মোঃ নাসির, নিউ জার্সি, আমেরিকা থেকে :অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং দিন দিন বাড়ছেই। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে একশ্রেণির মানুষ সমাজে অর্থনৈতিক শ্রেণিবৈষম্যকে আরও প্রকট করে তুলছে। এতে দেশবাসীর মধ্যে বিরাজ করছে চরম ক্ষোভ। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীরাও অর্থ পাচারের ঘটনায় ভীষণ উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। তারা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাধারণত বাংলাদেশ থেকে ১১টি দেশে অর্থ পাচার বেশি হয়ে থাকে। এই ১১ দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও ভারত। এই অর্থ পাচার কীভাবে থামবে, কীভাবে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার হবে, আদৌ হবে কি না, তার স্পষ্ট উত্তর মিলছে না। টাকা উদ্ধারের নজিরও কম। যতই দিন যাচ্ছে ততই বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক কারণেই অর্থ পাচার হয়। তার মধ্যে হতাশাজনক হলেও সত্যি, বিনিয়োগ না হওয়ায় অর্থ পাচার হচ্ছে। অর্থ পাচার করে বিদেশে ছেলেমেয়েদের স্থান করে দেওয়ার প্রবণতা সত্তরের দশক থেকেই চলে আসছে। দেশের ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশাজীবী ও রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন উপায়ে কোটি কোটি টাকা পাচার করেন। আবার বিদেশিরাও বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশিরা প্রধানত দুটি কারণে অর্থ পাচার করছে। প্রথমত, যারা অপ্রদর্শিত আয় বা কালোটাকা দেশে ভোগ করতে পারছে না, তারা বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেও বাংলাদেশিরা টাকা পাচার করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ২৭০ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা! ব্যাংকগুলোর জালিয়াতির মাধ্যমে বিগত ১০ বছরে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। বেসিক, জনতা, ফরমার্সসহ কয়েকটি ব্যাংকের নাম এ ধরনের ঘটনায় উঠে এসেছে। বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার সম্ভব হলেও অনেক পাচারকারীর প্রিয় ব্যাংক ‘সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক’। সুইস ব্যাংকের ভল্ট অত্যন্ত শক্তিশালী! কোনো রাষ্ট্র চাইলেই সেখান থেকে পাচারকারীর সঞ্চিত অর্থ ‘সহজেই’ ফিরিয়ে নিতে পারে না। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। বন্ড জালিয়াতি করেও কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গড়ে উঠেছে একটি বড় সিন্ডিকেট। তালিকায় আছে শতাধিক গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে দেশের ২১ খাতে ৪৪টি দেশের ২ লাখ ৫০ হাজার বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। এর মধ্যে কর দিচ্ছেন ৯ হাজার ৫০০ জন। বাকি ২ লাখ ৪১ হাজার অবৈধ। এরা বেতনের নামে দেশ থেকে বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করছেন, যা পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের প্রায় সমান। এর ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা। বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতের। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এবার সক্রিয় হচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তারা বলেন, তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। অন্যদিকে কিছু স্বার্থপর ও দেশপ্রেমহীন মানুষ বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তারা অবাধে দেশের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করে আরাম-আয়েশ করছে। তাই এসব দুর্বৃত্তকে প্রতিরোধে এক হচ্ছেন প্রবাসীরা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ যেসব দেশে বেশি টাকা পাচার হচ্ছে, সেসব দেশে অবস্থানরত প্রবাসীরা পাচারকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। এর মাধ্যমে তারা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে জনমত গড়ে তুলে তাদের নিবৃত্ত করতে চাইছেন। অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণেই মূলত বিদেশে অর্থ পাচার হয়। দেশে যখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির, যেখানে বিনিয়োগ অত্যন্ত মন্থর, সেখানেই টাকাওয়ালাদের উদ্বৃত্ত অর্থ বিদেশে পাচার হয়। আবার যেখানে একদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে ভৌত অবকাঠামোর অনুপস্থিতি অথবা অপ্রতুল ভৌত অবকাঠামো, সেখানে অর্থ পাচার হয়।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন