বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আরো স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দিতে পারে, এটা তাদের ইচ্ছা। চিকিৎসার জন্য বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়া প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান বলেছেন, বিদেশে চিকিৎসা নিতে হলে তাঁকে আবার জেলে যেতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, গুমের অভিযোগ, নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেন।
ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের প্রধান শতরূপা বড়ুয়া গত ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফরের সময় এই সাক্ষাৎকার নেন। সংবাদমাধ্যমটির বাংলা বিভাগের ওয়েবসাইটে গতকাল শনিবার ভিডিও সাক্ষাৎকারটি প্রচার করা হয়েছে।
কেন তাদের এই স্যাংশন, জানি না
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের মার্কিন ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরুর ঘোষণা আসে গত ২২ সেপ্টেম্বর। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার এটাই প্রশ্ন যে হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, তারা আমাদের ওপর ভিসা স্যাংশন দিতে চাচ্ছে কী কারণে? আর মানবাধিকার বা ভোটের অধিকারের কথা যদি বলে, তাহলে আমরা আওয়ামী লীগ, আমরাই তো বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করেছি। আমাদের কত মানুষ রক্ত দিয়েছে এই ভোটের অধিকার আদায় করার জন্য। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যাতে হয়, তার জন্য যত রকমের সংস্কার, সেটা আমরাই তো করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’—এই স্লোগান তো আমারই দেওয়া।
আমি এভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছি। আমাদের দেশে বেশির ভাগ সময় মিলিটারি ডিক্টেটর (সামরিক স্বৈরাচার) দেশ শাসন করেছে। তখন তো মানুষের ভোট দেওয়া লাগেনি। তারা ভোটের বাক্স নিয়ে গিয়ে শুধু রেজাল্ট ঘোষণা করে দিয়েছে। এরই প্রতিবাদে আমরা আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম করে নির্বাচন সুষ্ঠু পরিবেশে নিয়ে আসতে পেরেছি।
এখন মানুষ তার ভোটের অধিকার সম্পর্কে অনেক সচেতন। সেটা আমরা করেছি। কাজেই সেই ক্ষেত্রে হঠাৎ এই ধরনের কোনো স্যাংশন দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমরা মনে করি না।’
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, সেটা র্যাব হোক, পুলিশ বা যেটাই হোক, কেউ যদি কোনো অন্যায় করে, তাদের বিচার হয়। এই বিচারে কিন্তু কেউ রেহাই পায় না। অনেক সময় কোনো কাজ তারা অতিরিক্ত করে, করতে পারে। সে রকম হলে আমাদের দেশের আইনেই বিচার হয়। যেখানে এমন বিচার হচ্ছে, এ ধরনের ব্যবস্থা আছে, সেখানে এই স্যাংশন কী কারণে?’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর যত নির্বাচন হয়েছে, জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচন, প্রতিটি সুষ্ঠুভাবে হয়েছে বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘এসব নির্বাচনে মানুষ তার ভোট দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এই নির্বাচনগুলো নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বাস্তবতাটা কী, বাংলাদেশের মানুষ তার ভোটের অধিকার নিয়ে সব সময় সচেতন। কেউ ভোট চুরি করলে তাদের ক্ষমতায় থাকতে দেয় না।’
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ‘১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া ভোট চুরি করেছিলেন। তিনি দেড় মাসও টিকতে পারেননি। ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ জনগণের রুদ্ররোষে পড়ে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। আবার ২০০৬ সালে এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে ভোটার তালিকা তৈরি করেছিল। সেই ভোটার তালিকা দিয়ে নির্বাচন করে তিনি যখন সরকার গঠনের ঘোষণা দিলেন...এরপর ইমার্জেন্সি (জরুরি অবস্থা) জারি করা হলো। সেই নির্বাচন বাতিল হয়ে গেল। কাজেই আমাদের দেশের মানুষ এখন ভোট সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। কাজেই একটা নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, এটা তো আমাদেরই দাবি ছিল। আন্দোলন করে আমরাই সেটা প্রতিষ্ঠিত করেছি। তো আজ এখন তারা স্যাংশন দিচ্ছে, আরো দেবে, দিতে পারে। এটা তাদের ইচ্ছা।’
বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সেখানে এভাবে স্যাংশন দিয়ে মানুষকে ভয়ভীতি দেওয়া...। তো ঠিক আছে, স্যাংশন দিলে (বাংলাদেশিরা) আমেরিকা আসতে পারবে না, আসবে না। না এলে কী আসবে-যাবে? আমাদের দেশে এখন যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। কাজেই আমরা দেখি, কী করে তারা। কেন তাদের এই স্যাংশন জারি!’
বিদেশে চিকিৎসা নিতে হলে খালেদা জিয়াকে আবার জেলে যেতে হবে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ভয়েস অব আমেরিকার প্রশ্ন ছিল, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতির খবর আমরা পাচ্ছি। তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি আপনারা কি পুনর্বিবেচনা করবেন?’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জিজ্ঞেস করি, পৃথিবীর কোন দেশে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে পেরেছে? পৃথিবীর কোনো দেশ দেবে? তাঁদের যদি চাইতে হয়, আদালতে যেতে হবে। আদালতের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এখানে আমাদের কোনো আদালতের কাজের ওপর হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই।’
একই প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তবে হ্যাঁ, যেটুকু করতে পেরেছি তাঁর জন্য, সেটা হচ্ছে, আমার যেটুকু সরকার হিসেবে ক্ষমতা আছে, সেখানে তাঁর সাজাটা স্থগিত করে তাঁকে বাড়িতে থাকার পারমিশন দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা...। তিনি নিজেই চিকিৎসা নিচ্ছেন এখন। বাংলাদেশের সবচেয়ে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর যদি তাঁদের যেতে হয় বাইরে, তাহলে এখন যে তাঁকে আমি বাসায় থাকার পারমিশনটা দিয়েছি, এটা উইথড্র (প্রত্যাহার) করতে হবে। তাঁকে আবার জেলে যেতে হবে এবং কোর্টে যেতে হবে। কোর্টের কাছে আবেদন করতে হবে। কোর্ট যদি রায় দেন, তখন তিনি যেতে পারবেন। এটা হলো বাস্তবতা।’
গুমের অভিযোগ জাতিসংঘ নিজে তদন্ত করে না কেন?
বাংলাদেশে গুম নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, অহেতুক মিথ্যা অপবাদ দেওয়া কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, ‘এ রকম অভিযোগ অনেকে অনেক কিছু দেয়, কিন্তু তার কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। কোনো নাম দিতে পারে না, কোনো কিছুই দিতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায়, বলা হচ্ছে অমুক লোক নাই কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সে ঠিকই জীবিত আছে। আবার কেউ অনেক সময় নিজেরাই পালায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘যেখানে এতগুলো নাম দেওয়া হলো, তার মধ্যে কয়েকটা ঘটনাই পাওয়া গেছে সত্য। সেগুলোর সম্পর্কে ঠিকই রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। আর রিপোর্ট দেওয়া হলো না কেন নিজেরা তারা তদন্ত করে দেখুক। নিজেরা তদন্ত করে না কেন, সেটাই তো আমার প্রশ্ন। সেটা করুক।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফেরত যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার দাবি করে আসছে বিএনপিসহ বিরোধী কিছু রাজনৈতিক দল। এ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ ব্যবস্থায় ফেরত যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেনই বা আমরা আলোচনা করব?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন, এটা হচ্ছে জনগণের ভোটের অধিকার। যখন ২০০৭ সালে ইমার্জেন্সি ঘোষণা হলো, এরপর কিন্তু উচ্চ আদালতে রায় ছিল যে বাংলাদেশে আর কোনো অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসতে পারবে না। একটা নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে আরেকটা নির্বাচিত সরকারই আসতে হবে।’
সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাজা কমানো হয়েছে
নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নতুন আইন দেশের মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ দমনের স্বার্থে এবং মানবাধিকার সুরক্ষিত করার জন্যই করা হয়েছে। আগের আইনটি নিয়ে আপত্তি থাকায় আমরা তা বাতিল করেছি। সবার কথাই রাখা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের আইনগুলো দেখে আগের আইন সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে। সাজাও কমানো হয়েছে।’
রোহিঙ্গারা ছয় বছর ধরে আছে, আর কত?
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আন্তর্জাতিকভাবে সবাইকে বলেছি যে অন্তত একটি ব্যবস্থা নিন যেন তারা নিজের দেশে ফিরে যেতে পারে। জাতিসংঘ কিংবা অন্যান্য এনজিও, যারা এখন সহযোগিতা করছে তারা তো সেটা ওখানেও দিতে পারে। আমাদের যেহেতু প্রতিবেশী, তাদের সঙ্গে একটা আলোচনা করে যাচ্ছি। তাদের আমরা বোঝানোর চেষ্টা করছি যে আপনাদের নাগরিক আপনারা ফেরত নিয়ে যান। এ পর্যন্ত চলছে তো চলছেই। প্রায় ছয় বছর হয়ে গেল, আর কত?’
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন