যত চ্যালেঞ্জই আসুক, নিজেদের ভূমি ছাড়ব না : ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট

মিসরের রাফা সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত গাজায় অবশেষে ঢুকেছে ওষুধ ও খাদ্যসহ জরুরি ত্রাণবাহী ২০টি ট্রাক। গতকাল শনিবার সীমান্ত পেরিয়ে গাজায় প্রবেশ করা এই ট্রাকগুলোর অন্তত একটি পূর্ণ ছিল লাশ রাখার কফিনে। জাতিসংঘ বলছে, প্রয়োজনের তুলনায় এ সহায়তা অতি নগণ্য। এদিকে হামাস শুক্রবার রাতে প্রথমবারের মতো দুই মার্কিন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে।

তবে তারপরও গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলা অব্যাহত রয়েছে। 

 

ইসরায়েলি হামলায় গাজাজুড়ে নিরন্তর রক্তপাতের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গতকাল বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা নিজের ভূমি ছাড়বে না। ইসরায়েল ও গাজার কট্টরপন্থী শাসক হামাস গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা কমানোর লক্ষ্যে গতকাল মিসরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি এ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। 

গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাকের প্রবেশ
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গতকাল রাফা ক্রসিং দিয়ে গাজায় প্রবেশ করেছে ত্রাণবাহী ২০টি ট্রাক।

এগুলোসহ বহুসংখ্যক জরুরি সহায়তাসামগ্রী বোঝাই ট্রাক ক্রসিংয়ের মিসর প্রান্তে বেশ কয়েকদিন ধরেই অপেক্ষা করছিল। গাজায় অবস্থিত জাতিসংঘের গুদামে নেওয়ার পর ওষুধ, পানি ও খাদ্যের অভাবে দুর্বিষহ কষ্টে থাকা গাজাবাসীর মধ্যে বিতরণের কথা রয়েছে। 

 

২০ ট্রাক সহায়তাকে ‘সাগরের মধ্যে এক বিন্দু পানির সমতুল্য’ আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘ বলেছে, গাজার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে দৈনিক ত্রাণবাহী ১০০টি ট্রাক প্রয়োজন।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষও বলেছে, গাজায় যে পরিমাণ ত্রাণ পৌঁছেছে, তা দিয়ে বর্তমান মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলা সম্ভব নয়।

এছাড়া ইসরায়েল বলেছে, শুধু দক্ষিণ গাজায় এ ত্রাণ বিতরণ করা যাবে। দৃশ্যত উত্তরে এখনো থেকে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের চাপে ফেলতেই এ অবস্থান নিয়েছে ইসরায়েল। তবে উত্তরের অনেকেই বলেছে, তারা দক্ষিণে যাবে না। কারণ কোন জায়গাই নিরাপদ নয়।

 

ইসরায়েলের অনুমতি সাপেক্ষে গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের সময় রাফা ক্রসিংয়ে উপস্থিত ছিলেন বিবিসির সাংবাদিক রুশদি আবু আলউফ।

তাঁর দেখা একটি ট্রাকে ছিল মৃতদেহ রাখার কফিন। বাকিগুলোতে ছিল পানি, খাদ্য ও ওষুধ। তবে কোনো ট্রাকেই জ্বালানি তেল ছিল না। কারণ ইসরায়েল জ্বালানি প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। 

 

ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো গাজায় প্রবেশের সময় সীমান্তের মিসর অংশে লোকজনকে উল্লাস করতে দেখা যায়। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, শনিবার যে পরিমাণ ত্রাণ গাজায় প্রবেশ করেছে, তা দিয়ে দৈনিক প্রয়োজনের মাত্র ৩ শতাংশ পূরণ সম্ভব হবে। জ্বালানি প্রবেশ করতে না দেওয়ার বিষয়টি রোগী ও আহতদের ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠবে। আলো ছাড়াও হাসপাতালের বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র চালানোর জন্য জেনারেটরের তেল খুবই জরুরি এখন। 

সমাধানের আহ্বান আন্তর্জাতিক মহলের
কায়রোর শান্তি সম্মেলনে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া ও জাপানের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। তবে লক্ষ্যণীয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ইরানের কোনো প্রতিনিধি এতে অংশ নেননি।

ইসরায়েলের অব্যাহত বোমা হামলা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা গাজার বাইরে স্থানান্তর মেনে নেবে না উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, ‘আমরা কখনোই স্থানান্তর মেনে নেব না। যত চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন, আমরা নিজেদের ভূমিতেই থাকব।’

আব্বাস আরো বলেন, ‘আমরা পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে নিজের ঘরবাড়ি থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের বিরোধিতা করছি।’

ইসরায়েলের উত্তর গাজা থেকে দশ লাখের বেশি অধিবাসীকে দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশের মধ্যে অনেকেই অতীতে ফিলিস্তিনিদের গণহারে উচ্ছেদ করে ভূমি দখলের মিল দেখতে পাচ্ছেন। উত্তর গাজার ফিলিস্তিনিরা সরে গেলে ইসরায়েল তা স্থায়ীভাবে দখলে নেবে—এমন কথাও বলাবলি হয়েছে। তবে দৃশ্যত মার্কিন চাপের মুখে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, এমন কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।

হাসপাতাল, স্কুল ও আশ্রয়শিবিরে বিমান হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে সম্ভাব্য সব ধরনের মানবিক আইন লঙ্ঘন করেছে মন্তব্য করে প্রেসিডেন্ট আব্বাস বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই এই নৃশংস আগ্রাসন বন্ধ করতে এবং মানবিক করিডর খুলে দেওয়ার কথা বলে আসছি।’

ফিলিস্তিনিদের মূলধারার প্রধান দল পশ্চিম তীরের শাসকগোষ্ঠী ফাতাহ পার্টির নেতা আব্বাস বলেন, ‘আমরা উভয় পক্ষের বেসামরিক লোকজনকে হত্যার বিরোধিতা করছি এবং জিম্মি হওয়া বেসামরিক লোকজনকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা সহিংসতার বিরুদ্ধে এবং জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য শান্তিপূর্ণ ও আইনি পন্থা অবলম্বনের পক্ষে।’

সংকট সমাধানে ফিলিস্তিনিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানিয়ে বক্তব্যের শেষ দিকে মাহমুদ আব্বাস তিনবার বলেন, ‘আমরা (ভূমি ছেড়ে) যাব না।’

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তাঁর বক্তব্যে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ‘মানবিক যুদ্ধবিরতির’ আহ্বান জানান।

ফিলিস্তিনি ভূমিতে ৫৬ বছরের ইসরায়েলি দখলদারির কোনো অবসান দেখা যাচ্ছে না মন্তব্য করে গুতেরেস বলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের অভিযোগগুলো বৈধ। তবে কোনো কিছুই বেসামরিক ইসরায়েলিদের ওপর হামাসের হামলাকে ন্যায্যতা দিতে পারে না।
অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু ও দুর্দশা নিয়ে ‘বৈশ্বিক নীরবতার’ নিন্দা জানিয়েছেন তিনি।

মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতেহ আল সিসি বলেছেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের একমাত্র সমাধান হচ্ছে ন্যায়বিচার। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের বৈধ অধিকার সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে এবং তাদের নিজের ভূমিতে স্বাধীন রাষ্ট্র হতে হবে।

এ ছাড়া ইতালির ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ও গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কাইরিয়াকস মিতসোতাকিস সংকট নিরসনে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছেন।

জর্জিয়া মেলোনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গাজার যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে হবে এবং দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের পথনকশা তৈরি করতে হবে।

ইসরায়েলের পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক নতুন শান্তিপ্রক্রিয়া চালুর আহ্বান জানিয়ে কাইরিয়াকস মিতসোতাকিস বলেন, সামরিক হস্তক্ষেপ কার্যকর রাজনৈতিক সমাধানের বিকল্প হতে পারে না।

দুই মার্কিন জিম্মির মুক্তি
৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে গাজায় জিম্মি থাকা দুই মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে হামাস। এটাই হচ্ছে হামাসের এবারের হামলার পর জিম্মি মুক্তির প্রথম ঘটনা। মুক্তি পাওয়া দুজন হলেন জুডিথ রানান (৫৯) এবং তাঁর  মেয়ে নাটালি রানান (১৮)। শুক্রবার রাতে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁরা ইসরায়েল পৌঁছেছেন। হামাসের মুখপাত্র আবু ওবাইদা বলেছেন, কাতারের মধ্যস্থতায় মানবিক কারণে দুই মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল মন্তব্য করেছে, কাতারের মধ্যস্থতা ছাড়াও তাদের ইসরায়েলি বাহিনীর সামরিক শক্তির চাপ এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

জিবিডেস্ক //

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন