পাচারের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। অর্থাৎ কোকেন বেচাকেনায় বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করা হচ্ছিল। তাই কোকেনের রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহারের পেছনে দেশের কারা কারা জড়িত এ বিষয়ে ব্যাপক খোঁজ-খবর নিচ্ছে পুলিশ। দেখা হচ্ছে বাংলাদেশেও কোকেনের কোনো বাজার আছে কি না। 

কোকেনের ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহারের একটি চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে তা সফল হচ্ছে না। ট্রানজিট রুট হিসেবে যে ব্যবহার হচ্ছে তাও নানা কারণে বলা যাচ্ছে না সরকারিভাবে। তবে সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে কোকেনের রুট হিসেবে শুধু নয়, দেশি ও আন্তর্জাতিক একটি চক্র চেষ্টা করছে বাংলাদেশে কোকেনের বাজার সৃষ্টি করতেনাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা

আপাতত স্বস্তির খবর এই যে, দেশে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, আইস ও এলএসডির মতো মাদকের চাহিদা থাকলেও কোকেনের কোনো বাজার নেই। তবে চিন্তার কারণ হলো, এভাবে চালান আসতে থাকলে অভ্যন্তরীণ বাজারে কোকেনের চাহিদা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

চলতি মাসের ৯ তারিখে শাহজালাল বিমানবন্দরে জব্দ করা ২ কেজি কোকেনের সঙ্গে যে নারীকে আটক করা হয় তার নাম সালোমে লাল রামধারি। তিনি আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের সদস্য। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আফ্রিকার দেশ বেনিন থেকে তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে কোকেনের এই চালান সংগ্রহ করেন তিনি। পরে মরক্কো থেকে কাতার হয়ে চালানটি ঢাকায় আনেন। তার পরিকল্পনা ছিল চালানটি ঢাকা থেকে নেপাল হয়ে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশেও কোকেনের বাজার সৃষ্টি করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে তিনি কাজ করছিলেন। 

ভারতীয় এই নারীর বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাটি এখন তদন্তাধীন রয়েছে। 

ডিএমপি উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, তাকে জিজ্ঞাসাবাদে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। এসব তথ্য আমরা যাচাই-বাছাই করছি।

টার্গেট এশিয়া, ট্রানজিট বাংলাদেশজাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক সংস্থার (ইউএনওডিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকে সাধারণত কোকেন উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে যায়। প্রথমে কোকেনের চালান দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে আসে। পরে এসব দেশ থেকে ওই চালান আবার উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে যায়। তবে কোকেনের নতুন বাজার হিসেবে এশিয়াকে টার্গেট করছে আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ীরা। সেই চেষ্টা থেকেই ভারত ও বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশে কোকেনের ট্রানজিট চালান আসলেও বাজার খোঁজা হচ্ছে গোটা এশিয়াজুড়ে।

ট্রানজিট রুট যে কারণে চিন্তার কারণ

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের অন্যতম প্রধান দুটি মাদক উৎপাদন ও চোরাচালানের রুট হলো গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্ট। এ দুটি রুটের মাঝে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। ফলে বিশ্বের নানা দেশ থেকে বিভিন্ন রকমের ভয়ংকর মাদক পাচার হয় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। ইতোমধ্যে দেশে আসা এসব কোকেনের চালানও এই রুটের অংশ হিসেবে ট্রানজিট ব্যবহার করে অন্য দেশে যাচ্ছিল। তবে চোরাকারবারিরা যে শুধু ট্রানজিট রুট ব্যবহার করছে তা নয় বাংলাদেশের ভেতরেও কোকেনসহ নানা রকম মাদকের বাজার তৈরির চেষ্টা করছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোকেনের ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহারের একটি চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে তা সফল হচ্ছে না। ট্রানজিট রুট হিসেবে যে ব্যবহার হচ্ছে তাও নানা কারণে বলা যাচ্ছে না সরকারিভাবে। তবে সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে কোকেনের রুট হিসেবে শুধু নয়, দেশি ও আন্তর্জাতিক একটি চক্র চেষ্টা করছে বাংলাদেশে কোকেনের বাজার সৃষ্টি করতে। তারা যদি এতে সফল হয় তাহলে দেশের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হবে।

এখনো কোকেনের বাজার সৃষ্টি হয়নি দেশে

মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র মতে, ইয়াবা কিংবা গাঁজার মতো কোকেনের বাজার নেই বাংলাদেশে। মাদক হিসেবে কোকেনের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় দেশে মাদক প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে কোনোভাবে চাহিদা সৃষ্টি হলেও এর যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া দেশে ব্যবহার হওয়া অন্যসব মাদকের চেয়ে কোকেনের দাম অনেক বেশি। তাই এই মাদকের চাহিদা দেশে সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

এ বিষয়ে ডিএনসির ঢাকা মেট্রো. কার্যালয়ের (উত্তর) সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গত কয়েক বছরে কোকেনের দুটি চালান জব্দ করেছি। এ দুই চালানের গ্রাহক বাংলাদেশ নয়। আমাদের কাছে থাকা তথ্য মতে দেশে এখনো কোকেনের বাজার সৃষ্টি হয়নি। আমরা সচেষ্ট রয়েছি, কোকেনসহ যেকোনো মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে দেশে কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান ধরা পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরে। উরুগুয়ে থেকে আসা ১০৭টি সূর্যমুখী তেলের ড্রামের মধ্যে একটি ড্রামের নমুনায় তরল কোকেন শনাক্ত হয়। জব্দ করা ৩৭০ লিটার কোকেনের মূল্য প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। ওই চালানটি যে চক্র পাঠিয়েছিল তারাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছিল।

জিবিডেস্ক //

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন