ভারতে অশ্লীলতার সাংবিধানিক সংজ্ঞা মূলত বিচারকরা কীভাবে ব্যাখা করছেন অনেকটাই তার ওপর নির্ভর করে। তবে তরুণীদের অনেকে মনে করছেন, তাদের বাকস্বাধীনতা হরণ করতে এই আইন ব্যবহার করা হয়।
বিশ্বের ফ্যাশন জগতের পরিচিত এক নাম উরফি জাভেদ। মুম্বাইয়ের নামকরা এই অভিনেত্রীকে ইন্সটাগ্রামে ৪০ লাখ মানুষ অনুসরণ করেন। টুইটারে তার ভক্ত আছে দুই লাখ। সমালোচনার মুখেও পড়েন তিনি। তার বিরুদ্ধে বিষোদগার, তিনি আঁটসাট, খোলামেলা কাপড় পরেন।
গত জানুয়ারিতে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপির) মহারাষ্ট্র প্রদেশের নেত্রী চিত্রা ওয়াগ মুম্বাই পুলিশেকে উরফির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। চিত্রার দাবি, ‘জনসম্মুখে, রাস্তায় অশ্লীলতা করছেন উরফি।’
এক টুইটে এই নারী নেত্রী বলেন, যারা মুম্বাইয়ের রাস্তায়, জনসম্মুখে শরীরকে কামুকভাবে উপস্থাপন করে চলাফেরা করেন, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এর জবাবে উরফি জাভেদ বলেন, ‘আরেক রাজনীতিবিদের কাছ থেকে পুলিশে অভিযোগ পেয়ে আমার নতুন বছর শুরু হলো। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার শরীরের গোপন অঙ্গ দেখা না যায় ততক্ষণ আপনি আমাকে জেলে দিতে পারবেন না।’
এই অভিনেত্রী বলেন, সৃষ্টিশীল হওয়ার কারণে এবং ফ্যাশন নিয়ে নিজের ভাবনার কারণে তাকে প্রায়ই ‘বেশ্যা, পর্নস্টার’ ইত্যাদিসহ নানা কথা শুনতে হয়। এমনকি কেউ কেউ তাকে মারধরের এবং ধর্ষণের হুমকিও দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
‘সময়ের সাথে সাথে অশ্লীলতার সংজ্ঞা পাল্টাচ্ছে। আর তাই এমন কাথাবার্তা আসলে আমি গুরুত্ব দিই না। কিন্তু আমি যা শিখছি তা হলো, আমাদের সমাজে সব বিষয়ই নারীর লিঙ্গে গিয়ে শেষ হয়। সবসময়ই নারীদের দোষ। পুরুষেরা যা কিছু তা-ই করতে পারে।’
• অশ্লীলতা নিয়ে ভারতের আইন
ভারতের অশ্লীলতা আইন মূলত নৈতিকতা ও ভদ্রতা বা শিষ্টাচারের বিষয় থেকেই উদ্ভব। তবে অশ্লীলতা কীভাবে নির্ধারিত হবে তা নিয়ে অবশ্য ভারতের আদালতকেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়।
দেশটির দণ্ডবিধির ২৯২ ধারায় অশ্লীলতা বলতে এমন বিষয়কে বোঝানো হচ্ছে, যা কামুকতাকে উসকে দেয়। আইনিভাবে কোনোকিছু অশ্লীল হলে তা বিক্রি, প্রকাশ বা বিতরণ করা নিষিদ্ধ। অশ্লীল অভিনয় এবং গানও দেশটির আইনে নিষিদ্ধ।
এদিকে অশ্লীলতা আইনের আওতায় এখন ডিজিটাল পরিসরও। দেশটির ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট অনুযায়ী, অনলাইনে অশ্লীল কোনও কিছু প্রকাশ বা বিতরণ করা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
দিল্লির আইনজীবী শ্রেয়া মুনোথ বলেন, ব্রিটিশ আমলে ভারতে অশ্লীলতা বিষয়ক আইন করা হয়। তিনি বলেন, বাকস্বাধীনতার বিষয়ে ভারতেই আইনে ‘নিয়ন্ত্রণমূলক ধারণা’ রয়েছে। আর অশ্লীলতাবিষয়ক আইন প্রায়ই নারীদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
‘নারীদের বিষয়ে মামলায় আদালত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পোষণ করে থাকে। আদালতের ভাবনাটি এমন যে, নারীদের দেখভালের দায়িত্ব রাষ্ট্রের।’
• অশ্লীলতা বনাম বাক স্বাধীনতা
কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে এমন ঘটনাও অবশ্য আছে। দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের মানবাধিকার কর্মী রেহানা ফাতিমার বিরুদ্ধে ২০২০ সালে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ফেসবুকে পোস্ট করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, ফাতিমার শিশু সন্তান তার অর্ধনগ্ন শরীরের ওপর কিছু আঁকছে। ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা ছিল #বডিআর্টপলিটিকস অর্থাৎ শরীর, শিল্প রাজনীতি।
যৌনতা এবং নগ্নতা নিয়ে সমাজে বিদ্যমান যে ট্যাবু তা চ্যালেঞ্জ করতেই ভিডিওটি বানানো হয়েছিল বলে জানান ফাতিমা। ফেসবুকে প্রকাশের পর ভিডিওটি নিয়ে ব্যাপক শোরগোল শুরু হয় এবং অনেকেই এটিকে ‘অশ্লীল এবং অভদ্র কাজ’ বলে আখ্যায়িত করেন।
তবে গত মাসে কেরালার আদালত ফাতিমার বিরুদ্ধে মামলাটি স্থগিত করে। একই সাথে অশ্লীলতা আইন, নৈতিকতা এবং নারী শরীর নিয়ে তীক্ষ্ণ মন্তব্য করে আদালত।
বিচারক কাউসার এদাপ্পাগাথ বলেন, নারীরা নিপীড়নের শিকার, বৈষম্যের শিকার, বিচ্ছিন্ন এবং নিজেদের শরীরে ও জীবন নিয়ে নিজেরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
শরীরের স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অংশ, ভারতের সংবিধান যার নিশ্চয়তা প্রদান করে। নগ্নতাকে ‘অশ্লীল, অভদ্র বা অনৈতিক’ হিসেবে দেখা যেতে পারে না। পুরুষের অর্ধনগ্ন শরীর স্বাভাবিকভাবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু নারীর শরীরকে দেখা হচ্ছে ভিন্নভাবে, বলেন তিনি।
অশ্লীলতার বিষয়ে ভারতের আইন নিয়ে বিচারক এদাপ্পাগাথ বলেন, সমাজের নৈতিকতা ও কিছু মানুষের মনোভাবের কারণে কোনও ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করা যায় না।
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন