আবু আব্দুল্লাহ আব্দুল হালীম বিন মোহাম্মাদ।|
تالف: أبو عبد الله عبد الحليم بن محمد موحی الدین
ভূমিকা :
إِنَّ الْحَمْدُ للهِ، نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا ، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ ، وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلاَ هَادِيَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
নিশ্চয় যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য। আমরা তারই প্রশংসা করি, তার কাছে সাহায্য চাই, তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। আল্লাহর নিকট আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্টতা ও আমাদের কর্মসমূহের অকল্যাণ থেকে আশ্রয় কামনা করি। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দেন, তাকে গোমরাহ করার কেউ নেই। আর যাকে গোমরাহ করেন তাকে হিদায়াত দেওয়ারও কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকার ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোনো শরীক নেই। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সালাত ও সালাম নাযিল হোক তাঁর ওপর, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবীদের ওপর এবং যারা কিয়ামত অবধি ইহসানের সাথে তাদের অনুসরণ করেন তাদের ওপর।
মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهۡدِيَنَّهُمۡ سُبُلَنَاۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٦٩ ﴾ [العنكبوت: ٦٩]
অর্থাৎ “যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথসমূহে পরিচালিত করব। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গেই থাকেন।” (সূরা আনকাবূত ৬৯ আয়াত)
@ جهاد ও مجاهدة
এর আসল অর্থ দ্বীনের পথে বাধা বিপত্তি দূর করার জন্যে পূর্ণ শক্তি ব্যয় করা। এখানে এ নিশ্চয়তা দান করা হচ্ছে যে, যারা আল্লাহর পথে আন্তরিকতা সহকারে পূর্ণ শক্তি ব্যয় করবে তাদেরকে মহান আল্লাহ তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেন না। বরং তিনি তাদেরকে পথ দেখান এবং তাঁর দিকে যাওয়ার পথ তাদের জন্য খুলে দেন। তারা তাঁর সন্তুষ্টি কিভাবে লাভ করতে পারে তা তিনি প্রতি পদে পদে তাদেরকে জানিয়ে দেন। এই আয়াতের তফসীরে ফুদাইল ইবন আয়াদ বলেন, যারা বিদ্যার্জনে ব্ৰতী হয়, আমি তাদের জন্য আমলও সহজ করে দেই। [বাগভী]
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার সঙ্গে থাকা দু ধরনের। এক. মুমিন, কাফির নির্বিশেষে সবার সঙ্গে থাকার অর্থ হচ্ছে তাদের সম্পর্কে পরিপূর্ণ জানা, তাদেরকে পর্যবেক্ষনে রাখা ও নিয়ন্ত্রণ করা। দুই. মুমিন, মুহসিন, মুত্তাকীদের সাথে থাকা। তাদের সঙ্গে থাকার অর্থ হচ্ছে, তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের হেফাযত করা। তাছাড়া তাদের সম্পর্কে জানা, দেখা, পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্ৰণ তো আছেই। তবে এটা অবশ্যই ঈমান রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ তাঁর আরাশের উপরেই আছেন।
@অর্থাৎ, যারা আমার (সন্তুষ্টির পথে) দ্বীনের উপর আমল করতে কষ্ট, পরীক্ষা এবং সমস্যার সম্মুখীন হয়।
এর অর্থ হল, দুনিয়া ও আখেরাতের ঐ সকল পথ, যে সকল পথে চললে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়।
'ইহ্সান'-এর অর্থ হল, 'আমি যেন আল্লাহকে দেখছি অথবা আল্লাহ আমাকে দেখছেন' মনে করে প্রত্যেক সৎ কাজ আন্তরিকতার সাথে সম্পাদন করা। নবী (সাঃ)-এর তরীকা অনুযায়ী সে কাজ সম্পাদন করা। মন্দের প্রতিশোধে মন্দ না করে ভালো ব্যবহার প্রদর্শন করা। নিজের প্রাপ্য অধিকার ছেড়ে দেওয়া এবং অন্যকে তার অধিকার অপেক্ষা অধিক দেওয়া। এই সকল কর্ম 'ইহ্সান' (সৎকর্মপরায়ণতা)র অন্তর্ভুক্ত।
@আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীদের দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সঃ), তাঁর সাহাবীবর্গ এবং তাঁর অনুসারীদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রামকারীদেরকে অবশ্যই আমি আমার পথে পরিচালিত করবো।' হযরত আবূ আহমাদ আব্বাস হামাদানী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ যারা নিজেদের ইলম অনুযায়ী আমল করে, আল্লাহ তাদেরকে ঐ সব বিষয়েও সুপথ প্রদর্শন করবেন যা তাদের ইলমের মধ্যে নেই।
আবু সালমান দারানী (রঃ)-এর সামনে এটা বর্ণনা করা হলে তিনি বলেনঃ যার অন্তরে কোন কথা জেগে ওঠে, যদিও তা ভাল কথাও হয়, তবুও ওর উপর আমল করা ঠিক হবে না যে পর্যন্ত না কুরআন ও হাদীস দ্বারা ওটা প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয়ে গেলে ওর উপর আমল করতে হবে এবং আল্লাহর প্রশংসা করতে হবে যে, তিনি তার অন্তরে এমন কথা জাগিয়ে দিয়েছেন যা কুরআন ও হাদীস দ্বারাও সাব্যস্ত হয়ে গেছে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে রয়েছেন।
হযরত ঈসা (আঃ) বলেনঃ “ইহসান হচ্ছে ওরই নাম যে, যে তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করে তুমি তার সাথে সদ্ব্যবহার কর। যে সদ্ব্যবহার করে তার সাথে সদ্ব্যবহার করার নাম ইহসান নয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
@(وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا....) جهاد
শব্দের অর্থন প্রচেষ্টা করা, ঈমান আনা থেকে শুরু করে যাবতীয় সৎ আমল করা ও অসৎ আমল থেকে বিরত থাকা এমনকি আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা পর্যন্ত এখানে সব শামিল। ঈমান আনতেও প্রচেষ্টা করতে হয়, কেননা শয়তান এতে কঠোরভাবে বাধা দেয়। কারণ একজন ব্যক্তি ঈমান আনলে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি সত্য পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে সঠিক পথ দেখাবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় শত্র“র বিরুদ্ধে জিহাদ করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতের পথ দেখাবেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাহায্য, সহযোগিতা দিয়ে সৎ কর্মশীলদের সাথে রয়েছেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় সংগ্রাম করার ফযীলত অনেক।
২. আল্লাহ তা‘আলা সৎ কর্মপরায়ণ লোকদেরকে সর্বদা সাহায্য করেন।
@যারা নিজেরা দীনের উপর চলে ও অন্যকে চালানাের চেষ্টা করে, তাদের জন্য এটা এক মহা সুসংবাদ। আল্লাহ তাআলার ওয়াদা হল, যারা দীনের পথে চেষ্টারত থাকবে এবং কখনও হতাশ হয়ে পিছিয়ে যাবে না, তিনি অবশ্যই তাদেরকে লক্ষ্যস্থলে পৌছাবেন। সুতরাং পথের কষ্ট - ক্লেশের কাছে হার না মেনে প্রতিটি বাঁক থেকে নতুন উদ্যম ও প্রত্যেক সঙ্কট থেকে নতুন হিম্মতের রসদ নিয়ে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা চাই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে এর তাওফীক দান করুন। আমীন।
@এখানে এ নিশ্চিন্ততা দান করা হচ্ছে যে, যারা আল্লাহর পথে আন্তরিকতা সহকারে সারা দুনিয়ার সাথে সংঘর্ষের বিপদ মাথা পেতে নেয় তাদেরকে পথ দেখান এবং তার দিকে যাওয়ার পথ তাদের জন্য খুলে দেন। তারা তার সন্তুষ্টি কিভাবে লাভ করতে পারে তা তিনি প্রতি পদে পদে তাদেরকে জানিয়ে দেন। পথের প্রতিটি বাঁকে তিনি তাদেরকে আলো দেখান। যার ফলে কোনটা সঠিক পথ ও কোনটা ভুল পথ তা তারা দেখতে চায়। তাদের নিয়ত যতই সৎ ও সদিচ্ছা প্রসূত হয় ততই আল্লাহর সাহায্য, সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও হিদায়াতও তাদের সহযোগি হয়।
@অন্য আর একটি দলের উল্লেখ করে সূরাটি সমাপ্ত করা হচ্ছে। যারা আল্লাহর পথে টিকে থাকতে গিয়ে এবং তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে জেহাদ করে, জেহাদ করে তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার উদ্দেশ্যে, যারা তাঁর পথে চলতে গিয়ে মাল-সামান সংগ্রহ ও বহন করে, এরপর আর পেছনের দিকে তাকায় না বা হতাশও হয় না, যারা অন্তরের মধ্য থেকে আগত বাধা-বিপত্তির মধ্যে এবং বাইরে থেকে আসা বিপদের মধ্যে অবস্থান করার সময়ে সবর করে, যারা চাদর গায়ে দিয়ে রওয়ানা হয় সে অজানা, কষ্টকর, দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর পথে... তারাই হচ্ছে সেসব মানুষ যাদের আল্লাহ রব্বুল আলামীন পরিত্যাগ করবেন না, এই বিপদসংকুল রাস্তায় অসহায় ও একাকী অবস্থায় ছেড়ে দেবেন না, তাদের ঈমান এবং তাদের জেহাদ তিনি ভুলে যাবেন না। তিনি তাঁর মহাসম্মানজনক অবস্থান থেকে তাদের কাজগুলাে পর্যবেক্ষণ করছেন, দেখছেন ও মূল্যায়ন করছেন তাদের জেহাদ এবং তিনিই দেখাবেন তাদের প্রকৃত সঠিক পথ। সত্যের পথে নিবেদিত লােকদের তিনি অবশ্যই দেখছেন এবং দেখছেন তাদের কঠোর সগ্রামী জীবন। তিনি আরও দেখছেন, এ পথে কাজ করতে গিয়ে তারা আলিংগন করে নিয়েছে এবং সকল দুঃখ জ্বালা ও দুঃসহ কষ্টের মধ্যে সবর করে চলেছেন। তিনি আরও দেখে যাচ্ছেন তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা এবং সত্যের খাতিরে পারস্পরিক সহযােগিতা ও সৌহার্দ বিনিময়কে, এ জন্যে অবশ্যই তিনি তাদের উপযুক্ত পুরস্কার ও মর্যাদা দান করবেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যারা আমার পথে টিকে থাকতে গিয়ে চূড়ান্ত সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে, অবশ্যই আমি মহান আল্লাহ তাদের বহু পথ দেখাব। আর অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা এহসানকারীদের সাথে রয়েছেন।'
@“মুজাহাদা” শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে, কোন বিরোধী শক্তির মোকাবিলায় দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম, প্রচেষ্টা ও সাধনা করা। আর যখন কোন বিশেষ বিরোধী শক্তি চিহ্নিত করা হয় না বরং সাধারণভাবে “মুজাহাদা” শব্দ ব্যবহার করা হয়, তখন এর অর্থ হয় একটি সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী দ্বন্দ্ব-সংঘাত। মু’মিনকে এ দুনিয়ায় যে দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম করতে হয় তা হচ্ছে এ ধরনের। তাকে শয়তানের সাথেও লড়াই করতে হয়, যে তাকে সর্বক্ষণ সৎকাজের ক্ষতির ভয় দেখায় এবং অসৎকাজের লাভ ও স্বাদ উপভোগের লোভ দেখিয়ে বেড়ায়। তাকে নিজের নফসের বা কুপ্রবৃত্তির সাথেও লড়তে হয়, যে তাকে সর্বক্ষণ নিজের খারাপ ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার দাসে পরিণত করে রাখার জন্য জোর দিতে থাকে। নিজের গৃহ থেকে নিয়ে বিশ্ব-সংসারের এমন সকল মানুষের সাথে তাকে লড়তে হয় যাদের আদর্শ, মতবাদ, মানসিক প্রবণতা, চারিত্রিক নীতি, রসম-রেওয়াজ, সাংস্কৃতিক ধারা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিধান সত্য দ্বীনের সাথে সংঘর্ষশীল। তাকে এমন রাষ্ট্রের সাথেও লড়তে হয় যে আল্লাহর আনুগত্যমুক্ত থেকে নিজের ফরমান জারী করে এবং সততার পরিবর্তে অসততাকে বিকশিত করার জন্য শক্তি নিয়োগ করে। এ প্রচেষ্টা-সংগ্রাম এক-দু’দিনের নয়, সারাজীবনের। দিন-রাতের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি মুহূর্তের। কোন একটি ময়দানে নয় বরং জীবনের প্রত্যেকটি ময়দানের ও প্রতিটি দিকে। এ সম্পর্কেই হযরত হাসান বাসরী (র) বলেনঃ
ان الرجل ليجاهدو ماضرب يوما من الدهر بسيف
“মানুষ যুদ্ধ করে চলে, যদিও কখনো একবারও তাকে তলোয়ার চালাতে হয় না।”
@যারা নিজেরা দীনের উপর চলে ও অন্যকে চালানোর চেষ্টা করে, তাদের জন্য এটা এক মহা সুসংবাদ। আল্লাহ তাআলার ওয়াদা হল, যারা দীনের পথে চেষ্টারত থাকবে এবং কখনও হতাশ হয়ে পিছিয়ে যাবে না, তিনি অবশ্যই তাদেরকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাবেন। সুতরাং পথের কষ্ট-ক্লেশের কাছে হার না মেনে প্রতিটি বাঁক থেকে নতুন উদ্যম ও প্রত্যেক সঙ্কট থেকে নতুন হিম্মতের রসদ নিয়ে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা চাই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে এর তাওফীক দান করুন। আমীন।
@جهاد — وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا
এর আসল অর্থ ধর্মের পথে বাধা বিপত্তি দূর করার জন্য পূর্ণ শক্তি ব্যয় করা। কাফির ও পাপিষ্ঠদের পক্ষ থেকে আগত বাধা-বিপত্তি এবং প্রবৃত্তি ও শয়তানের পক্ষ থেকে আগত বাধা-বিপত্তি সবই এর অন্তর্ভুক্ত। তবে জিহাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকার হচ্ছে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া।
উভয় প্রকার জিহাদের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতে ওয়াদা করা হয়েছে যে, যারা জিহাদ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করি। অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে ভাল মন্দ, সত্য অথবা উপকার ও অপকার সন্দেহ জড়িত থাকে কোন পথ ধরতে হবে তা চিন্তা করে কুল-কিনারা পাওয়া যায় না, সেসব ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা’আলা জিহাদকারীদেরকে সোজা, সরল ও সুগম পথ বলে দেন, অর্থাৎ যে পথে তাদের কল্যাণ নিহিত, সেই পথের দিকে মনকে আকৃষ্ট করে দেন।
ইলম অনুযায়ী আমল করলে ইলম বাড়েঃ এই আয়াতের তফসীরে হযরত আবুদ্দারদা বলেন, আল্লাহ্ প্রদত্ত ইল্ম অনুযায়ী আমল করার জন্য যারা জিহাদ করে, আমি তাদের সামনে নতুন নতুন ইলমের দ্বার খুলে দেই। ফুযায়ল ইবনে আয়ায বলেন, যারা বিদ্যার্জনে ব্রতী হয়, আমি তাদের জন্য আমলও সহজ করে দেই।—(মাযহারী) والله اعلم
তিনি অন্যত্র বলেন,
﴿ وَٱعۡبُدۡ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأۡتِيَكَ ٱلۡيَقِينُ ٩٩ ﴾ [الحجر: ٩٩]
অর্থাৎ “আর তোমার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর।” (সূরা হিজর ৯৯ আয়াত)
@ এখানে কুরআন ব্যবহার করেছে (الْيَقِيْنُ) শব্দটি। সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুম শব্দটির তাফসীর করেছেনঃ মৃত্যু [বুখারীঃ ৪৭০৬] কুরআন ও হাদীসে ইয়াকীন’ শব্দটি মৃত্যু অর্থে ব্যবহার হওয়ার বহু প্রমাণ আছে। পবিত্র কুরআনে এসেছেঃ
“তারা বলবে, আমরা মুসল্লীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না, আমরা অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করতাম না, এবং আমরা বিভ্রান্ত আলোচনাকারীদের সাথে বিভ্রান্তিমূলক আলোচনায় নিমগ্ন থাকতাম। আমরা কর্মফল দিন অস্বীকার করতাম, শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে মৃত্যু এসে যায় " [সূরা আল-মুদ্দাসসিরঃ ৪৩-৪৭] অনুরূপভাবে হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান ইবনে মায’উন এর মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে বলেছেনঃ “কিন্তু সে! তার তো (الْيَقِيْنُ) তথা মৃত্যু এসেছে, আর আমি তার জন্য যাবতীয় কল্যাণের আশা রাখি। [বুখারীঃ ১২৪৩]
সুতরাং বুঝা গেল যে, এখানে (الْيَقِيْنُ) শব্দের অর্থ মৃত্যুই। আর এ অর্থই সমস্ত মুফাসসেরীনদের থেকে বর্ণিত হয়েছে। সে হিসেবে প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করে যেতে হবে। যদি কাউকে ইবাদত থেকে রেহাই দেয়া হতো তবে নবী-রাসূলগণ তা থেকে রেহাই পেতেন কিন্তু তারাও তা থেকে রেহাই পাননি। তারা আমৃত্যু আল্লাহর ইবাদত করেছেন এবং করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং যদি কেউ এ কথা বলে যে, মারেফত এসে গেলে আর ইবাদতের দরকার নেই সে কাফের। কারণ সে কুরআন, হাদীস এবং ইজমায়ে উম্মাতের বিপরীত কথা ও কাজ করেছে। এটা মূলতঃ মুলহিদদের কাজ। আল্লাহ আমাদেরকে তাদের কর্মকাণ্ড থেকে হেফাযত করুন। আমীন।
@মুশরিকরা নবী (সাঃ)-কে যাদুকর, পাগল, গণক ইত্যাদি বলত। আর মানুষ হওয়ার কারণে তিনি এ সব কথায় দুঃখ পেতেন। মহান আল্লাহ সান্তনা দিয়ে বললেন, তুমি প্রশংসা কর, নামায পড় এবং নিজ আল্লাহর এবাদত কর। যাতে তোমার অন্তর শান্তি লাভ করবে এবং আল্লাহর সাহায্য আসবে। সিজদাকারী বলতে নামাযী ও ইয়াকীন বলতে মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে।
@(وَاعْبُدْ رَبَّكَ) এখানে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে দুনিয়ার সকল মু’মিন মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তারা যেন ইয়াকীন আসা পর্যন্ত ইবাদত করে। এখানে “يقين” দ্বারা উদ্দেশ্য হল মৃত্যু।
দলীল: উম্মু ‘আলার হাদীস, সেখানে বর্ণিত রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উসমান বিন মাযউন সম্পর্কে বলেছেন:
أَمَّا هُوَ فَقَدْ جَاءَهُ اليَقِينُ، وَاللّٰهِ إِنِّي لَأَرْجُو لَهُ الخَيْرَ، وَاللّٰهِ مَا أَدْرِي، وَأَنَا رَسُولُ اللّٰهِ، مَا يُفْعَلُ بِه
তার ইয়াকীন চলে এসেছে অর্থাৎ মৃত্যু চলে এসেছে। আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে তার জন্য কল্যাণ আশা করছি। আল্লাহ তা‘আলার শপথ আমি আল্লাহ তা‘আলার রাসূল হওয়া সত্ত্বেও জানিনা তার সাথে কী ব্যবহার করা হবে। (সহীহ বুখারী হা: ১২৪৩, ৭০১৮)
কিন্তু কোন কোন ভ্রান্ত সম্প্রদায় এর দ্বারা উদ্দেশ্য গ্রহণ করেন যে, যখন “ইয়াক্বীন” চলে আসবে তখন আর আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার প্রয়োজন নেই। যার ফলে অনেকে এই “ইয়াক্বীন” বা “খাঁটি বিশ্বাস” অর্থ গ্রহণ করে ইবাদত করা ছেড়ে দিয়েছে। তাদের এই উদ্দেশ্যটি ভুল। বরং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে।
যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি হাদীসে বলেন, “তুমি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় কর যদি তাতে সক্ষম না হও তাহলে বসে। আর যদি তাতেও সক্ষম না হও তাহলে ইশারা দিয়ে সালাত আদায় কর”। (সহীহ বুখারী হা: ১২৪৩)
সুতরাং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ইবাদত করে যেতে হবে, যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবাদত করেছেন। যারা এর ব্যতিক্রম বলে তারা সঠিক পথে নেই।
@অর্থাৎ সত্যের বাণী প্রচার এবং সংস্কার প্রচেষ্টা চালাবার ক্ষেত্রে তোমাকে অশেষ কষ্ট ও বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। এগুলোর মোকাবিলা করার শক্তি তুমি একমাত্র নামায ও আল্লাহর বন্দেগী করার ক্ষেত্রে অবিচল দৃঢ়তার পথ অবলম্বন করার মাধ্যমেই অর্জন করতে পারো। এ জিনিসটি তোমার মনকে প্রশান্তিতে ভরে তুলবে, তোমার মধ্যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার জন্ম দেবে, তোমার সাহস ও হিম্মত বাড়িয়ে দেবে এবং তোমাকে এমন যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তুলবে যার ফলে সারা দুনিয়ার মানুষের গালিগালাজ, নিন্দাবাদ ও প্রতিরোধের মুখে তুমি দৃঢ়ভাবে এমন দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকবে যার মধ্যে তোমার রবের রেজামন্দি রয়েছে।
তিনি আরো বলেন,
﴿ وَٱذۡكُرِ ٱسۡمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلۡ إِلَيۡهِ تَبۡتِيلٗا ٨ ﴾ [المزمل: ٨]
অর্থাৎ “সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ কর এবং একনিষ্ঠভাবে তাতে মগ্ন হও।” (সূরা মুয্যাম্মিল ৮ আয়াত)
@ অর্থাৎ আপনি সমগ্র সৃষ্টি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে কেবল আল্লাহ্র সন্তুষ্টিবিধানে ও ইবাদতে মগ্ন হোন। এর সাধারণ অর্থে ইবাদতে শির্ক না করাও দাখিল এবং নিজের সমস্ত কর্মকাণ্ডে তথা উঠাবসায়, চলাফেরায় দৃষ্টি ও ভরসা আল্লাহ্র প্রতি নিবদ্ধ রাখা এবং অপরকে লাভ-লোকসান ও বিপদাপদ থেকে উদ্ধারকারী মনে না করাও দাখিল। দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছুকে পরিত্যাগ করে আল্লাহ্র কাছে যা আছে তৎপ্রতি মনোনিবেশ করাও এর অর্থের অন্তর্গত। কিন্তু এই تبتل তথা দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ সেই رهبانية তথা বৈরাগ্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কুরআনে যার নিন্দা করা হয়েছে এবং হাদীসে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কেননা, শরীয়াতের পরিভাষায় رهبانية বা বৈরাগ্য এর অর্থ দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা এবং ভোগ সামগ্ৰী ও হালাল বস্তুসমুহকে ইবাদতের নিয়তে পরিত্যাগ করা। পক্ষান্তরে এখানে যে সম্পর্কচ্ছেদের আদেশ করা হয়েছে, তা এই যে, বিশ্বাসগতভাবে অথবা কাৰ্যগতভাবে আল্লাহ্র সম্পর্কের উপর কোন সৃষ্টির সম্পর্ককে প্রবল হতে না দেয়া। এ ধরণের সম্পর্কচ্ছেদ বিবাহ, আত্মীয়তার সম্পর্ক ইত্যাদি যাবতীয় সাংসারিক কাজ-কারবারের পরিপন্থী নয়; বরং এগুলোর সাথে জড়িত থেকেও এটা সম্ভবপর। রাসূলগণের সুন্নত; বিশেষতঃ রাসূলকুল শিরোমণি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সমগ্র জীবন ও আচারাদি এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। আয়াতে تبتل শব্দ দ্বারা যে অর্থ ব্যক্ত করা হয়েছে, মূলত তা হলো সকল ইবাদত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্র জন্য করা এবং এর মাধ্যমে একমাত্র তাঁরই মুখাপেক্ষী হওয়া। [দেখুন, কুরতুবী]
@অর্থাৎ, তা অব্যাহতভাবে পালন কর। দিন হোক বা রাত, সব সময় আল্লাহর তাসবীহ, তাহমীদ এবং তাকবীর ও তাহলীল পড়তে থাক।
[২] تَبَتُّلٌ এর অর্থ পৃথক ও আলাদা হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ, আল্লাহর ইবাদত এবং তাঁর কাছে দু'আ ও মুনাজাতের জন্য সব কিছু থেকে পৃথক হয়ে একাগ্রচিত্তে তাঁর প্রতি মনোযোগী হওয়া। তবে এটা বৈরাগ্য থেকে ভিন্ন জিনিস। বৈরাগ্য তো সংসার ত্যাগের নাম, যা ইসলামে অপছন্দনীয় জিনিস। পক্ষান্তরে تَبَتُّلٌ এর অর্থ হল, পার্থিব কার্যাদি সম্পাদনের সাথে সাথে একাগ্রচিত্তে নম্র ও বিনয়ী হয়ে আল্লাহর ইবাদতের প্রতিও মনোযোগী হওয়া। আর এটা প্রশংসনীয় জিনিস।
@অর্থাৎ দুনিয়ার কাজ-কারবার হতে অবসর লাভ করে প্রশান্তির সাথে খুব বেশী বেশী তার যিকির করতে থাকো, তার দিকে ঝুঁকে পড়ে তাঁর প্রতি মনোনিবেশ কর। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “অতএব যখনই অবসর পাও সাবধান করো।” একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবি) অর্থাৎ স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং দুনিয়া ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছেন।
এখানে ভাবার্থ হচ্ছেঃ হে নবী (সঃ)! পার্থিব সৃষ্টিকূল হতে সম্পর্ক চ্ছিন্ন করে আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করার একটা সময় অবশ্যই নির্দিষ্ট করে নাও।
@(وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ)
‘সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ কর’ এতে সকল প্রকার যিকির শামিল। সালাত, কিয়াম, সালাতের আগে ও পরের দু‘আ ইত্যাদি।
(وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيْلًا) – تَبَتَّلْ
অর্থ : পৃথক ও আলাদা হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার নিমিত্তে দুনিয়ার ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হওয়ার পর আলাদা হয়ে যাও। এটি বৈরাগ্যতা নয়। কেননা বৈরাগ্যতা হল : দুনিয়া থেকে সাংসারিক ব্যস্ততাসহ সকল কিছু বর্জন করা। আর এরূপ বৈরাগ্যবাদ ইসলামে নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতেন, আবার বিবাহ করে সংসার গড়েছেন, রোযা রাখতেন আবার রোযা ছাড়তেন, রাতে সালাত আদায় করতেন আবার ঘুমাতেন। এটাই সুন্নাত তরিকা। অতএব এ তরিকা বর্জন করে অন্য তরিকা গ্রহণ করা সম্পূর্ণ শরীয়ত গর্হিত কাজ। কখনো এমন আমল আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৫০৬৩)
তাই পার্থিব কর্ম ব্যস্ততার পাশাপাশি সময়-সুযোগ করে নিয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা প্রশংসনীয়। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতসহ যখন কোন আমল করতেন তখন তা নিয়মিত করার চেষ্টা করতেন। যদি রাতে ঘুমের কারণে অথবা অসুস্থতার কারণে তাহজ্জুত আদায় না করতে পারতেন তাহলে দিনে বার রাকাত আদায় করে নিতেন। তবে কখনো তিনি একরাতে কুরআন শেষ করেননি এবং সারা রাত জাগেননি, রমযান ছাড়া অন্য কোন পূর্ণমাস সিয়াম পালন করেননি। (সহীহ ইবনু খুযাইমাহ হা. ১১৭৭)
@যিকির বলতে উভয়টাই বােঝয় অর্থাৎ মুখে আল্লাহ তাআলার নাম উচ্চারণ করাও এবং অন্তরে তার ধ্যান করাও। সকলের থেকে পৃথক হওয়ার অর্থ দুনিয়ার সব সম্পর্ক ছিন্ন করা নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, সকল সম্পর্কের উপর আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া, যাতে অন্যান্য সম্পর্ক আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের পক্ষে বাধা না হয়; অন্য সব সম্পর্কও আল্লাহ তাআলার হুকুম মােতাবেক পরিচালিত হয় এবং এভাবে সে সব সম্পর্কও তারই জন্য হয়ে যায়।
@تَبْتِيلً — وَاذْكُراسْمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا
এর শাব্দিক অর্থ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদতে মগ্ন হওয়া। পূর্ববর্তী আয়াতে তাহাজ্জুদের নামাযের আদেশ দেওয়ার পর এই আয়াতে এমন এক ইবাদতের আদেশ দেওয়া হয়েছে. যা রাত্রি অথবা দিনের সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত নয় বরং সর্বদা ও সর্বাবস্থায় অব্যাহত থাকে। তা হচ্ছে আল্লাহকে স্মরণ করা। এখানে সদাসর্বদা অব্যাহত রাখার অর্থে আল্লাহকে স্মরণ করার আদেশ করা হয়েছে। কেননা, একথা কল্পনাও করা যায় না যে, রসূলুল্লাহ্ (সা) কোন সময় আল্লাহকে স্মরণ করতেন না, তাই এ আদেশ করা হয়েছে। ---(মাযহারী)। আয়তের উদ্দেশ্য এই যে, রসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দিবারাত্রি সর্বক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে কোন সময় অবহেলা ও অনবধানতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। এটা তখনই হতে পারে, যখন স্মরণ করার অর্থ ব্যাপক নেওয়া হয় অর্থাৎ মুখে, অন্তরে অথবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর আদেশ পালনে ব্যাপৃত রেখে ইত্যাদি যে কোন প্রকারে স্মরণ করা। এক হাদীসে হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ كان يذكر الله على كل حين অর্থাৎ রসূলুল্লাহ (সা) সর্বক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করতেন। এটাও উপরোক্ত ব্যাপক অর্থে শুদ্ধ হতে পারে। কেননা, প্রস্রাব-পায়খানার সময় তিনি যে মুখে আল্লাহকে স্মরণ করতেন না, একথা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে। তবে আন্তরিক স্মরণ সর্বাবস্থায় হতে পারে। আন্তরিক স্মরণ দুই প্রকার- ১. শব্দ কল্পনা করে স্মরণ করা এবং ২. আল্লাহর গুণাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। -(মাওলানা থানভী)
আলোচ্য আয়াতের দ্বিতীয় আদেশ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا অর্থাৎ আপনি সমগ্র সৃষ্টি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানে ও ইবাদতে মগ্ন হোন। এর সাধারণ অর্থে ইবাদতে শিরক না করাও দাখিল এবং নিজের সমস্ত কর্মকাণ্ডে তথা উঠাবসায়, চলাফেরায় দৃষ্টি ও ভরসা আল্লাহর প্রতি নিবদ্ধ রাখা এবং অপরকে লাভ লোকসান ও বিপদাপদ থেকে উদ্ধার কারী মনে না করাও দাখিল। হযরত ইবনে যায়েদ (রা) বলেনঃ تَبْتِيل -এর অর্থ দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছুকে পরিত্যাগ কর এবং আল্লাহর কাছে যা আছে, তৎপ্রতি মনোনিবেশ করা।--(মাযহারী) কিন্তু এই تَبْتِيل তথা দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ সেই رهبا نيت তথা বৈরাগ্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোরআনে যার নিন্দা করা হয়েছে এবং হাদীসে لا رهبانية في الإسلام বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কেননা, শরীয়তের পরিভাষায় رهبا نيت-এর অর্থ দুনিয়ার সাথে সম্পর্কছেদ করা এবং ভোগ সামগ্রী ও হালাল বস্তুসমূহকে ইবাদতের নিয়তে পরিত্যাগ করা। অর্থাৎ এরূপ বিশ্বাস থাকা যে, এসব হালাল বস্তু পরিত্যাগ করা ব্যতীত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হতে পারে না, অথবা ওয়াজিব হকে ত্রুটি করে কার্যত সম্পর্কছেদ করা। আর এখানে যে সম্পর্কচ্ছেদের আদেশ করা হয়েছে, তা এই যে, বিশ্বাসগতভাবে অথবা কার্যগতভাবে আল্লাহর সম্পর্কের উপর কোন সৃষ্টির সম্পর্ককে প্রবল হতে না দেওয়া। এ ধরনের সম্পর্কছেদ বিবাহ, আত্মীয়তার সম্পর্ক ইত্যাদি যাবতীয় সাংসারিক কাজ-কারবারের পরিপন্থী নয়। বরং এগুলোর সাথে জড়িত থেকেও এটা সম্ভবপর। পয়গম্বরগণের সুন্নত। বিশেষত পয়গম্বরকুল শিরোমণি মুহাম্মদ মোস্তাফা (সা)-র সমগ্র জীবন ও আচারাদি এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। আয়াতে تَبْتِيل শব্দ দ্বারা যে অর্থ ব্যক্ত করা হয়েছে, পূর্ববর্তী বুযুর্গানে দীনের ভাষায় এরই অপর নাম ’ইখ্লাস’।~~~(মাযহারী)
জ্ঞাতব্য: অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং সাংসারিক সম্পর্ক ত্যাগ করার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সূফী বুষুর্গগণ সবার অগ্রণী ছিলেন। তাঁরা বলেন:আমরা যে দূরত্ব অতিক্রম করার কাজে দিবারাত্রি মশগুল আছি, প্রকৃতপক্ষে তাঁর দৃষ্টি স্তর আছে—প্রথম স্তর সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয় স্তর আল্লাহ পর্যন্ত পৌছা। উভয় স্তর পরস্পরে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আলোচ্য আয়াতে এ দু’টি স্তরই পর পর দুই বাক্যে বর্ণিত হয়েছে। ১. وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ এবং ২, وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا এখানে আল্লাহকে স্মরণ করার অর্থ সার্বক্ষণিকভাবে স্মরণ করা, যাতে কখনও ছুটি ও শৈথিল্য দেখা না দেয়। এই স্তরকেই সূফী-বুযুর্গগণের পরিভাষায় وصول الى الله এটা আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছা বলা হয়। এভাবে প্রথম বাক্যে শেষ স্তর এবং শেষ বাক্যে প্রথম স্তর উল্লিখিত হয়েছে। এই ব্রুম পরিবর্তনের কারণ সম্ভবত এই যে, দ্বিতীয় স্তরই আল্লাহর পথের পথিকের আসল উদ্দেশ্য ও চরম লক্ষ্য। তাই এর গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ব্যক্ত করার জন্য স্বাভাবিক ক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে। শেখ সাদী (র) উপরোক্ত দু’টি স্তর চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন
تعلن حجاب است و ہے حاصلی – چو, پیوندها بگسلی واصلی
ইসমে যাতের যিকির অর্থাৎ বারবার ’আল্লাহ’ ’আল্লাহ’ বলাও ইবাদতঃ আয়াতে ইসম শব্দ উল্লেখ করে وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ বলা হয়েছে এবং وَاذْكُرِ رَبِّكَ বলা হয়নি। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ইসমে অর্থাৎ আল্লাহ বারবার উচ্চারণ করাও আদিষ্ট বিষয় ও কাম্য। ---(মাযহারী) কোন কোন আলিম একে বিদ’আত বলেছেন। আয়াত থেকে জানা গল যে, তাদের এই উক্তি ঠিক নয়।
@যিকির বলতে উভয়টাই বোঝায় অর্থাৎ মুখে আল্লাহ তাআলার নাম উচ্চারণ করাও এবং অন্তরে তাঁর ধ্যান করাও। সকলের থেকে পৃথক হওয়ার অর্থ দুনিয়ার সব সম্পর্ক ছিন্ন করা নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, সকল সম্পর্কের উপর আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া, যাতে অন্যান্য সম্পর্ক আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের পক্ষে বাধা না হয়; অন্য সব সম্পর্কও আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক পরিচালিত হয় এবং এভাবে সে সব সম্পর্কও তাঁরই জন্য হয়ে যায়।
তিনি অন্য জায়গায় বলেছেন,
﴿ فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ ﴾ [الزلزلة: ٧]
অর্থাৎ “সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে সে তা দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল ৭ আয়াত)
@অতএব কেউ অণু পরিমাণও সৎ কাজ করলে সে তা দেখবে, জামে তিরমিযীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর কাছে এসে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে পড়িয়ে দিন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বললেনঃ (আরবি) যুক্ত তিনটি সূরা পাঠ করো।” লোকটি বললো “আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি, স্মৃতিশক্তি আমার দুর্বল হয়ে গেছে এবং জিহ্বা মোটা হয়ে গেছে (সুতরাং এই সূরাগুলো পড়া আমার পক্ষে কঠিন)।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, “আচ্ছা, তাহলে (আরবি) যুক্ত সূরাগুলো পড়।” লোকটি পুনরায় একই ওযর পেশ করলো। তখন নবী করীম (সঃ) তাকে বললেন “তাহলে (আরবি) বিশিষ্ট তিনটি সূরা পাঠ করো।” লোকটি ঐ উক্তিরই পুনরাবৃত্তি করলো এবং বললোঃ আমাকে একটি সূরার সবক দিন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে (আরবি) এই সূরাটিই পাঠ করালেন। পড়া শেষ করার পর লোকটি বললোঃ “আল্লাহর কসম! আমি কখনো এর অতিরিক্ত কিছু করবো না।” এই কথা বলে লোকটি চলে যেতে শুরু করলো। তখন নবী করীম (সঃ) বললেনঃ “এ লোকটি সাফল্য অর্জন করেছে ও মুক্তি পেয়ে গেছে।” তারপর তিনি বললেনঃ “তাকে একটু ডেকে আনে।” লোকটিকে ডেনে আনা হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ আমাকে ঈদুল আযহার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই দিনকে আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের জন্যে ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।" একথা শুনে লোকটি বললোঃ “যদি আমার কাছে কুরবানীর পশু না থাকে এবং কেউ আমাকে দুধ পানের জন্যে একটা পশু উপটৌকন দেয় তবে কি আমি ঐ পশুটি যবাহ করে ফেলবো?” রাসূলুল্লাহ উত্তরে বললেনঃ না, (এ কাজ করো না। বরং চুল ছাটিয়ে নাও, নখ কাটিয়ে নাও, গোঁফ ছোট করো এবং নাভীর নিচের লোম পরিষ্কার করো, এ কাজই আল্লাহর কাছে তোমার জন্যে পুরোপুরি কুরবানী রূপে গণ্য হবে।” (এ হাদীসটি সুনানে আবী দাউদ ও সুনানে নাসাঈতেও বর্ণিত হয়েছে) জামে তিরমিযীতে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি এই সূরা পাঠ করে সে অর্ধেক কুরআন পাঠের সওয়াব লাভ করে।” (এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল) অন্য এক হাদীসে রয়েছে যে, (আরবি) সূরাটি অর্ধেক কুরআনের সমতুল্য, (আরবি) সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য এবং এ সূরাটি কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমতুল্য। (এটাও গারীব বা দুর্বল হাদীস) অন্য একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সাহাবীদের একজনকে বলেনঃ “তুমি কি বিয়ে করেছো?” লোকটি উত্তরে বলেনঃ “জ্বী, না। আমার বিয়ে করার মত সামর্থ্য নেই।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ (আরবি) “এ সূরাটি কি তোমার সাথে নেই (অর্থাৎ এ সূরাটি কি তোমার মুখস্ত নেই)?” লোকটি জবাবে বললেনঃ “হ্যা (তা তো আছেই)।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এতে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ হলো। তারপর বললেনঃ “তোমার সাথে কি (আরবি) এই সূরাটি নেই?” লোকটি বললেনঃ “হ্যা’, আছে। নবী করীম (সঃ) বললেনঃ “এতে কুরআনের এক চতুর্থাংশ হলো। এরপর বললেন (আরবি) “এ সূরাটি কি তোমার জানা নেই?” লোকটি জবাব দিলেনঃ “হ্যা আছে।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “এটা কুরআনের এক চতুর্থাংশ” অতঃপর বললেনঃ “তোমার কি (আরবি) এ সূরাটি মুখস্ত নেই?” লোকটি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, অবশ্যই আছে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এটাও কুরআনের এক চুতর্থাংশ। যাও, এবার বিয়ে করে নাও।” (এই হাদীসটি হাসান। এই তিনটি হাদীসই ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। তিনি ছাড়া আসহাবুল কুতুবের অন্য কেউ এটা বর্ণনা করেননি) ১-৮ নং আয়াতের তাফসীর হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) (আরবি) এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ জমীনকে যখন ভীষণ কম্পনে কম্পিত করা হবে, নীচে থেকে উপর পর্যন্ত প্রকম্পনে ভিতরের সমস্ত মৃতকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হবে। যেমন অন্যত্র রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে মানুষ! ভয় কর তোমাদের প্রতিপালককে; কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ানক ব্যাপার।” (২২:১) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অথাৎ “এবং পৃথিবীকে যখন সম্প্রসারিত করা হবে ও পৃথিবী তার অভ্যন্তরে যা আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করবে ও শূন্যগর্ভ হবে।” (৮৪:৩-৪) সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জমীন তার কলেজার টুকরোগুলোকে উগরে দিবে এবং বাইরে নিক্ষেপ করবে। স্বর্ণ রৌপ্য স্তম্ভের মত বাইরে বেরিয়ে পড়বে। হত্যাকারী সে সব দেখে বলবেঃ হায়! আমি এই ধন সম্পদের জন্য অমুককে হত্যা করে ছিলাম, অথচ আজ ওগুলো এভাবে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, কেউ যেন ওগুলোর দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না!" আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দুর্ব্যবহারকারী দুঃখ করে বলবেঃ “হায়! এই ধন সম্পদের মোহে পড়ে আমি আমার আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করিনি!” চোর বলবেঃ “হায়! এই মাল ধনের জন্যে আমার হাত কেটে দেয়া হয়েছিল!” অতঃপর ওগুলো তাদেরকে ডাকবে, কিন্তু তারা ওগুলো হতে কিছুই গ্রহণ করবে না।” মোটকথা, সেই ধন সম্পদ এমনভাবে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকবে যে, ওগুলোর প্রতি কেউ চোখ তুলেও চাইবে না। মানুষ বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে সেদিকে তাকিয়ে বলবেঃ হায়! এগুলোর তো নড়া চড়া করার কোন শক্তি ছিল এগুলো তো স্তব্ধ নিথর হয়ে পড়ে থাকতো। আজ এগুলোর কি হলো যে, এমন থরথর করে কাঁপছে! পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মৃতদেহ জমীন বের করে দিবে। তখন মানুষ বলবেঃ এর কি হলো? জমীন ও আসমান সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে দেয়া হবে। ঐ দৃশ্য সবাই দেখবে এবং সবাইকে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সামনে হাযির করা হবে। জমীন খোলাখুলি ও সুস্পষ্টভাবে সাক্ষ্য দিবে যে, অমুক অমুক ব্যক্তি তার উপর অমুক অমুক নাফরমানী করেছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) এই আয়াতটি পাঠ করে বললেনঃ “জমীনের বৃত্তান্ত কি তা কি তোমরা জাননা?” সাহাবীগণ উত্তরে বললেনঃ 'আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আদম সন্তান যে সব আমল জমীনে করেছে তার সব কিছু জমীন এভাবে প্রকাশ করে দিবে, যে অমুক ব্যক্তি অমুক সময়ে অমুক জায়গায় এই এই পাপ ও এই এই পুণ্য কাজ করেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং আবু আবদির রহমান নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটি হাসান-সহীহ গারীব বলেছেন) মু’জামে তিবরানীতে হযরত রাবীআহ হাদাসী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জমীনের ব্যাপারে সাবধান থেকো। ওটা তোমাদের মা। ওর উপর যে ব্যক্তি যে পাপ বা পুণ্য কাজ করবে সে তো খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করে দিবে।” এখানে অহী দ্বারা আদেশ করা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা জমীনকে বলবেনঃ ‘বলে দাও। তখন সে বলে দিবে। সেদিন মানুষ হিসাবের জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের দলে বিভক্ত হয়ে ফিরবে। কেউ হবে পুণ্যবান এবং কেউ হবে পাপী। কেউ জান্নাতী হবে, আবার কেউ জাহান্নামী হবে। এ অর্থও করা হয়েছে যে, এখান থেকে তারা পৃথক হবে, আর তারা মসবেত হবে না। এর কারণ হলো এই যে, তারা নিজেদের আমলসমূহ জেনে নিবে এবং ভালমন্দের প্রতিফল পেয়ে যাবে। এজন্যেই শেষেও একথাই বলে দেয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঘোড়ার মালিকরা তিন প্রকারের। এক প্রকার হলো তারা যারা পুরস্কার ও পারিশ্রমিক লাভকারী। দ্বিতীয় প্রকার হলো তারা যাদের জন্যে ঘোড়া আবরণস্বরূপ। তৃতীয় প্রকার হলো তারা যাদের জন্যে ঘোড়া বোঝাস্বরূপ অর্থাৎ তারা পাপী। পুরস্কার বা পারিশ্রমিক লাভকারী বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা জিহাদের উদ্দেশ্যে ঘোড়া পালন করে। যদি ঘোড়ার দেহে ও পায়ে শিথিলতা দেখা দেয় এবং ঐ ঘোড়া এদিক ওদিকের চারণ ভূমিতে বিচরণ করে তাহলে এজন্যেও মালিক সওয়াব লাভ করবে। যদি ঘোড়ার রশি ছিড়ে যায় এবং ঐ ঘোড়াটি এদিক ওদিক চলে যায় তবে তার পদচিহ্ন এবং মল মূত্রের জন্যেও মালিক সওয়াব বা পুণ্য লাভ করবে। মালিকের পানি পান করাবার ইচ্ছা না থাকলেও ঘোড়া যদি কোন জলাশয়ে গিয়ে পানি পান করে তাহলেও মালিক সওয়াব পাবে। এই ঘোড়া তার মালিকের জন্যে পুরোপুরি পুণ্য ও পুরস্কারের মাধ্যম। দ্বিতীয় হলো ঐ ব্যক্তি যে স্বয়ং সম্পূর্ণ হওয়ার জন্যে ঘোড়া পালন করেছে, যাতে প্রয়োজনের সময় অন্যের কাছে ঘোড়া চাইতে না হয়, কিন্তু সে আল্লাহর অধিকারের কথা নিজের ক্ষেত্রে এবং নিজের সওয়ারীর ক্ষেত্রে বিস্মৃত হয় না। এই সওয়ারী ঐ ব্যক্তির জন্যে পর্দা স্বরূপ। আর তৃতীয় হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে অহংকার এবং গর্বের কারণে এবং অন্যদের উপর জুলুম অত্যাচার করার উদ্দেশ্যে ঘোড়া পালন করে, এই পালন তার উপর একটা বোঝা স্বরূপ এবং তার জন্যে গুনাহ স্বরূপ। রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে তখন জিজ্ঞেস করা হলোঃ “গাধা সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহ তা'আলা আমার প্রতি এই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অর্থবহ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন যে, বিন্দুমাত্র পুণ্য এবং বিন্দুমাত্র পাপও প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) এবং ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত ফারদাকের (রাঃ) চাচা হযরত সাআ’সাআ ইবনে মুআবিয়া (রাঃ) নবী (সঃ)-এর নিকট আগমন করলে তিনি তার সামনে (আরবি) আয়াত দু’টি পাঠ করেন। তখন হযরত সাআ’সাআ (রাঃ) বলেনঃ “এ আয়াত দু’টিই আমার জন্যে যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশী যদি নাও শুনি তবুও কোন অসুবিধা হবে না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) সহীহ বুখারীতে হযরত আদী ইবনে হাতিম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “অর্ধেক খেজুর সাদকা করার মাধ্যমে হলেও এবং ভাল কথার মাধ্যমে হলেও আগুন হতে আত্মরক্ষা করো।” একইভাবে সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “পুণ্যের কাজকে কখনো হালকা মনে করো না, নিজের বালতি দিয়ে পানি তুলে কোন পিপাসার্তকে পান করানো অথবা কোন মুসলমান ভাই এর সাথে অন্তরঙ্গ অনুভূতি সহকারে দেখা করাও পুণ্যের কাজ বলে মনে করবে।” অন্য একটি সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “হে নারীদের দল! তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীদের পাঠানো উপঢৌকনকে তুচ্ছ মনে করো না, যদিও তারা এটা পায়ের গোড়ালীও অর্থাৎ খুরও পাঠায়। অন্য একটি হাদীসে রয়েছেঃ “ভিক্ষুককে কিছু না কিছু দাও, আগুনে পোড়া একটা খুর হলেও দাও।” মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হে আয়েশা। (রাঃ)! পাপকে কখনো তুচ্ছ মনে করো না। মনে রেখো, তারও হিসাব হবে।" হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সঃ) সাথে আহার করছিলেন এমন সময় এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। হযরত আবু বকর (রাঃ) তখন খাবার হতে হাত তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাপেরও বদলা আমাকে দেয়া হবে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! পৃথিবীতে তুমি যে সব দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছে তাতে তোমার ছোট খাট পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেছে, পুণ্যসমূহ তোমার জন্যে আল্লাহর কাছে রক্ষিত রয়েছে। এগুলোর প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে কিয়ামতের দিন তোমাকে প্রদান করা হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন) অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, এ সূরাটি হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর উপস্থিতিতে অবতীর্ণ হয়। তিনি শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “এই সূরাটি আমাকে কাঁদিয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন না। এরূপ ধারণা করে তোমরা যদি গুনাহ না করতে তাহলে আল্লাহ তা'আলা অন্য কোন উম্মত সৃষ্টি করতেন যারা ভুল করতো ও গুনাহ করতো, অতঃপর পরম করুণাময় আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করতেন।” (এ হাদীসটিও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন) মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবি) যখন আয়াত দু'টি অবতীর্ণ হয় তখন তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি কি আমার সব আমলই দেখবো?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যা।” তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “বড় বড় সব আমল?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃ “হ্যা” তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ “ছোট ছোট সব আমল?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হ্যা তখন হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বললেনঃ “হায়, আফসোস!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “হে আবু সাঈদ (রাঃ)! খুশী হয়ে যাও, জেনে রেখো যে, আল্লাহ তা'আলা পুণ্যের পরিমাণ দশগুণ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত দেন, এমনকি যাকে ইচ্ছা করেন তার চেয়েও বেশী প্রদান করেন কিন্তু গুনাহ সমপরিমাণই থাকবে অথবা আল্লাহ গুনাহগারকে ক্ষমা করে দিবেন। মনে। রাখবে যে, কোন লোককে শুধু তার আমল মুক্তি দিতে পারবে না।” একথা শুনে হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) আপনাকেও নয়?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃ “হ্যা, আমাকেও নয়। তবে আল্লাহ তা'আলা আমাকে তার রহমত দ্বারা ঢেকে দিবেন। আবু যারআহ (রঃ) বলেন যে, (এই হাদীসটি শুধুমাত্র ইবনে লাহীআহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) বলেন, যখন(আরবি) (অর্থাৎ “আহার্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে (৭৬:৮)।” যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন মুসলমানরা মনে করেন যে, তারা সামান্য জিনিস প্রদান করলে কোন বিনিময় প্রাপ্ত হবেন না। তাই, তাদের দরজায় ফকীর মিকসীন আসলে তারা তাদেরকে এক আধটা খেজুর, রুটির টুকরা ইত্যাদি দেয়াকে বৃথা মনে করে শূন্য হস্তেই ফিরিয়ে দিতেন। তারা চিন্তা করতেন যে, যদি দিতে পারেন তবে ভালো ও উৎকৃষ্ট কোন জিনিসই দিবেন। এ ধরনের চিন্তা একটি দল করতেন। অন্য কেটি দল মনে করতেন যে, ছোট খাট পাপের জন্য কৈফিয়ত তলব করা হবে না। যেমন কখনো মিথ্যা কথা বলা, এদিক ওদিক তাকানো, কারো গীবত করা ইত্যাদি। তখন অবতীর্ণ হলো, (আরবি) এই আয়াত দু'টি। অর্থাৎ “কেউ অণু পরিমাণ সঙ্কাজ করলে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসত্তাজ করলে তাও দেখবে।” তাদেরকে আরো বলা হলোঃ ছোট খাট পুণ্য বা নেক কাজকে তুচ্ছ মনে করো ওটা বড়রূপে দেখা দিবে। আর ছোট খাট পাপকেও তুচ্ছ মনে করো না। কেন না, এই ছোট খাট পাপসমূহই একত্রিত হয়ে বিরাট আকার ধারণ করবে।” এর অর্থ হলো ছোট পিপীলিকা। অর্থাৎ আমলনামায় ছোট বড় সব আমলই দেখা যাবে। গুনাহ তো একটির স্থলে একটিই লিখা হয়, কিন্তু পুণ্য বা নেককাজ একটির বদলে দশ, বরং যার জন্যে আল্লাহ চান এরচেয়ে অনেকগুণ বেশী লিখেন। আবার অনেক সময় নেকীর বদলে গুনাহ্ মার্জনাও করে দেন। এক একটি নেকীর বদলে দশ দশটি গুনাহ মাফ হয়ে যায়। তারপর এমনও রয়েছে যে, যার পুণ্য বা নেকী গুনাহর চেয়ে একবিন্দু পরিমাণ বেশী হবে সে জান্নাতে প্রবেশাধিকার লাভ করবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “পাপকে হালকা মনে করো সব পাপ একত্রিত হয়ে ধ্বংস করে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এসব পাপের উদাহরণ প্রসঙ্গে বলেনঃ “যেমন কিছু লোক কোন জায়গায় অবতরণ করলো। তারপর একটি লোক একটি দু'টি করে কাঠ কুড়িয়ে জমা করলো। এতে কাঠের একটা স্কুপ হয়ে গেল। তারপর ঐ কাঠে অগ্নি সংযোগ করা হলো এবং তারা যা ইচ্ছা করলো তা রান্না করলো।”
@৯৯ নং সূরা আল-যিলযাল-আয়াত ০৭
فَمَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ خَیۡرًا یَّرَہٗ ؕ﴿۷﴾
কেউ অণু পরিমাণ সৎকাজ করলে সে তা দেখবে [১]।
@[১] এ আয়াতে خير বলে শরীয়তসম্মত সৎকর্ম বোঝানো হয়েছে; যা ঈমানের সাথে সম্পাদিত হয়ে থাকে। কেননা, ঈমান ব্যতীত কোন সৎকর্মই আল্লাহ্র কাছে সৎকর্ম নয়। কুফার অবস্থায় কৃত সৎকর্ম আখেরাতে ধর্তব্য হবে না যদিও দুনিয়াতে তার প্রতিদান দেয়া হয়। তাই এ আয়াতকে এ বিষয়ের প্রমাণস্বরূপ পেশ করা হয় যে, যার মধ্যে অণু পরিমাণ ঈমান থাকবে, তাকে অবশেষে জাহান্নাম থেকে বের করে নেয়া হবে। কেননা, এ আয়াতের ওয়াদা অনুযায়ী প্রত্যেকের সৎকর্মের ফল আখেরাতে পাওয়া জরুরী। কোন সৎকর্ম না থাকলেও স্বয়ং ঈমানই একটি বিরাট সৎকর্ম বলে বিবেচিত হবে। ফলে মুমিন ব্যক্তি যতবড় গোনাহগারই হোক, চিরকাল জাহান্নামে থাকবে না। কিন্তু কাফের ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন সৎকর্ম করে থাকলে ঈমানের অভাবে তা পণ্ডশ্রম মাত্র। তাই আখেরাতে তার কোন সৎকামই থাকবে না।
@অর্থ : অণু। এখানে উদ্দেশ্য সবচেয়ে ছোটতম গুনাহ বা নেকী তাও দেখতে পাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(یَوْمَ تَجِدُ کُلُّ نَفْسٍ مَّا عَمِلَتْ مِنْ خَیْرٍ مُّحْضَرًاﹴ وَّمَا عَمِلَتْ مِنْ سُوْ۬ئٍﹱ تَوَدُّ لَوْ اَنَّ بَیْنَھَا وَبَیْنَھ۫ٓ اَمَدًۭا بَعِیْدًا)
“প্রত্যেক মানুষ যা ভাল করেছে এবং খারাপ করেছে কিয়ামতের দিন সবই উপস্থিত পাবে। সে কামনা করবে তার ও তার অন্যায় কাজের মধ্যে যদি অনেক দুরত্ব থাকত!” (সূরা আলি ইমরান ৩: ৩০)
@ আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, তিনি প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব কথাই ভালই জানেন। কোন ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্ৰমত কথাও তাঁর নিকট লুক্কায়িত থাকে না। তার জ্ঞান সমস্ত জিনিসকে প্রতি মুহূর্তে বেষ্টন করে রয়েছে। পৃথিবী প্রান্তে, পর্বতে, সমুদ্রে, আকাশে, বাতাসে, ছিদ্রে মোটকথা যেখানে যা কিছু আছে সবই তাঁর গোচরে রয়েছে। সব কিছুর উপরেই তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা বিদ্যমান। তিনি যেভাবেই চান রাখেন, যাকে ইচ্ছে করেন শাস্তি দেন। সুতরাং এত ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী ও এতবড় ক্ষমতাবান হতে সকলেরই সদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকা, সদা-সর্বদা তাঁর আদেশ পালনে নিয়োজিত থাকা এবং অবাধ্যতা হতে বিরত থাকা উচিত। তিনি সবজান্তাও বটে এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারীও বটে। সম্ভবতঃ তিনি কাউকে ঢিল দিয়ে রাখবেন, কিন্তু যখন ধরবেন তখন এমন কঠিনভাবে ধরবেন যে, পালিয়ে যাবার কোন উপায় থাকবে না। এমন একদিন আসবে যেদিন সমস্ত ভাল-মন্দ কাজের হিসেব সামনে রেখে দেয়া হবে। পুণ্যের কাজ দেখে আনন্দ লাভ হবে এবং মন্দ কাজ দেখে দাঁত কামড়াতে থাকবে ও হা-হুতাশ করবে। সেদিন তারা ইচ্ছে পোষণ করবে যে, যদি তার মধ্যে ও ঐ মন্দ কার্যের মধ্যে বহু দূরের ব্যবধান থাকতো তবে কতই না চমৎকার হতো! কুরআন কারীমের আর এক স্থানে ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ সেদিন মানুষকে তার পূর্বের ও পরের কৃৎকর্মের সংবাদ দেয়া হবে। (৭৫:১৩) দুনিয়ায় যে শয়তান তার সঙ্গে থাকতো এবং তাকে অন্যায় কার্যে উত্তেজিত করতো সেদিন তার উপরও সে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবে এবং বলবেঃ (আরবী) অর্থাৎ হে শয়তান, যদি তোমার ও আমার মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান হতো তবে কতই না ভাল হতো! তুমি মন্দ সাথী।' (৪৩:৩৮) আল্লাহ তা'আলা বলেন-“আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় অস্তিত্ব হতে অর্থাৎ স্বীয় শাস্তি হতে ভয় প্রদর্শন করছেন। অতঃপর তিনি স্বীয় সৎ বান্দাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছেন যে, তারা যেন তাঁর দয়া ও স্নেহ হতেও নিরাশ না হয়। কেননা, তিনি। অত্যন্ত দয়ালু ও স্নেহশীল। ইমাম হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ “এটাও তার সরাসরি দয়া ও ভালবাসা যে, তিনি স্বীয় অস্তিত্ব হতে বান্দাদেরকে ভয় দেখিয়েছেন। এও ভাবার্থ হতে পারে যে, আল্লাহ তা'আলা বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। সুতরাং বান্দাদেরও উচিত যে, তারা যেন সরল-সঠিক পথ হতে সরে না পড়ে, পবিত্র ধর্মকে পরিত্যাগ না করে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আনুগত্য হতে মুখ ফিরিয়ে না নেয়।
@ অর্থাৎ তার মধ্যে এবং তার আমলের মধ্যে বিশাল ব্যবধান কামনা করবে। তারা চাইবে যেন তাদের আমলনামা তাদেরকে দেয়া না হয়।
@ আল্লাহ তা‘আলা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবকিছু জানেন, কিছুই তার কাছে গোপন নেই- সে কথাই এ আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
কিয়ামাতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তি তার আমলনামা উপস্থিত পাবে। যাদের আমলনামা খারাপ হবে তারা আফসোস করে বলবে, হায়! যদি আমার ও আমার এ খারাপ আমলের মধ্যে অনেক দূরত্ব হতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاَمَّا مَنْ اُوْتِیَ کِتٰبَھ۫ بِشِمَالِھ۪ﺃ فَیَقُوْلُ یٰلَیْتَنِیْ لَمْ اُوْتَ کِتٰبِیَھْﭨﺆ وَلَمْ اَدْرِ مَا حِسَابِیَھْ)
“আর যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে: হায়! আমাকে যদি আমার আমলনামা না দেয়া হত। এবং আমি যদি আমার হিসাব কী, তা না জানতাম!” (সূরা হাক্কাহ ৬৯:২৫-২৬)
@আল্লাহ তা‘আলা ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের আলোচনার পর বাম হাতে আমলনামাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আলোচনা নিয়ে এসেছেন। তারা আখিরাতে যে আফসোস করবে ও তাদের জন্য যে শাস্তির ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে তার বিবরণও এখানে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। জাহান্নামের শিকলের বিবরণ দিতে গিয়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যদি আকাশ হতে একটি বড় পাথর নিক্ষেপ করা হয় তবে তা এক রাতে পৃথিবীতে এসে পড়বে। কিন্তু ওটাকেই যদি জাহান্নামীকে বাঁধার শৃংখলের একমাথা হতে নিক্ষেপ করা হয় তবে তা অন্য মাথায় পড়তে ৪০ বছর লেগে যাবে। (আহমাদ হা. ৬৮৫৬, তিরমিযী হা. ২৫৮৮ সনদ সহীহ)
যাদের বাম হাতে আমলনামা প্রদান করা হবে তাদের হায় হুতাশের শেষ থাকবে না।
জাহান্নামী ব্যক্তির ক্ষমতা, সন্তান-সন্ততি ও সহায়-সম্পদ কোন উপকারে আসবে না।
জাহান্নামে যাওয়ার কারণ জানলাম ও তার শাস্তির বিবরণ জানলাম।
যে শয়তান তাকে খারাপ কাজে প্রেরণা দিয়েছে তার কাছ থেকেও দূরে থাকার আফসোস প্রকাশ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قَالَ يَا لَيْتَ بَيْنِيْ وَبَيْنَكَ بُعْدَ الْمَشْرِقَيْنِ فَبِئْسَ الْقَرِيْنُ)
“সে (শয়তানকে) বলবে: হায়! আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান থাকত! কতই না নিকৃষ্ট সহচর সে!” (সূরা যুখরুƒফ ৪৩:৩৮) সুতরাং যে শয়তানের প্রতারণায় আমরা আজ অপরাধের সাগরে ডুবে আছি কিয়ামতের দিন সে শয়তানকে দোষ দেয়ার সুযোগ থাকবে না; বরং নিজের অপরাধের বোঝা নিজেকেই বহন করে লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে যেতে হবে।
মানুষ যা প্রকাশ করে ও গোপন করে এমনকি আকাশে ও জমিনে যা আছে তাও আল্লাহ তা‘আলা জানেন।
ভাল-মন্দ সবকিছুর প্রতিদান মানুষ পাবে।
পাপাচারীগণ কিয়ামতের দিন আফসোস করবে; কিন্তু তাদের আফসোস কোন কাজে আসবে না।
মূলত এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে ভাল কাজে উৎসাহ ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তাই আমাদের ভাল কাজে উৎসাহী ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষ যা কিছু করছে সব ব্যাপারে জমিন সাক্ষ্য দেবে।
২. মানুষ তার কৃত বিন্দু পরিমাণ ভালমন্দ আমলও দেখতে পাবে।
@আয়াতে خَيْرً বলে শরীয়তসম্মত সৎ কর্ম বোঝানো হয়েছে। যা ঈমানের সাথে সম্পাদিত হয়ে থাকে। কেননা, ঈমান ব্যতীত কোন সৎ কর্মই আল্লাহর কাছে সৎ কর্ম নয়। কুফর অবস্থায় কৃত সৎ কর্ম পরকালে ধর্তব্য হবেনা যদিও দুনিয়াতে তার প্রতিদান দেওয়া হয়। তাই এ আয়াতকে এ বিষয়ের প্রমাণস্বরূপ পেশ করা হয় যে, যার মধ্যে অণু পরিমাণ ঈমান থাকবে, তাকে অবশেষে জাহান্নাম থেকে র করে নেওয়া হবে। কেননা, এ আয়াতের ওয়াদা অনুযায়ী প্রত্যেকের সৎ কর্মের ফল পরকালে পাওয়া জরুরী। কোন সৎ কর্ম না থাকলেও স্বয়ং ঈমানই একটি বিরাট সৎকর্ম বলে বিবেচিত হবে। ফলে মু’মিন ব্যক্তি যত বড় গোনাহ্গারই হোক, চিরকাল জাহান্নামে কবে না। কিন্তু কাফির ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন সৎকর্ম করে থাকলে ঈমানেরও অভাবে তা পশুশ্রম মাত্র। তাই পরকালে তার কোন সৎ কাজই থাকবে না।
তিনি আরো বলেছেন,
﴿ وَمَا تُقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُم مِّنۡ خَيۡرٖ تَجِدُوهُ عِندَ ٱللَّهِ هُوَ خَيۡرٗا وَأَعۡظَمَ أَجۡرٗاۚ ﴾ [المزمل: ٢٠]
অর্থাৎ “তোমরা তোমাদের আত্মার মঙ্গলের জন্য ভাল যা কিছু অগ্রিম প্রেরণ করবে তোমরা তা আল্লাহর নিকট উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসাবে মহত্তর পাবে।” (সূরা মুযযাম্মিল ২০ আয়াত)
@এর অর্থ হলো, আখেরাতের জন্য যা কিছু তোমরা আগেই পাঠিয়ে দিয়েছো তা তোমাদের ঐ সব জিনিসের চেয়ে অনেক বেশী উপকারী যা তোমরা দুনিয়াতেই রেখে দিয়েছো এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্ত কোন কল্যাণকর কাজে ব্যয় করোনি। হাদীসে উল্লেখ আছে, একবার রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের এমন কেউ আছে যার নিজের অর্থ-সম্পদ তার উত্তরাধিকারীর অর্থ-সম্পদের চেয়ে তার কাছে বেশী প্রিয়? জবাবে লোকেরা বললো, “হে আল্লাহ্র রাসূল, আমাদের মধ্যে কেউ-ই এমন নেই যার নিজের অর্থ-সম্পদ তাঁর কাছে তার উত্তরাধিকারীর অর্থ-সম্পদ থেকে বেশী প্রিয় নয়।” তখন তিনি বললেনঃ ‘তোমরা কি বলছো তা ভেবে দেখো।’ লোকেরা বললো, হে আল্লাহ্র রাসূল, আমাদের অবস্থা আসলেই এরূপ। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের নিজের অর্থ-সম্পদ তো সেইগুলো যা তোমরা আখেরাতের জন্য অগ্রিম পাঠিয়ে দিয়েছো। আর যা তোমরা রেখে দিয়েছো সেগুলো ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের অর্থ-সম্পদ৷ [বুখারী: ৬৪৪২] [ইবন কাসীর]
@অর্থাৎ, নফল নামাযসমূহ, সাদাকা-খয়রাত এবং অন্যান্য যে সব সৎকর্মই করবে, আল্লাহর কাছে তার উত্তম প্রতিদান পাবে। অধিকাংশ মুফাসসিরের নিকট ২০ নং এই আয়াতটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই জন্য তাঁরা বলেন যে, এর অর্ধেক অংশ মক্কায় এবং অর্ধেক অংশ মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। (আইসারুত্ তাফাসীর)
@অর্থাৎ “তোমরা তোমাদের আত্মার মঙ্গলের জন্যে ভাল কাজ যা কিছু অগ্রীম প্রেরণ করবে তোমরা তা পাবে আল্লাহর নিকট। ওটা উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসেবে মহত্তর।
হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমাদের মধ্যে কে নিজের সম্পদের চেয়ে (নিজের) উত্তরাধিকারীর সম্পদকে বেশী ভালবাসে?” সাহাবীগণ উত্তরে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে নিজের সম্পদের চেয়ে উত্তরাধিকারীদের সম্পদকে বেশী ভালবাসে।” তিনি বললেনঃ “যা বলছো চিন্তা করে বল।” তাঁরা বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা তো এটা ছাড়া অন্য কিছু জানি না।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “যে ব্যক্তি যা (আল্লাহর পথে) খরচ করবে তাই শুধু তার নিজের সম্পদ, আর যা সে রেখে যাবে তাই তার উত্তরাধিকারীদের সম্পদ।” (এ হাদীসটি হাফিয আকূল ইয়ালা মুসিলী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী ও সুনানে নাসাঈতেও হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে)
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। অর্থাৎ খুব বেশী বেশী আল্লাহকে স্মরণ কর এবং তোমাদের সমস্ত কার্যে তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। কেননা, তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু ঐ ব্যক্তির উপর যে তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে।
@এর অর্থ হলো, আখেরাতের জন্য যা কিছু তোমরা আগেই পাঠিয়ে দিয়েছো তা তোমাদের ঐ সব জিনিসের চেয়ে অনেক বেশী উপকারী যা তোমরা দুনিয়াতেই রেখে দিয়েছো এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্ত কোন কল্যাণকর কাজে ব্যয় করোনি। হাদীসে উল্লেখ আছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণনা করেছেন যে, এক সময় রসূলুল্লাহ ﷺ জিজ্ঞেস করলেনঃ أَيُّكُمْ مَالُهُ أَحَبُّ إلَيْهِ مِنْ مَالِ وَارِثِهِ "তোমাদের এমন কেউ আছে যার নিজের অর্থ-সম্পদ তার উত্তরাধিকারীর অর্থ-সম্পদের চেয়ে তার কাছে বেশী প্রিয়? জবাবে লোকেরা বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের মধ্যে কেউ-ই এমন নেই যার নিজের অর্থ-সম্পদ তাঁর কাছে তার উত্তরাধিকারীর অর্থ-সম্পদ থেকে বেশী প্রিয় নয়। ” তখন তিনি বললেনঃ “তোমরা কি বলছো তা ভেবে দেখো। ” লোকেরা বললোঃ হে আল্লাহর রসূল, আমাদের অবস্থা আসলেই এরূপ। একথা শুনে নবী ﷺ বললেনঃ إنَّمَا مَالُ أَحَدِكُمْ مَا قَدَّمَ وَمَالُ وَارِثِهِ مَا أَخَّرَ তোমাদের নিজের অর্থ-সম্পদ তো সেই গুলো যা তোমরা আখেরাতের জন্য অগ্রিম পাঠিয়ে দিয়েছো। আর যা তোমরা রেখে দিয়েছো সেগুলো ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের অর্থ-সম্পদ। (বুখারী, নাসায়ী ও মুসনাদে আবু ইয়ালা)।
তিনি আরো বলেছেন,
﴿ وَمَا تُنفِقُواْ مِنۡ خَيۡرٖ فَإِنَّ ٱللَّهَ بِهِۦ عَلِيمٌ ﴾ [البقرة: ٢٧٣]
অর্থাৎ “আর তোমরা যা কিছু ধন-সম্পদ দান কর, আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত।” (সূরা বাক্বারাহ ২৭৩ আয়াত)
@ মুশরিকদেরকে দান করা প্রসঙ্গ
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, মুসলিম সাহাবীগণ তাঁদের মুশরিক আত্মীয়দের সাথে আদান-প্রদান করতে অপছন্দ করতেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে এই সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয়। তখন এই ২৭২নং আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং তাঁদেরকে তাঁদের মুশরিক আত্মীয়দের সাথে লেনদেন করার অনুমতি দেয়া হয়। (হাদীসটি সহীহ। সুনান নাসাঈ -৬/৩০৫/১১০৫২, মুসতাদরাক হাকিম-২/২৮৫) ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেনঃ ‘সাদাকাহ শুধুমাত্র মুসলিমদেরকে দেয়া হবে।’ যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘ভিক্ষুক যে কোন মতাবলম্বী হোক কেন, তোমরা তাদেরকে সাদাকাহ প্রদান করো। (হাদীসটি য‘ঈফ। তাফসীর ইবনু আবী হাতিম)
আসমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটি-
﴿لَا یَنْهٰىكُمُ اللهُ عَنِ الَّذِیْنَ لَمْ یُقَاتِلُوْكُمْ فِی الدِّیْنِ وَلَمْ یُخْرِجُوْكُمْ مِّنْ دِیَارِكُمْ﴾
‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি, আর তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ী থেকে বের করে দেয়নি’ (৬০ নং মুমতাহিনাহ, আয়াত-৮) এই আয়াতের তাফসীরে ইনশা’আল্লাহ্ আসবে। এখানে মহান আল্লাহ্ বলেন, وَمَاتُنفِقُوْامِنْخَيْرٍفَلانفُسِكُمْ ‘তোমরা যা কিছু খরচ করবে তা নিজেদের উপকারের জন্যই করবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
﴿وَ مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِاَنْفُسِهِمْ یَمْهَدُوْنَ﴾
যারা সৎ কাজ করে তারা নিজেদেরই জন্য রচনা করে সুখ-শয্যা। (৩০ নং সূরাহ্ রূম, আয়াত নং ৪৪) অপর আয়াতে মহান আল্লাহ্ আরো বলেনঃ
﴿ مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِهٖ﴾
যে ব্যক্তি ভালো কাজ করলো তা তার নিজের জন্যই করলো। (৪১ নং সূরাহ্ হা-মীম সাজদাহ, আয়াত নং ৪৬) এ ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে।
অতঃপর মহান আল্লাহ্ বলেনঃ وَمَاتُنْفِقُوْنَإِلَّاابْتِغَاءوَجْهِاللهِ হাসান বাসরী (রহঃ) বলেনঃ ‘মুসলিমের প্রত্যেক খরচ মহান আল্লাহ্র জন্যই হয়ে থাকে, যদিও সে নিজেই খায় ও পান করে।’ (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ৩/১১৫) ‘আতা খুরাসানী (রহঃ) এর ভাবার্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ যখন তুমি মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দান করবে তখন দান গ্রহীতা যে কেউ হোক না কেন এবং যে কোন কাজই করুক না কেন তুমি তার পূর্ণ প্রতিদান লাভ করবে।’ (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ৩/১১৫) এই ভাবার্থটিও খুব উত্তম। মোট কথা এই যে, সৎ উদ্দেশ্যে দানকারীর প্রতিদান যে মহান আল্লাহ্র দায়িত্বে রয়েছে তা সাব্যস্ত হয়ে গেলো। এখন সেই দান কোন সৎ লোকের হাতেই যাক বা কোন মন্দ লোকের হাতেই যাক, এতে কিছু যায় আসে না। সে তার সৎ উদ্দেশের কারণে প্রতিদান পেয়েই যাবে। যদিও সে দেখে-শুনে ও বিচার-বিবেচনা করে দান করে থাকে অতঃপর ভুল হয়ে যায় তাহলে তার দানের সাওয়াব নষ্ট হবে না। এ জন্য আয়াতের শেষে প্রতিদান প্রাপ্তির সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
قَالَ رَجُلٌ لَأَتَصَدَّقَنَّ اللَّيْلَةَ بِصَدَقَةٍ، فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِي يَدِ زَانِيَةٍ، فَأَصْبَحَ النَّاسُ يَتَحَدَّثُونَ: تُصُدِّقَ عَلَى زَانِيَةٍ، فَقَالَ: اللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى زَانِيَةٍ، لَأَتَصَدَّقَنَّ اللَّيْلَةَ بِصَدَقَةٍ فَوَضَعَهَا فِي يَدِ غَنِيٍّ، فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ: تُصُدِّقَ الليلة على غني، قال: اَللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى غَنِيٍّ، لَأَتَصَدَّقَنَّ اللَّيْلَةَ بصدقة، فخرج فَوَضَعَهَا فِي يَدِ سَارِقٍ فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ: تُصُدِّقَ اللَّيْلَةَ عَلَى سَارِقٍ، فَقَالَ: اَللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى زَانِيَةٍ وَعَلَى غَنِيٍّ وَعَلَى سَارِقٍ، فَأُتِيَ فَقِيلَ لَهُ: أَمَّا صَدَقَتُكَ فَقَدْ قُبِلَتْ، وَأَمَّا الزَّانِيَةُ فَلَعَلَّهَا أَنْ تَسْتَعِفَّ بِهَا عَنْ زِنَاهَا، وَلَعَلَّ الْغَنِيَّ يَعْتَبِرُ فَيُنْفِقُ مِمَّا أَعْطَاهُ اللَّهُ، وَلَعَلَّ السَّارِقَ أَنْ يَسْتَعِفَّ بِهَا عَنْ سَرِقَتِهِ.
‘এক ব্যক্তি ইচ্ছা করলোঃ ‘আজ আমি রাতে দান করবো।’ অতঃপর সে দান নিয়ে বের হয় এবং একটি ব্যভিচারিনীর হাতে দিয়ে দেয়। সকালে জনগণের মধ্যে এই কথা নিয়ে সমালোচনা হতে থাকে যে, এক ব্যভিচারিণীকে সাদাকাহ দেয়া হয়েছে। এ কথা শুনে লোকটি বললোঃ ‘হে মহান আল্লাহ্! আপনার জন্যই সমস্ত প্রশংসা যে, আমার দান ব্যভিচারিণীর হাতে পড়েছে।’ আবার সে বললোঃ ‘আজ রাতেও আমি অবশ্যই সাদাকাহ প্রদান করবো। অতঃপর এক ধনী ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়। আবার সকালে জনগণ আলোচনা করতে থাকে যে, রাতে এক ধনী লোককে দান করা হয়েছে। সে বললোঃ হে মহান আল্লাহ্! আপনার জন্যই সমুদয় প্রশংসা যে, আমার দান একজন ধনী ব্যক্তির ওপরে পড়েছে।’ আবার সে বললোঃ ‘আজ রাতেও আমি অবশ্যই দান করবো।’ অতঃপর সে এক চোরের হাতে দিয়ে দেয়। সকালে পুনরায় জনগণের মধ্যে আলোচনা হতে থাকে যে, রাতে এক চোরকে সাদাকাহ দেয়া হয়েছে। তখন সে বললোঃ হে মহান আল্লাহ্! আপনার জন্য সমস্ত প্রশংসা যে, আমার ব্যভিচারিণী, ধনী ও চোরের হাতে পড়েছে।’ অতঃপর সে স্বপ্নে দেখে যে, একজন ফিরিশতা এসে বলেছেনঃ তোমার দানগুলো মহান আল্লাহ্র নিকট গৃহীত হয়েছে। সম্ভবত দুশ্চরিত্র নারীটি তোমার দান পেয়ে ব্যভিচার থেকে বিরত থাকবে,হয়তো ধনী লোকটি এর দ্বারা শিক্ষা গ্রহণ করবেন এবং সেও দান করতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে, আর হতে পারে যে, মাল পেয়ে চোরটি চুরি করা ছেড়ে দিবে।’ (সহীহুল বুখারী-৩/৩৪০/১৪২১, ফাতহুল বারী -৩/৩৪০, সহীহ মুসলিম-২/৭০৯/৭৮, মুসনাদ আহমাদ -২/৩২২)
কে দান-সাদাকাহ পাওয়ার যোগ্য
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ ﴿لِلْفُقَرَآءِالَّذِیْنَاُحْصِرُوْافِیْسَبِیْلِاللّٰهِ﴾ সাদাকাহ ঐ মুহাজিরদের প্রাপ্য যারা ইহলৌকিক সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বদেশ পরিত্যাগ করে, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে একমাত্র মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কাছে মাদীনায় উপস্থিত হয়েছে। তাদের জীবন যাপনের এমন কোন উপায় নেই যা তাদের জন্য যথেষ্ট হতে পারে এবং তারা সফরও করতে পারে না যে, চলে-ফিরে নিজেদের খাওয়া পরার ব্যবস্থা করতে পারে।’ অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ্ বলেনঃ ﴿ وَ اِذَا ضَرَبْتُمْ فِی الْاَرْضِ فَلَیْسَ عَلَیْكُمْ جُنَاحٌ اَنْ تَقْصُرُوْا مِنَ الصَّلٰوةِ ﴾
‘আর যখন তোমরা ভূ-পৃষ্ঠে ভ্রমণ করো তখন সালাত সংক্ষেপ করলে তোমাদের কোন অপরাধ নেই।’ (৪ নং সূরাহ্ নিসা, আয়াত নং ১০১) অন্যত্র মহান আল্লাহ্ আরো বলেনঃ
﴿عَلِمَ اَنْ سَیَكُوْنُ مِنْكُمْ مَّرْضٰى١ۙ وَ اٰخَرُوْنَ یَضْرِبُوْنَ فِی الْاَرْضِ یَبْتَغُوْنَ مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ١ۙ وَ اٰخَرُوْنَ یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ ﴾
‘মহান আল্লাহ্ জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, কেউ কেউ মহান আল্লাহ্র অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ ভ্রমণ করবে এবং কেউ কেউ মহান আল্লাহ্র পথে সংগ্রামে লিপ্ত হবে।’ (৭৩ নং সূরাহ্ মুয্যাম্মিল, আয়াত নং ২০) তাদের অবস্থা যাদের জানা নেই তারা তাদের বাহ্যিক পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে এবং কথা-বার্তা শুনে তাদেরকে ধনী মনে করে। বিশুদ্ধ হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
لَيْسَ الْمِسْكِينُ بِهَذَا الطَّوَّافِ الَّذِي تَرُدُّهُ التَّمْرَةُ وَالتَّمْرَتَانِ، وَاللُّقْمَةُ وَاللُّقْمَتَانِ، وَالْأُكْلَةُ وَالْأُكْلَتَانِ، وَلَكِنَّ الْمِسْكِينَ الَّذِي لَا يَجِدُ غِنًى يُغْنِيهِ، وَلَا يُفْطَنُ لَهُ فَيُتَصَدقَ عَلَيْهِ، وَلَا يَسْأَلُ النَّاسُ شَيْئًا.
‘ঐ ব্যক্তি মিসকীন নয়, যে বাড়ী বাড়ী ঘুরে বেড়ায়, কোথায়ও হয়তো একটি খেজুর পেলো, কোথায়ও হয়তো দু’এক গ্রাস খাবার পেলো, আবার কোন জায়গায় হয়তো দু’একদিনের খাদ্য প্রাপ্ত হলো। বরং মিসকীন ঐ ব্যক্তি যার নিকট ঐ পরিমাণ খাদ্য নেই যার দ্বারা সে অমুখাপেক্ষী হতে পারে এবং সে তার অবস্থাও এমন করেনি যার ফলে মানুষ তার অভাব অনুভব করে তার প্রতি কিছু অনুগ্রহ করবে। আবার ভিক্ষা করার অভ্যাসও তার নেই।’ (সহীহুল বুখারী-৩/৩৯৯/১৪৭৯, ফাতহুল বারী -৩/৩৯৯, সহীহ মুসলিম-২/১০১/৭১৯, মুসনাদ আহমাদ -২/৩১৬) ইমাম আহমাদ (রহঃ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (মুসনাদ আহমাদ -১/৩৮৪) কিন্তু যাদের অন্তরদৃষ্টি রয়েছে তাদের কাছে এদের অবস্থা গোপন থাকেনা। যেমন অন্যত্র মহান আল্লাহ্ বলেনঃ ﴿ سِیْمَاهُمْ فِیْ وُجُوْهِهِمْ ﴾
তাদের মুখে সাজদার চিহ্ন থাকবে। (৪৮ নং সূরাহ্ ফাত্হ, আয়াত নং ২৯) অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ্ আরো বলেনঃ
﴿وَ لَتَعْرِفَنَّهُمْ فِیْ لَحْنِ الْقَوْلِ﴾
তুমি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদের চিনতে পারবে। (৪৭ নং সূরাহ্ মুহাম্মাদ, আয়াত নং ৩০) অতঃপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেনঃ
لَا يَسْأَلُوْنَ النَّاسَ إِلْحَافًا
‘তারা কাকুতি মিনতি করে কারো কাছে প্রার্থনা করে না’ অর্থাৎ তারা যাঞ্চার দ্বারা মানুষকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে না এবং তাদের কাছে সামান্য কিছু থাকা অবস্থায় তারা মানুষের কাছে হাত বাড়ায় না। প্রয়োজনের উপযোগী কিছু বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যে ভিক্ষাবৃত্তি পরিত্যাগ করে না তাকেই পেশাগত ভিক্ষুক বলা হয়। ইমাম আহমাদ (রহঃ) বর্ণনা করেন, আবূ সা‘ঈদ (রহঃ) বলেনঃ আমার মা আমাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কাছ থেকে কিছু সাহায্য পাবার উদ্দেশ্যে তাঁর কাছে পাঠালেন। কিন্তু আমি তাঁর কাছে যাওয়ার পর কিছু না চেয়ে ওখানে বসে পড়লাম। তিনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন এবং বললেনঃ যে অল্পতে তুষ্টি লাভ করে মহান আল্লাহ্ তার ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করে দিবেন, যে ব্যক্তি বিনয়ী হবে মহান আল্লাহ্ তাকে সজ্জন হিসাবে চিহ্নিত করবেন, যে ব্যক্তি তার কাছে যা আছে তাতেই খুশি থাকে মহান আল্লাহ্ তার অভাব পূরণ করে দিবেন, যে সামান্য কিছু থাকা সত্ত্বেও মানুষের কাছে যাঞ্চা করে বেড়ায় মহান আল্লাহ্ তার ভিক্ষাবৃত্তি দূর করবেন না। আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) বলেন, আমি মনে মনে বললামঃ আমার তো ‘ইয়াকুতাহ’ নামের একটি উষ্ট্রী রয়েছে যার মূল্য ‘সামান্য কিছুর’ এর চেয়ে অনেক বেশি, সুতরাং আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কাছে কোন কিছু না চেয়ে বরং সেখান থেকে চলে আসি। (হাদীসটি সহীহ। মুসনাদ আহমাদ -৪/১৩৮, আল মাজমা‘উয যাওয়ায়িদ-৩/৯৫, সুনান আবূ দাঊদ ২/২৭৯, সুনান নাসাঈ -৫/৯৫)
অতঃপর মহান আল্লাহ্ বলেনঃ ﴿وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَیْرٍ فَاِنَّ اللّٰهَ بِه عَلِیْمٌ﴾ তোমাদের সমস্ত দান সম্বন্ধে মহান আল্লাহ্ সম্যক অবগত রয়েছেন।’ অতএব যখন তোমরা সম্পূর্ণরূপে তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে যাবে তখন তিনি তোমাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দিবেন। তাঁর নিকট কোন কিছুই গোপন নেই।
আল কুর’আনে দান-সাদাকাকারীর প্রশংসা করা হয়েছে
﴿اَلَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ بِالَّیْلِ وَ النَّهَارِ سِرًّا وَّ عَلَانِیَةً فَلَهُمْ اَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ١ۚ وَ لَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَ لَا هُمْ یَحْزَنُوْنَؔ﴾
এরপর মহান আল্লাহ্ ঐসব লোকের প্রশংসা করেছেন যারা মহান আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর পথে খরচ করে। তাদেরকেও প্রতিদান দেয়া হবে এবং তারা যে কোন ভয় ও চিন্তা হতে নিরাপত্তা লাভ করবে। পরিবারের খরচ বহন করার কারণেও তাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। যেমন সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে, মাক্কা বিজয়ের বছর এবং অন্য বর্ণনায় রয়েছে, বিদায় হাজ্জের বছর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) -কে রোগাক্রান্ত অবস্থায় দেখতে গিয়ে বলেনঃ
وَإِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلَّا ازْدَدْتَ بِهَا دَرَجَةً وَرِفْعَةً، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فِي امْرَأَتِكَ.
‘তুমি মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যা খরচ করবে তিনি এর বিনিময়ে তোমার মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন, এমনকি তুমি স্বয়ং তোমার স্ত্রীকে যা খাওয়াবে তারও প্রতিদান তোমাকে দেয়া হবে।’ (সহীহুল বুখারী-১/১৬৫/৫২, ৩/১৯৬/১২৯৫, ৭/৭১২/৪৪০৯, ফাতহুল বারী -৩/১৯৬, সহীহ মুসলিম-৩/১২৫০,১২৫১,/৫, সুনান আবূ দাউদ-৩/১১২/২৮৬৪, জামি‘ তিরমিযী-৪/৩৭৪/২১১৬, মুওয়াত্তা ইমাম মালিক-২/৪/৭৬৩, মুসনাদ আহমাদ -১/১৭৯) মুসনাদ আহমাদে রয়েছে যেঃ إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا أَنْفَقَ عَلَى أَهْلِهِ نَفَقَةً يَحْتَسِبُهَا كَانَتْ لَهُ صَدَقَةً.
‘মুসলিম ব্যক্তি সাওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে নিজের ছেলে-মেয়ের জন্য যা খরচ করে তাও সাদাকাহ।’ ইমাম বুখারী (রহঃ) মুসলিম (রহঃ) ’ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (সহীহুল বুখারী- ১/১৯৫/৫৫, মুসনাদ আহমাদ -৪/১২২, ফাতহুল বারী -১/৫৫, সহীহ মুসলিম-২/৬৯৫/৪৮)
মহান আল্লাহ্র আনুগত্য লাভ করার উদ্দেশ্যে যারা রাতে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে নিজেদের ধন-সম্পদ থেকে ব্যয় করে, তাদের প্রভুর নিকট তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না।
@এখানে যেসব লোকের কথা বলা হয়েছে, তারা হচ্ছে এমন একদল লোক যারা আল্লাহর দ্বীনের খেদমতে নিজেদেরকে কায়মনোবাক্যে সাবর্ক্ষণিকভাবে উৎসর্গ করে দিয়েছিল। তাদের সমস্ত সময় এই দ্বীনি খেদমতে ব্যয় করার কারণে নিজেদের পেট পালার জন্য কিছু কাজকাম করার সুযোগ তাদের ছিল না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এই ধরনের স্বেচ্ছাসেবীদের এটি স্বতন্ত্র দল ছিল। ইতিহাসে তাঁরা ‘আসহাবে সুফ্ফা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। এরা ছিলেন তিন চারশো লোকের একটি দল। নিজেদের বাড়ি ঘর ছেড়ে দিয়ে এরা মদীনায় চলে এসেছিলেন। সর্বক্ষণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির থাকতেন। তাঁর সাথে সাথে থাকতেন। তিনি যখন যাকে যেখানে কোন কাজে বা অভিযানে প্রয়োজন তাদের মধ্যে থেকে নিয়ে পাঠিয়ে দিতেন। মদীনার বাইরে কোন কাজ না থাকলে তারা মদীনায় অবস্থান করে দ্বীনী ইল্ম হাসীল করতেন এবং অন্যদেরকে তার তালিম দিতেন। যেহেতু তাঁরা ছিলেন সার্বক্ষনিক কর্মী এবং নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার মতো ব্যক্তিগত উপকরণও তাঁদের ছিল না, তাই মহান আল্লাহ সাধারণ মুসলমানদের দৃষ্টি তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে বিশেষ করে তাদেরকে সাহায্য করাকে আল্লাহ পথে ব্যয়ের সবোর্ত্তম খাত বলে উল্লেখ করেছেন।
@এরপর খরচ করার খাতগুলোর মধ্য থেকে বিশেষ করে একটি খাত সম্পর্কে এখানে বর্ণনা করা হচ্ছে; এখানে মোমেনদের একটি দলের জন্যে এক বিশেষ মর্যাদার কথা ঘোষণা করা হয়েছে, এমন এক মর্যাদার কথা তুলে ধরা হয়েছে যা শুনলে চেতনাগুলি সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে, অন্তরসমূহ আবেগে প্রকম্পিত হয় এবং যেনো এক স্নেহের পরশ লেগে তার মন নিরুদ্বিগ্ন হয়ে যায় । তখন সে কোনো হীনতা বোধ করে না, তার মন এমনভাবে হালকা হয়ে যায় যে, কোনো উদ্বেগ তাকে আর স্পর্শ করতে পারে না, তার সব প্রশ্ন থেকে যায় এবং মুগ্ধ আবেশে তার কথা বন্ধ হয়ে যেতে চায়। বলা হয়েছে, "দান খয়রাতের প্রাপকদের মধ্যে এমন অভাবগ্রস্ত মোহাজের সম্প্রদায় আছে যারা আল্লাহ তায়ালার পথে থাকার কারণে আবদ্ধ হয়ে গেছে। তাদের রুজি রোজগারের পথ বদ্ধ হয়ে গিয়েছে, তুমি তাদেরকে তাদের চেহারা দেখে চিনতে পারবে দেখবে । সেখানে দুঃখ কষ্ট ও দৈন্যের ছাপ লেগে আছে। তারা মানুষের হাত জড়িয়ে ধরে তাদের কাছে কিছু চায় না। এদের জন্যে যা কিছু তোমরা খরচ করো তা আল্লাহ্ তায়ালা জানেন। এই প্রাণবন্ত গুণটি মোহাজেরদের একটি দলের ওপর প্রযোজ্য ছিলো, যারা হিজরত করতে গিয়ে তাদের ধন সম্পদ ও পরিবার বর্গ পেছনে ফেলে এসেছিলেন এবং মদীনায় আসার পর আল্লাহর পথে জেহাদে ও আল্লাহ্র রসূলের পাহারাদারীতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, যেমন করে হেফাযতের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন রসূল (স.)-এর জন্যে আসহাবে সুফফার ব্যক্তিরা যাদের কারণে কোনো দুশমন সেদিকে কুদৃষ্টিতে তাকাতেও সাহস পেতো না। এরা জেহাদের কাজে এতোটা নিবেদিত প্রাণ হয়ে গিয়েছিলেন যে, কোনো ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে তারা বিদেশে ভ্রমণ করতে পারতেন না। এতদসত্ত্বেও তারা কারো কাছে কিছু চাইতেন না। আত্মসস্ত্রম বোধ সম্পন্ন এই সম্মানিত সাহাবারা তাদের প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত না করায় সাধারণ মূর্থ লোকেরা তাদেরকে সচ্ছল মনে করতো এবং তাদের আসল অবস্থাটা বুঝতে না পারায় তাদেরকে তারা সম্পদশালী মনে করতো । কিন্তু আয়াতটিতে উল্লেখিত কথাগুলো সাধারণভাবে সকল যামানার ও সব মানুষের জন্যেই প্রযোজ্য । এ কথাগুলো তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছিলো যারা প্রকৃতপক্ষে বড়োই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন, বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যারা কোনো রোযগার করতে পারতো না, আর তাদের আত্মসম্ভ্রমবোধ তাদেরকে কারো কাছে হাত পাততেও দিতো না এবং তাদের অভাব অন্যের কাছে প্রকাশ পায় তাও তারা পছন্দ করতেন না। এইসব অবস্থার কারণে সাধারণ ও আনাড়ী গোছের মানুষরা তাদের বাহ্যিক অবস্থা দৃষ্টে এবং তাদের বিনয় নম্রতা ও সততার কারণে তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করতো । কিন্তু তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন ও তীক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিরা খোলা দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে তাদের বাহ্যিক প্রশান্ত চেহারার অন্তরালে লুক্কায়িত তাদের তীব্র দারিদ্রতাকে দেখতে পেতেন। সে দারিদ্রের ছাপ তাদের চেহারায় পরিস্ফুট হয়ে না-উঠলেও তাদের দেখে তারা তাদের কষ্ট বুঝতেন । যদিও লজ্জায় তাঁদের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুতো না। এই ছোট্ট আয়াতটির মধ্যে এ সম্ভ্রমপূর্ণ অবস্থার যে ছবি আঁকা হয়েছে তা অনুভূতিশীল লোকের অন্তরে গভীরভাবে দাগ কাটে । আলোচ্য আয়াতটির মধ্যে তাদের লজ্জাবনত ভাবের এক বাস্তব ছবি যেনো মূর্ত হয়ে উঠেছে। এ পর্যায়ে উল্লেখিত প্রতিটি বাক্য তাদের জন্যে অনুভুতিশীল প্রত্যেক হৃদয়াভ্যন্তরে যেনো মোহাব্বাতের এক কোমল পরশ বুলিয়ে দিতে চায় । তাদের এই আত্মমর্যাদাবোধ ছবির মতো ভেসে ওঠে যে কোনো অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের কাছে। তখন তাদের চেতনা এমনভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে যে, তাৎক্ষণিকভাবে ওদের জন্যে কিছু করার উদ্দেশ্যে তাদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে । এই আয়াতটি পাঠ করার সাথে সাথে ওই চেহারাগুলো এবং ওই ব্যক্তিত্বগুলো এমনভাবে পাঠকের হৃদয়পটে ভেসে ওঠে যেন মনে হয় তারা ও তাদেরকে চাক্ষুষ আপন দেখতে পাচ্ছে। এই-ই হচ্ছে মানবতার উদাহরণ তুলে ধরার জন্যে কোরআনে কারীমের মধ্যে উল্লেখিত হৃদয়গ্রাহক পদ্ধতি যার ফলে কোনো অবস্থা জীবন্ত রূপ নিয়ে অনুভূতির দুয়ারে সাড়া জাগায় । তারাই হচ্ছেন সেই সম্ভ্রমশীল ও মহান অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি যারা তাদের অভাবকে তাদের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার মতোই গোপন করে রাখেন ৷ তাদেরকে গোপনেই দান করা উচিত যেন তাদের বিবেকে কোনো আঘাত না লাগে এবং তাদের আত্মমর্যাদা আহত না হয়, আর এই কারণেই ওসব ব্যক্তিকে গোপনে সদকা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে, যাতে শুধুমাত্র আল্লাহর জ্ঞানেই তা ধরা পড়ে এবং তার কাছ থেকেই একমাত্র তার প্রতিদান পাওয়ার আশা করা যায়।এই জন্যেই এরশাদ হয়েছে, 'তোমরা যা কিছু খরচ করো সে বিষয়ে অবশ্যই আল্লাহ্ তায়ালা খবর রাখেন ।' একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালাই নিভৃত হৃদয়ের গোপন কথার খবর রাখবেন এবং তাঁর দৃষ্টি থেকে ভালো কোনো কিছু বাদ পড়ে যায় না।
এ বিষয়ে সুবিদিত আয়াত অনেক রয়েছে। উক্ত মর্মের হাদীসসমূহ নিম্নরূপঃ
১/৯৬। আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আমার কোন বন্ধুর সাথে শত্রুতা করবে, তার বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধের ঘোষণা রইল। আমার বান্দা যে সমস্ত জিনিস দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করে, তার মধ্যে আমার নিকট প্রিয়তম জিনিস হল তা---যা আমি তার উপর ফরয করেছি। (অর্থাৎ ফরয ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করা আমার নিকটে বেশী পছন্দনীয়।)
আর আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে, পরিশেষে আমি তাকে ভালবাসতে লাগি। অতঃপর যখন আমি তাকে ভালবাসি, তখন আমি তার ঐ কান হয়ে যাই, যার দ্বারা সে শোনে, তার ঐ চোখ হয়ে যাই, যার দ্বারা সে দেখে, তার ঐ হাত হয়ে যাই, যার দ্বারা সে ধরে এবং তার ঐ পা হয়ে যাই, যার দ্বারা সে চলে! আর সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, তাহলে আমি তাকে দিই এবং সে যদি আমার আশ্রয় চায় তাহলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় দিই।’’[সহীহুল বুখারী ৬৫০২]
আমি তার কান হয়ে যাই----। অর্থাৎ আমার সন্তুষ্টি মোতাবেক সে শোনে, দেখে, ধরে ও চলে।[গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ৯৬]
- باب المجاهدة فالأول: عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: "إن الله تعالى قال: من عادى لي وليا فقد آذنته بالحرب. وما تقرب إلي عبدي بشيء أحب إلي مما افترضت عليه، وما يزال عبدي يتقرب إلي بالنوافل حتى أحبه، فإذا أحببته كنت سمعه الذي يسمع به، وبصره الذي يبصر به، ويده التي يبطش بها، ورجله التي يمشي بها، وإن سألني أعطيته؛ ولئن استعاذني لأعيذنه" (رواه البخاري).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১১৩
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১৭/১১৩। আবূ যার্র জুন্দুব ইবনু জুনাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুমহান প্রভু হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি (আল্লাহ) বলেন, ‘‘হে আমার বান্দারা! আমি অত্যাচারকে আমার নিজের জন্য হারাম করে দিয়েছি এবং আমি তা তোমাদের মাঝেও হারাম করলাম। সুতরাং তোমরাও একে অপরের প্রতি অত্যাচার করো না। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই পথভ্রষ্ট; কিন্তু সে নয় যাকে আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি। অতএব তোমরা আমার নিকট সঠিক পথ চাও আমি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখাব। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই ক্ষুধার্ত; কিন্তু সে নয় যাকে আমি খাবার দিই। সুতরাং তোমরা আমার কাছে খাবার চাও, আমি তোমাদেরকে খাবার দেব। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই বস্ত্রহীন; কিন্তু সে নয় যাকে আমি বস্ত্র দান করেছি। সুতরাং তোমরা আমার কাছে বস্ত্র চাও, আমি তোমাদেরকে বস্ত্রদান করব। হে আমার বান্দারা! তোমরা দিন-রাত পাপ করে থাক, আর আমি সমস্ত পাপ ক্ষমা করে থাকি। সুতরাং তোমরা আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেব। হে আমার বান্দারা! তোমরা কখনো আমার অপকার করতে পারবে না এবং কখনো আমার উপকারও করতে পারবে না।
হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ মানুষ ও জ্বিন সকলেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একজন পরহেযগার ব্যক্তির হৃদয়ের মত হৃদয়বান হয়ে যায়, তাহলে এটা আমার রাজত্বের কোন কিছু বৃদ্ধি করতে পারবে না। হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ মানুষ ও জ্বিন সকলেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একজন পাপীর হৃদয়ের মত হৃদয়ের অধিকারী হয়ে যায়, তাহলে এটা আমার রাজত্বের কোন কিছুই কমাতে পারবে না। হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ তোমাদের মানুষ ও জ্বিন সকলেই একটি খোলা ময়দানে একত্রিত হয়ে আমার কাছে প্রার্থনা করে, আর আমি তাদের প্রত্যেককে তার প্রার্থিত জিনিস দান করি, তাহলে (এ দান) আমার কাছে যে ভান্ডার আছে, তা হতে ততটাই কম করতে পারবে, যতটা সূঁচ কোন সমুদ্রে ডুবালে তার পানি কমিয়ে থাকে। হে আমার বান্দারা! আমি তোমাদের কর্মসমূহ তোমাদের জন্য গুণে রাখছি। অতঃপর আমি তোমাদেরকে তার পূর্ণ বিনিময় দেব। সুতরাং যে কল্যাণ পাবে, সে আল্লাহর প্রশংসা করুক। আর যে ব্যক্তি অন্য কিছু (অর্থাৎ অকল্যাণ) পাবে, সে যেন নিজেকেই তিরস্কার করে।’’
(হাদীসের একজন বর্ণনাকারী) সাঈদ বলেন, আবূ ইদরীস (এই হাদীসের অন্য একজন বর্ণনাকারী) যখন এই হাদীস বর্ণনা করতেন, তখন হাঁটু গেড়ে বসে যেতেন।[মুসলিম ২৫৭৭, ২৪৯৫, ইবনু মাজাহ ৪২৫৭, আহমাদ ২০৮৬০, ২০৯১১, ২১০৩০, দারেমী ২৭৮৮ হাদিসের মানঃ সহিহ]।
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ৯৭
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
২/৯৭। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মহান প্রভু হতে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যখন বান্দা আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, তখন আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। যখন সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয় তখন আমি তার দিকে দু’হাত অগ্রসর হই। আর যখন সে আমার দিকে হেঁটে আসে তখন আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।’’[সহীহুল বুখারী ৭৫৩৬, ৭৪০৫, ৭৫০৫, ৭৫২৭, মুসলিম ২৬৭৫, তিরমিযী ২৩৮৮, ৩৬০৩, ইবনু মাজাহ ৩৮২২, আহমাদ ৭৩৭৪, ২৭৪০৯, ৮৪৩৬ ]
( باب المجاهدة الثاني: عن أنس رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم فيما يرويه عن ربه عز وجل قال: " إذا تقرب العبد إلي شبراً تقربت إليه ذراعاً، وإذا تقرب إلي ذراعاً تقربت منه باعاً، وإذا أتاني يمشي أتيته هرولة" (رواه البخاري).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ৯৮
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৩/৯৮। ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘এমন দুটি নিয়ামত আছে, বহু মানুষ সে দু’টির ব্যাপারে ধোঁকায় আছে। (তা হল) সুস্থতা ও অবসর।’’[সহীহুল বুখারী ৬৪১২, তিরমিযী ২৩০৪, ইবনু মাজাহ ৪১৭০, আহমাদ ২৩৩৬, ৩১৯৭, দারেমী ২৭০৭ ]
- باب المجاهدة الثالث: عن ابن عباس رضي الله عنهما قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: " نعمتان مغبون فيهما كثير من الناس: الصحة، والفراغ" (رواه البخاري).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ৯৯
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৪/৯৯। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে (এত দীর্ঘ) কিয়াম করতেন যে, তাঁর পা দুখানি (ফুলে) ফেটে (দাগ পড়ে) যেত। একদা আমি তাঁকে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এরূপ কাজ কেন করছেন? আল্লাহ তো আপনার আগের ও পিছের সমস্ত পাপ মোচন করে দিয়েছেন।’ তিনি বললেন, ‘‘আমি কি তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দা হতে পছন্দ করব না?’’[সহীহুল বুখারী ৪৮৩৭, ১১১৮, ১১১৯, ১১৪৮, ১১৬১, ১১৬২, ১১৬৮, মুসলিম ৭৩১, ২৮২০, তিরমিযী ৪১৮, নাসায়ী ১৬৪৮, ১৬৪৯, ১৬৫০, আবূ দাউদ ১২৬২, ১২৬৩, ১৬৪৯, ১৬৫০, ইবনু মাজাহ১২২৬, ১২২৭ ]।
باب المجاهدة الرابع: عن عائشة رضي الله عنها أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يقوم من الليل حتى تنفطر قدماه، فقلت له: لم تصنع هذا يا رسول الله، وقد غفر الله لك ما تقدم من ذنبك وما تأخر؟! قال: " أفلا أحب أن أكون عبداً شكوراً؟" (متفق عليه. هذا لفظ البخاري، ونحوه في الصحيحين من رواية المغيرة بن شعبة).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০১
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৫/১০১। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহ বলেন, ‘যখন (রমযানের শেষ) দশক শুরু হত, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত জাগতেন, নিজ পরিবারকে জাগাতেন, (ইবাদতে) খুবই চেষ্টা করতেন এবং (এর জন্য) তিনি কোমর বেঁধে নিতেন।’[সহীহুল বুখারী ২০২৪, মুসলিম ১১৭৪, তিরমিযী ৭৯৬, নাসায়ী ১৬৩৯, আবূ দাউদ ১৩৭৬, ইবনু মাজাহ ১৭৬৮, আহমাদ ২৩৬১১, ১২৩৮৫৬, ২৩৮৬৯ ]।
- باب المجاهدة الخامس: عن عائشة رضي اللَّه عنها أنها قالت: »آان رسولُ اللَّه صَلّى االلهُ عَلَيْهِ وسَلَّم إذَا دَخَلَ الْعشْرُأحيا اللَّيْل،َ وأيقظ أهْله،ْ وجدَّ وشَدَّ المِئْزَرَ« متفقٌ عليه.والمراد: الْعشْرُ الأواخِرُ من شهر رمضان: »وَالمِئْزَر«: الإِزارُ وهُو آِنايَةٌ عن اعْتِزَال النِّساء،ِ وقِيلَ: المُرادُتشْمِيرهُ للعِبادَةِ. يُقالُ: شَددْتُ لِهذا الأمرِ مِئْزَرِي، أيْ: تشمرتُ وَتَفَرَّغتُ لَه
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০২
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৬/১০২। আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, (দেহমনে) সবল মু’মিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা বেশী প্রিয়। আর প্রত্যেকের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। তুমি ঐ জিনিসে যত্নবান হও, যাতে তোমার উপকার আছে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর ও উৎসাহহীন হয়ো না। যদি তোমার কিছু ক্ষতি হয়, তাহলে এ কথা বলো না যে, ‘যদি আমি এ রকম করতাম, তাহলে এ রকম হত।’ বরং বলো, ‘আল্লাহর (লিখিত) ভাগ্য এবং তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন।’ কারণ, ‘যদি’ (শব্দ) শয়তানের কাজের দুয়ার খুলে দেয়।[সহীহুল বুখারী ২৬৬৪, ইবনু মাজাহ ৭৯, ৪১৬৮, আহমাদ ৮৫৭৩, ৮৬১১]
باب المجاهدة عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: " المؤمن القوي خير وأحب إلى الله من المؤمن الضعيف وفي كل خير. احرص على ما ينفعك، واستعن بالله ولا تعجز. وإن أصابك شيء فلا تقل: لو أني فعلت كان كذا وكذا، ولكن قل: قدر الله، وما شاء فعل؛ فإن لو تفتح عمل الشيطان" ( رواه مسلم).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৩
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৭/১০৩। আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘জাহান্নামকে মনোলোভা জিনিসসমূহ দ্বারা ঘিরে দেওয়া হয়েছে এবং জান্নাতকে ঘিরে দেওয়া হয়েছে কষ্টসাধ্য কর্মসমূহ দ্বারা।’’[সহীহুল বুখারী ৬৪৮৭, তিরমিযী ২৫৬০, নাসায়ী ৩৭৬৩, আবূ দাউদ ৪৭৪৪, আহমাদ ৭৪৭৭, ২৭৫১২, ৮৬৪৪, ৮৭২১ ]
‘ঘিরে দেওয়া হয়েছে’ অর্থাৎ ঐ জিনিস বা কর্ম জাহান্নাম বা জান্নাতের মাঝে পর্দাস্বরূপ, যখনই কেউ তা করবে, তখনই সে পর্দা ছিঁড়ে তাতে প্রবেশ করবে।
باب المجاهدة السابع: عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: " حجبت النار بالشهوات، وحجبت الجنة بالمكاره" (متفق عليه).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৪
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৮/১০৪। আবূ আব্দুল্লাহ হুযাইফা ইবনু ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন যে, আমি এক রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে নামায পড়লাম। তিনি সূরা বাক্বারাহ পড়তে আরম্ভ করলেন। অতঃপর আমি মনে মনে) বললাম যে, ‘তিনি একশো আয়াত পড়ে রুকুতে যাবেন।’ কিন্তু তিনি (তা না ক’রে) ক্বিরাআত করতে থাকলেন। তারপর আমি (মনে মনে) বললাম যে, ‘তিনি এই সূরা এক রাকাআতে সম্পন্ন করবেন; এটি পড়ে রুকূ করবেন।’ কিন্তু তিনি (সূরা) নিসা আরম্ভ করলেন। তিনি তা সম্পূর্ণ পড়লেন। তারপর তিনি (সূরা) আলে ইমরান শুরু করলেন। সেটিও সম্পূর্ণ পড়লেন। (এত দীর্ঘ ক্বিরাআত সত্ত্বেও) তিনি ধীর শান্তভাবে থেমে থেমে পড়ছিলেন।
যখন কোন এমন আয়াত এসে যেত, যাতে তাসবীহ (আল্লাহর পবিত্রতার বর্ণনা) আছে, তখন তিনি (ক্বিরাআত বন্ধ করে) তাসবীহ (অর্থাৎ সুবহানাল্লাহ) পড়তেন। আর যখন প্রার্থনা সম্বলিত আয়াত এসে যেত, তখন প্রার্থনা করতেন। যখন আশ্রয় চাওয়ার আয়াত আসত, তখন আশ্রয় চাইতেন। অতঃপর তিনি রুকূ করলেন; তাতে তিনি বলতে লাগলেন, ‘সুবহানা রাব্বিয়াল ‘আযীম।’ সুতরাং তাঁর রুকুও তাঁর কিয়ামের (দাড়ানোর) মত দীর্ঘ হয়ে গেল! অতঃপর তিনি ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বললেন ও (রুকু হতে উঠে) প্রায় রুকু সম দীর্ঘ কিয়াম করলেন। অতঃপর তিনি সিজদা করলেন এবং (সাজদায়) তিনি ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’ (দীর্ঘ সময় ধরে) পড়লেন ফলে তাঁর সিজদা তাঁর কিয়ামের সমান হয়ে গেল![মুসলিম ৭৭২, তিরমিযী ২৬২, নাসায়ী ১০০৮, ১০০৯, ১০৪৬, ১০৬৯, ১১৩৩, ১১৪৫, আবূ দাউদ ৮৭১, ৮৭৪, ইবনু মাজাহ ৮৮৮, ৮৯৭, ১০৫১, আহমাদ ২২৭২৯, ২২৭৫০, ২২৭৮৯, দারেমী ১৩০৬ ]
باب المجاهدة عن أبي عبد الله حذيفة بن اليمان، رضي الله عنهما، قال: صليت مع النبي صلى الله عليه وسلم ذات ليلة، فافتتح البقرة، فقلت يركع عند المائة، ثم مضى؛ فقلت يصلي بها في ركعة، فمضى؛ فقلت يركع بها، ثم افتتح النساء؛ فقرأها، ثم افتتح آل عمران فقرأها، يقرأ مترسلاً إذا مر بآية فيها تسبيح سبح، وإذا مر بسؤال سأل، وإذا مر بتعوذ تعوذ، ثم ركع فجعل يقول: " سبحان ربي العظيم" فكان ركوعه نحواً من قيامه ثم قال: " سمع الله لمن حمده، ربنا لك الحمد" ثم قام قياماً طويلاً قريباً مما ركع، ثم سجد فقال: " سبحان ربي الأعلى" فكان سجوده قريباً من قيامه" (رواه مسلم).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৫
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৯/১০৫। ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন যে, ‘আমি এক রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে নামায পড়লাম। অতঃপর তিনি দীর্ঘ কিয়াম করলেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত আমি খারাপ কাজের ইচ্ছা করলাম।’ তাঁকে প্রশ্ন করা হল যে, ‘আপনি কি ইচ্ছা করেছিলেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি ইচ্ছা করেছিলাম যে, আমি বসে যাই এবং (তাঁর অনুসরণ) ছেড়ে দিই।’[সহীহুল বুখারী ১১৩৫, মুসলিম ৭৭৩, ইবনু মাজাহ ১৪১৮, ১৩৩৮, ৩৭৫৭, ৩৯২৭]
باب المجاهدة عن ابن مسعود رضي الله عنه قال: صليت مع النبي صلى الله عليه وسلم ليلة، فأطال القيام حتى هممت بأمر سوء! قيل: وما هممت به؟ قال: هممت أن أجلس وأدعه. (متفق عليه).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৬
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১০/১০৬। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তিনটি জিনিস মৃত ব্যক্তির সঙ্গে যায়ঃ তার আত্মীয়-স্বজন, তার মাল ও তার আমল। অতঃপর দু’টি জিনিস ফিরে আসে এবং একটি জিনিস রয়ে যায়। তার আত্মীয়স্বজন ও তার মাল ফিরে আসে এবং তার আমল (তার সঙ্গে) রয়ে যায়।[সহীহুল বুখারী ৬৫১৪, মুসলিম ২৯৬০, তিরমিযী ২৩৭৯, নাসায়ী ১৯৩৭, আহমাদ ১১৬৭০ ]
باب المجاهدة عن أنس رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: " يتبع الميت ثلاثة: أهله وماله وعمله؛ فيرجع اثنان ويبقى واحد: يرجع أهله وماله، ويبقى عمله" (متفق عليه).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৭
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১১/১০৭। ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জান্নাত তোমাদের জুতোর ফিতার চেয়েও অধিক নিকটবর্তী এবং জাহান্নামও তদ্রূপ।’’[সহীহুল বুখারী ৬৪৮৮, আহমাদ ৩৫৮, ৩৯১৩, ৪২০৬ ]
باب المجاهدة عن ابن مسعود رضي الله عنه قال: قال النبي صلى الله عليه وسلم: " الجنة أقرب إلى أحدكم من شراك نعله، والنار مثل ذلك" (رواه البخاري).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৮
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১২/১০৮। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খাদেম ও আহলে সুফ্ফার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবূ ফিরাস রাবীআহ ইবনু কা‘ব আসলামী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে রাত কাটাতাম। আমি তাঁর কাছে ওযূর পানি এবং প্রয়োজনীয় বস্তু এনে দিতাম। (একদিন তিনি খুশী হয়ে) বললেন, ‘‘তুমি আমার কাছে কিছু চাও।’’ আমি বললাম, ‘আমি আপনার কাছে জান্নাতে আপনার সাহচর্য চাই।’ তিনি বললেন, ‘‘এ ছাড়া আর কিছু?’’ আমি বললাম, ‘বাস্ ওটাই।’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে তুমি, অধিকাধিক সিজদা করে (অর্থাৎ প্রচুর নফল নামায পড়ে) তোমার (এ আশা পূরণের) জন্য আমাকে সাহায্য কর।’’[সহীহুল বুখারী ৪৮৯, তিরমিযী ৩৪১৬, নাসায়ী ১১৩৮, ১৬১৮, আবূ দাউদ ১৩২০, ইবনু মাজাহ ৩৮৭৯, আহমাদ ১৬১৩৮ ]
باب المجاهدة عن أبي فراس ربيعة بن كعب الأسلمى خادم رسول الله صلى الله عليه وسلم، ومن أهل الصفة رضي الله عنه قال: " كنت أبيت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم، فآتيه بوضوئه، وحاجته فقال: "سلني" فقلت: أسألك مرافقتك في الجنة. فقال: ( أوغير ذلك؟" قلت: هو ذاك قال: " فأعني على نفسك بكثرة السجود" (رواه مسلم).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৯
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১৩/১০৯। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খাদেম সাওবান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘‘তুমি অধিকাধিক সিজদা করাকে অভ্যাস বানিয়ে নাও। কারণ, তুমি যে কোন সিজদা করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার দ্বারায় তোমাকে মর্যাদায় এক ধাপ উঁচু করে দেবেন এবং তোমা থেকে একটি গোনাহ মিটিয়ে দেবেন।’’[মুসলিম ৪৮৮, তিরমিযী ৩৮৮, নাসায়ী ১১৩৯, ইবনু মাজাহ ১৪২৩, আহমাদ ২১৮৬৫, ২১৯০৫, ২১৯৩৬ ]
باب المجاهدة الثالث عشر: عن أبي عبد الله- ويقال: أبو عبد الرحمن- ثوبان مولى رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: " عليك بكثرة السجود، فإنك لن تسجد لله سجدة إلا رفعك الله بها درجة، وحط عنك بها خطيئة". (رواه مسلم).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১১১
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১৫/১১১। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আমার চাচা আনাস ইবনু নাদর বদরের যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। (যার জন্য তিনি খুবই দুঃখিত হয়েছিলেন।) অতঃপর তিনি একবার বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! প্রথম যে যুদ্ধ আপনি মুশরিকদের বিরুদ্ধে করলেন তাতে আমি অনুপস্থিত থাকলাম। যদি (এরপর) আল্লাহ আমাকে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন, তাহলে আমি কী করব আল্লাহ তা অবশ্যই দেখাবেন (অথবা দেখবেন)।’ অতঃপর যখন উহুদের দিন এল, তখন মুসলিমরা (শুরুতে) ঘাঁটি ছেড়ে দেওয়ার কারণে পরাজিত হলেন। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ! এরা অর্থাৎ সঙ্গীরা যা করল তার জন্য আমি তোমার নিকট ওযর পেশ করছি। আর ওরা অর্থাৎ মুশরিকরা যা করল, তা থেকে আমি তোমার কাছে সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করছি।’
অতঃপর তিনি আগে বাড়লেন এবং সামনে সা‘দ ইবনু মু‘আযকে পেলেন। তিনি বললেন, ‘হে সা‘দ ইবনু মু‘আয! জান্নাত! কা‘বার প্রভুর কসম! আমি উহুদ অপেক্ষা নিকটতর জায়গা হতে তার সুগন্ধ পাচ্ছি।’ (এই বলে তিনি শত্রুদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত বরণ করলেন।) সা‘দ বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সে যা করল, আমি তা পারলাম না।’ আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘আমরা তাঁর দেহে আশীর চেয়ে বেশি তরবারি, বর্শা বা তীরের আঘাত চিহ্ন পেলাম। আর আমরা তাকে এই অবস্থায় পেলাম যে, তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং মুশরিকরা তাঁর নাক-কান কেটে নিয়েছে। ফলে কেউ তাঁকে চিনতে পারেনি। কেবল তাঁর বোন তাঁকে তাঁর আঙ্গুলের পাব দেখে চিনেছিল।’ আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন যে, আমরা ধারণা করতাম যে, (সূরা আহযাবের ২৩নং) এই আয়াত তাঁর ও তাঁর মত লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।
‘‘মু’মিনদের মধ্যে কিছু আল্লাহর সঙ্গে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূরণ করেছে, ওদের কেউ কেউ নিজ কর্তব্য পূর্ণরূপে সমাধা করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। ওরা তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করেনি।’’[সহীহুল বুখারী ২৮০৫, ২৭০৩, ৪০৪৮, ৪৪৯৯, ৪৫০০, ৪৬১১, ৪৭৮৩, ৬৮৯৪, মুসলিম ১৯০৩, নাসায়ী ৪৭৫৫, ৪৭৫৬, ৪৭৫৭, আবূ দাউদ ৪৫৯৫, ইবনু মাজাহ ২৬৪৯, আহমাদ ১১৮৯৩, ১২২৯৩, ১২৬০৩ ]
باب المجاهدة عن أنس رضي الله عنه، قال: غاب عمي أنس ابن النضر رضي الله عنه، عن قتال بدر، فقال: يارسول الله غبت عن أول قتال قاتلت المشركين، لئن الله أشهدني قتال المشركين ليرين الله ما أصنع. فلما كان يوم أحد انكشف المسلمون، فقال اللهم أعتذر إليك مما صنع هؤلاء - يعني أصحابه- وأبرأ إليك مما صنع هؤلاء- يعني المشركين- ثم تقدم فاستقبله سعد بن معاذ، فقال: ياسعد بن معاذ الجنة ورب الكعبة، إني أجد ريحها من دون أحد. قال سعد: فما استطعت يا رسول الله ما صنع! قال أنس: فوجدنا به بضعاً وثمانين ضربة بالسيف، أو طعنة برمح ، أو رمية بسهم، ووجدناه قد قتل ومثل به المشركون فما عرفه أحد إلا أخته ببنانه. قال أنس: كنا نرى أو نظن أن هذه الآيه نزلت فيه وفي أشباهه: (من المؤمنين رجال صدقوا ما عهدوا الله عليه) ( الأحزاب: 23) إلى آخرها. (متفق عليه).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১১২
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১৬/১১২। আবূ মাসউদ উক্ববাহ ইবনু ‘আমর আনসারী বাদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, যখন সাদকার আয়াত অবতীর্ণ হল, তখন (সাদকা করার জন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে) আমরা নিজের পিঠে বোঝা বহন করতাম (অর্থাৎ মুটে-মজুরের কাজ করতাম)। অতঃপর এক ব্যক্তি এল এবং প্রচুর জিনিস সাদকাহ করল। মুনাফিকরা বলল, ‘এই ব্যক্তি রিয়াকার (লোককে দেখানোর জন্য দান করছে।)’ আর এক ব্যক্তি এল এবং সে এক সা’ (আড়াই কিলো) জিনিস দান করল। তারা বলল, ‘এ (ক্ষুদ্র) এক সা’ দানের আল্লাহ মুখাপেক্ষী নন।’ অতঃপর এই আয়াত অবতীর্ণ হলঃ ‘‘বিশ্বাসীদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যারা সাদকা দান করে এবং যারা নিজ পরিশ্রম ব্যতিরেকে কিছুই পায় না, তাদেরকে যারা দোষারোপ করে এবং উপহাস করে, আল্লাহ তাদেরকে উপহাস করেন এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’’[সহীহুল বুখারী ১৪১৫, ১৪১৬, ২২৭৩, ৪৬৬৮, ৪৬৬৯, মুসলিম ১০১৮, নাসায়ী ২৫২৯, ২৫৩০, ইবনু মাজাহ ৪১৫৫, (সূরা তাওবাহ ৭৯, বুখারী-মুসলিম) ]
باب المجاهدة عن أبي مسعود عقبة بن عمرو الأنصاري البدري رضي الله عنه قال: لما نزلت آيه الصدقة كنا نحامل على ظهورنا. فجاء رجل فتصدق بشيء كثير فقالوا: مراءٍ، وجاء رجل آخر فتصدق بصاع فقالوا: إن الله لغني عن صاع هذا! فنزلت ( الذين يلمزون المطوعين من المؤمنين في الصدقات والذين لا يجدون إلا جهدهم) الآية (التوبة:79). (متفق علي
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১১৩
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১৭/১১৩। আবূ যার্র জুন্দুব ইবনু জুনাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুমহান প্রভু হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি (আল্লাহ) বলেন, ‘‘হে আমার বান্দারা! আমি অত্যাচারকে আমার নিজের জন্য হারাম করে দিয়েছি এবং আমি তা তোমাদের মাঝেও হারাম করলাম। সুতরাং তোমরাও একে অপরের প্রতি অত্যাচার করো না। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই পথভ্রষ্ট; কিন্তু সে নয় যাকে আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি। অতএব তোমরা আমার নিকট সঠিক পথ চাও আমি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখাব। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই ক্ষুধার্ত; কিন্তু সে নয় যাকে আমি খাবার দিই। সুতরাং তোমরা আমার কাছে খাবার চাও, আমি তোমাদেরকে খাবার দেব। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই বস্ত্রহীন; কিন্তু সে নয় যাকে আমি বস্ত্র দান করেছি। সুতরাং তোমরা আমার কাছে বস্ত্র চাও, আমি তোমাদেরকে বস্ত্রদান করব। হে আমার বান্দারা! তোমরা দিন-রাত পাপ করে থাক, আর আমি সমস্ত পাপ ক্ষমা করে থাকি। সুতরাং তোমরা আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেব। হে আমার বান্দারা! তোমরা কখনো আমার অপকার করতে পারবে না এবং কখনো আমার উপকারও করতে পারবে না।
হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ মানুষ ও জ্বিন সকলেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একজন পরহেযগার ব্যক্তির হৃদয়ের মত হৃদয়বান হয়ে যায়, তাহলে এটা আমার রাজত্বের কোন কিছু বৃদ্ধি করতে পারবে না। হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ মানুষ ও জ্বিন সকলেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একজন পাপীর হৃদয়ের মত হৃদয়ের অধিকারী হয়ে যায়, তাহলে এটা আমার রাজত্বের কোন কিছুই কমাতে পারবে না। হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ তোমাদের মানুষ ও জ্বিন সকলেই একটি খোলা ময়দানে একত্রিত হয়ে আমার কাছে প্রার্থনা করে, আর আমি তাদের প্রত্যেককে তার প্রার্থিত জিনিস দান করি, তাহলে (এ দান) আমার কাছে যে ভান্ডার আছে, তা হতে ততটাই কম করতে পারবে, যতটা সূঁচ কোন সমুদ্রে ডুবালে তার পানি কমিয়ে থাকে। হে আমার বান্দারা! আমি তোমাদের কর্মসমূহ তোমাদের জন্য গুণে রাখছি। অতঃপর আমি তোমাদেরকে তার পূর্ণ বিনিময় দেব। সুতরাং যে কল্যাণ পাবে, সে আল্লাহর প্রশংসা করুক। আর যে ব্যক্তি অন্য কিছু (অর্থাৎ অকল্যাণ) পাবে, সে যেন নিজেকেই তিরস্কার করে।’’
(হাদীসের একজন বর্ণনাকারী) সাঈদ বলেন, আবূ ইদরীস (এই হাদীসের অন্য একজন বর্ণনাকারী) যখন এই হাদীস বর্ণনা করতেন, তখন হাঁটু গেড়ে বসে যেতেন।[মুসলিম ২৫৭৭, ২৪৯৫, ইবনু মাজাহ ৪২৫৭, আহমাদ ২০৮৬০, ২০৯১১, ২১০৩০, দারেমী ২৭৮৮ ]
باب المجاهدة عن سعيد بن عبد العزيز، عن ربيعة بن يزيد، عن أبي إدريس الخولاني، عن أبي ذر جندب بن جنادة، رضي الله عنه، عن النبي صلى الله عليه وسلم فيما يروى عن الله تبارك وتعالى أنه قال: " ياعبادي إني حرمت الظلم على نفسي وجعلته بينكم محرماً فلا تظالموا، يا عبادي كلكم ضال إلا من هديته؛ فاستهدوني أهدكم، يا عبادي كلكم جائع إلا من أطعمته؛ فاستطعموني أطعمكم،يا عبادي كلكم عارٍ إلا من كسوته، فاستكسوني أكسكم، يا عبادي إنكم تخطئون بالليل والنهار وأنا أغفر الذنوب جميعا، فاستغفروني أغفرلكم، ياعبادي إنكم لن تبلغوا ضري فتضروني، ولن تبلغوا نفعي فتنفعوني، يَا عِبَادي ، لَوْ أنَّ أوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أتْقَى قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مِنْكُمْ مَا زَادَ ذلِكَ في مُلكي شيئاً . يَا عِبَادي ، لَوْ أنَّ أوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أفْجَرِ قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مَا نَقَصَ ذلِكَ من مُلكي شيئاً، يا عبادي لو أن أولكم وآخركم، وإنسكم وجنكم قاموا في صعيد واحد، فسألوني فأعطيت كل إنسان مسألته، ما نقص ذلك مما عندي إلا كما ينقص المخيط إذا أدخل البحر، يا عبادي إنما هي أعمالكم أحصيها لكم، ثم أوفيكم إياها، فمن وجد خيراً فليحمد الله، ومن وجد غير ذلك فلا يلومن إلا نفسه". قال سعيد: كان أبو إدريس إذا حدث بهذا الحديث جثا على ركبتيه. رواه مسلم.
সু-সমাপ্ত ঃ০৪/০৮/১৪৪৪ হিজরী।
২৪/০২/২০২৩ ইংরেজী।
শুক্রবারঃসকাল-৭টা।
মাসজিদুন নববী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
আল-মাদিনাতুল মানোআয়া।
সৌদিআরব।
সংকলনেঃআবু আব্দুল্লাহ আব্দুল হালীম বিন মোহাম্মাদ।
تالف: أبو عبد الله عبد الحليم بن محمد موحی الدین
ভূমিকা
إِنَّ الْحَمْدُ للهِ، نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا ، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ ، وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلاَ هَادِيَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
নিশ্চয় যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য। আমরা তারই প্রশংসা করি, তার কাছে সাহায্য চাই, তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। আল্লাহর নিকট আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্টতা ও আমাদের কর্মসমূহের অকল্যাণ থেকে আশ্রয় কামনা করি। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দেন, তাকে গোমরাহ করার কেউ নেই। আর যাকে গোমরাহ করেন তাকে হিদায়াত দেওয়ারও কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকার ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোনো শরীক নেই। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সালাত ও সালাম নাযিল হোক তাঁর ওপর, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবীদের ওপর এবং যারা কিয়ামত অবধি ইহসানের সাথে তাদের অনুসরণ করেন তাদের ওপর।
মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهۡدِيَنَّهُمۡ سُبُلَنَاۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٦٩ ﴾ [العنكبوت: ٦٩]
অর্থাৎ “যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথসমূহে পরিচালিত করব। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গেই থাকেন।” (সূরা আনকাবূত ৬৯ আয়াত)
@ جهاد ও مجاهدة
এর আসল অর্থ দ্বীনের পথে বাধা বিপত্তি দূর করার জন্যে পূর্ণ শক্তি ব্যয় করা। এখানে এ নিশ্চয়তা দান করা হচ্ছে যে, যারা আল্লাহর পথে আন্তরিকতা সহকারে পূর্ণ শক্তি ব্যয় করবে তাদেরকে মহান আল্লাহ তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেন না। বরং তিনি তাদেরকে পথ দেখান এবং তাঁর দিকে যাওয়ার পথ তাদের জন্য খুলে দেন। তারা তাঁর সন্তুষ্টি কিভাবে লাভ করতে পারে তা তিনি প্রতি পদে পদে তাদেরকে জানিয়ে দেন। এই আয়াতের তফসীরে ফুদাইল ইবন আয়াদ বলেন, যারা বিদ্যার্জনে ব্ৰতী হয়, আমি তাদের জন্য আমলও সহজ করে দেই। [বাগভী]
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার সঙ্গে থাকা দু ধরনের। এক. মুমিন, কাফির নির্বিশেষে সবার সঙ্গে থাকার অর্থ হচ্ছে তাদের সম্পর্কে পরিপূর্ণ জানা, তাদেরকে পর্যবেক্ষনে রাখা ও নিয়ন্ত্রণ করা। দুই. মুমিন, মুহসিন, মুত্তাকীদের সাথে থাকা। তাদের সঙ্গে থাকার অর্থ হচ্ছে, তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের হেফাযত করা। তাছাড়া তাদের সম্পর্কে জানা, দেখা, পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্ৰণ তো আছেই। তবে এটা অবশ্যই ঈমান রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ তাঁর আরাশের উপরেই আছেন।
@অর্থাৎ, যারা আমার (সন্তুষ্টির পথে) দ্বীনের উপর আমল করতে কষ্ট, পরীক্ষা এবং সমস্যার সম্মুখীন হয়।
এর অর্থ হল, দুনিয়া ও আখেরাতের ঐ সকল পথ, যে সকল পথে চললে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়।
'ইহ্সান'-এর অর্থ হল, 'আমি যেন আল্লাহকে দেখছি অথবা আল্লাহ আমাকে দেখছেন' মনে করে প্রত্যেক সৎ কাজ আন্তরিকতার সাথে সম্পাদন করা। নবী (সাঃ)-এর তরীকা অনুযায়ী সে কাজ সম্পাদন করা। মন্দের প্রতিশোধে মন্দ না করে ভালো ব্যবহার প্রদর্শন করা। নিজের প্রাপ্য অধিকার ছেড়ে দেওয়া এবং অন্যকে তার অধিকার অপেক্ষা অধিক দেওয়া। এই সকল কর্ম 'ইহ্সান' (সৎকর্মপরায়ণতা)র অন্তর্ভুক্ত।
@আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীদের দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সঃ), তাঁর সাহাবীবর্গ এবং তাঁর অনুসারীদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রামকারীদেরকে অবশ্যই আমি আমার পথে পরিচালিত করবো।' হযরত আবূ আহমাদ আব্বাস হামাদানী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ যারা নিজেদের ইলম অনুযায়ী আমল করে, আল্লাহ তাদেরকে ঐ সব বিষয়েও সুপথ প্রদর্শন করবেন যা তাদের ইলমের মধ্যে নেই।
আবু সালমান দারানী (রঃ)-এর সামনে এটা বর্ণনা করা হলে তিনি বলেনঃ যার অন্তরে কোন কথা জেগে ওঠে, যদিও তা ভাল কথাও হয়, তবুও ওর উপর আমল করা ঠিক হবে না যে পর্যন্ত না কুরআন ও হাদীস দ্বারা ওটা প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয়ে গেলে ওর উপর আমল করতে হবে এবং আল্লাহর প্রশংসা করতে হবে যে, তিনি তার অন্তরে এমন কথা জাগিয়ে দিয়েছেন যা কুরআন ও হাদীস দ্বারাও সাব্যস্ত হয়ে গেছে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে রয়েছেন।
হযরত ঈসা (আঃ) বলেনঃ “ইহসান হচ্ছে ওরই নাম যে, যে তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করে তুমি তার সাথে সদ্ব্যবহার কর। যে সদ্ব্যবহার করে তার সাথে সদ্ব্যবহার করার নাম ইহসান নয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
@(وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا....) جهاد
শব্দের অর্থন প্রচেষ্টা করা, ঈমান আনা থেকে শুরু করে যাবতীয় সৎ আমল করা ও অসৎ আমল থেকে বিরত থাকা এমনকি আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা পর্যন্ত এখানে সব শামিল। ঈমান আনতেও প্রচেষ্টা করতে হয়, কেননা শয়তান এতে কঠোরভাবে বাধা দেয়। কারণ একজন ব্যক্তি ঈমান আনলে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি সত্য পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে সঠিক পথ দেখাবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় শত্র“র বিরুদ্ধে জিহাদ করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতের পথ দেখাবেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাহায্য, সহযোগিতা দিয়ে সৎ কর্মশীলদের সাথে রয়েছেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় সংগ্রাম করার ফযীলত অনেক।
২. আল্লাহ তা‘আলা সৎ কর্মপরায়ণ লোকদেরকে সর্বদা সাহায্য করেন।
@যারা নিজেরা দীনের উপর চলে ও অন্যকে চালানাের চেষ্টা করে, তাদের জন্য এটা এক মহা সুসংবাদ। আল্লাহ তাআলার ওয়াদা হল, যারা দীনের পথে চেষ্টারত থাকবে এবং কখনও হতাশ হয়ে পিছিয়ে যাবে না, তিনি অবশ্যই তাদেরকে লক্ষ্যস্থলে পৌছাবেন। সুতরাং পথের কষ্ট - ক্লেশের কাছে হার না মেনে প্রতিটি বাঁক থেকে নতুন উদ্যম ও প্রত্যেক সঙ্কট থেকে নতুন হিম্মতের রসদ নিয়ে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা চাই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে এর তাওফীক দান করুন। আমীন।
@এখানে এ নিশ্চিন্ততা দান করা হচ্ছে যে, যারা আল্লাহর পথে আন্তরিকতা সহকারে সারা দুনিয়ার সাথে সংঘর্ষের বিপদ মাথা পেতে নেয় তাদেরকে পথ দেখান এবং তার দিকে যাওয়ার পথ তাদের জন্য খুলে দেন। তারা তার সন্তুষ্টি কিভাবে লাভ করতে পারে তা তিনি প্রতি পদে পদে তাদেরকে জানিয়ে দেন। পথের প্রতিটি বাঁকে তিনি তাদেরকে আলো দেখান। যার ফলে কোনটা সঠিক পথ ও কোনটা ভুল পথ তা তারা দেখতে চায়। তাদের নিয়ত যতই সৎ ও সদিচ্ছা প্রসূত হয় ততই আল্লাহর সাহায্য, সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও হিদায়াতও তাদের সহযোগি হয়।
@অন্য আর একটি দলের উল্লেখ করে সূরাটি সমাপ্ত করা হচ্ছে। যারা আল্লাহর পথে টিকে থাকতে গিয়ে এবং তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে জেহাদ করে, জেহাদ করে তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার উদ্দেশ্যে, যারা তাঁর পথে চলতে গিয়ে মাল-সামান সংগ্রহ ও বহন করে, এরপর আর পেছনের দিকে তাকায় না বা হতাশও হয় না, যারা অন্তরের মধ্য থেকে আগত বাধা-বিপত্তির মধ্যে এবং বাইরে থেকে আসা বিপদের মধ্যে অবস্থান করার সময়ে সবর করে, যারা চাদর গায়ে দিয়ে রওয়ানা হয় সে অজানা, কষ্টকর, দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর পথে... তারাই হচ্ছে সেসব মানুষ যাদের আল্লাহ রব্বুল আলামীন পরিত্যাগ করবেন না, এই বিপদসংকুল রাস্তায় অসহায় ও একাকী অবস্থায় ছেড়ে দেবেন না, তাদের ঈমান এবং তাদের জেহাদ তিনি ভুলে যাবেন না। তিনি তাঁর মহাসম্মানজনক অবস্থান থেকে তাদের কাজগুলাে পর্যবেক্ষণ করছেন, দেখছেন ও মূল্যায়ন করছেন তাদের জেহাদ এবং তিনিই দেখাবেন তাদের প্রকৃত সঠিক পথ। সত্যের পথে নিবেদিত লােকদের তিনি অবশ্যই দেখছেন এবং দেখছেন তাদের কঠোর সগ্রামী জীবন। তিনি আরও দেখছেন, এ পথে কাজ করতে গিয়ে তারা আলিংগন করে নিয়েছে এবং সকল দুঃখ জ্বালা ও দুঃসহ কষ্টের মধ্যে সবর করে চলেছেন। তিনি আরও দেখে যাচ্ছেন তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা এবং সত্যের খাতিরে পারস্পরিক সহযােগিতা ও সৌহার্দ বিনিময়কে, এ জন্যে অবশ্যই তিনি তাদের উপযুক্ত পুরস্কার ও মর্যাদা দান করবেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যারা আমার পথে টিকে থাকতে গিয়ে চূড়ান্ত সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে, অবশ্যই আমি মহান আল্লাহ তাদের বহু পথ দেখাব। আর অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা এহসানকারীদের সাথে রয়েছেন।'
@“মুজাহাদা” শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে, কোন বিরোধী শক্তির মোকাবিলায় দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম, প্রচেষ্টা ও সাধনা করা। আর যখন কোন বিশেষ বিরোধী শক্তি চিহ্নিত করা হয় না বরং সাধারণভাবে “মুজাহাদা” শব্দ ব্যবহার করা হয়, তখন এর অর্থ হয় একটি সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী দ্বন্দ্ব-সংঘাত। মু’মিনকে এ দুনিয়ায় যে দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম করতে হয় তা হচ্ছে এ ধরনের। তাকে শয়তানের সাথেও লড়াই করতে হয়, যে তাকে সর্বক্ষণ সৎকাজের ক্ষতির ভয় দেখায় এবং অসৎকাজের লাভ ও স্বাদ উপভোগের লোভ দেখিয়ে বেড়ায়। তাকে নিজের নফসের বা কুপ্রবৃত্তির সাথেও লড়তে হয়, যে তাকে সর্বক্ষণ নিজের খারাপ ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার দাসে পরিণত করে রাখার জন্য জোর দিতে থাকে। নিজের গৃহ থেকে নিয়ে বিশ্ব-সংসারের এমন সকল মানুষের সাথে তাকে লড়তে হয় যাদের আদর্শ, মতবাদ, মানসিক প্রবণতা, চারিত্রিক নীতি, রসম-রেওয়াজ, সাংস্কৃতিক ধারা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিধান সত্য দ্বীনের সাথে সংঘর্ষশীল। তাকে এমন রাষ্ট্রের সাথেও লড়তে হয় যে আল্লাহর আনুগত্যমুক্ত থেকে নিজের ফরমান জারী করে এবং সততার পরিবর্তে অসততাকে বিকশিত করার জন্য শক্তি নিয়োগ করে। এ প্রচেষ্টা-সংগ্রাম এক-দু’দিনের নয়, সারাজীবনের। দিন-রাতের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি মুহূর্তের। কোন একটি ময়দানে নয় বরং জীবনের প্রত্যেকটি ময়দানের ও প্রতিটি দিকে। এ সম্পর্কেই হযরত হাসান বাসরী (র) বলেনঃ
ان الرجل ليجاهدو ماضرب يوما من الدهر بسيف
“মানুষ যুদ্ধ করে চলে, যদিও কখনো একবারও তাকে তলোয়ার চালাতে হয় না।”
@যারা নিজেরা দীনের উপর চলে ও অন্যকে চালানোর চেষ্টা করে, তাদের জন্য এটা এক মহা সুসংবাদ। আল্লাহ তাআলার ওয়াদা হল, যারা দীনের পথে চেষ্টারত থাকবে এবং কখনও হতাশ হয়ে পিছিয়ে যাবে না, তিনি অবশ্যই তাদেরকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাবেন। সুতরাং পথের কষ্ট-ক্লেশের কাছে হার না মেনে প্রতিটি বাঁক থেকে নতুন উদ্যম ও প্রত্যেক সঙ্কট থেকে নতুন হিম্মতের রসদ নিয়ে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা চাই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে এর তাওফীক দান করুন। আমীন।
@جهاد — وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا
এর আসল অর্থ ধর্মের পথে বাধা বিপত্তি দূর করার জন্য পূর্ণ শক্তি ব্যয় করা। কাফির ও পাপিষ্ঠদের পক্ষ থেকে আগত বাধা-বিপত্তি এবং প্রবৃত্তি ও শয়তানের পক্ষ থেকে আগত বাধা-বিপত্তি সবই এর অন্তর্ভুক্ত। তবে জিহাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকার হচ্ছে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া।
উভয় প্রকার জিহাদের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতে ওয়াদা করা হয়েছে যে, যারা জিহাদ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করি। অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে ভাল মন্দ, সত্য অথবা উপকার ও অপকার সন্দেহ জড়িত থাকে কোন পথ ধরতে হবে তা চিন্তা করে কুল-কিনারা পাওয়া যায় না, সেসব ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা’আলা জিহাদকারীদেরকে সোজা, সরল ও সুগম পথ বলে দেন, অর্থাৎ যে পথে তাদের কল্যাণ নিহিত, সেই পথের দিকে মনকে আকৃষ্ট করে দেন।
ইলম অনুযায়ী আমল করলে ইলম বাড়েঃ এই আয়াতের তফসীরে হযরত আবুদ্দারদা বলেন, আল্লাহ্ প্রদত্ত ইল্ম অনুযায়ী আমল করার জন্য যারা জিহাদ করে, আমি তাদের সামনে নতুন নতুন ইলমের দ্বার খুলে দেই। ফুযায়ল ইবনে আয়ায বলেন, যারা বিদ্যার্জনে ব্রতী হয়, আমি তাদের জন্য আমলও সহজ করে দেই।—(মাযহারী) والله اعلم
তিনি অন্যত্র বলেন,
﴿ وَٱعۡبُدۡ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأۡتِيَكَ ٱلۡيَقِينُ ٩٩ ﴾ [الحجر: ٩٩]
অর্থাৎ “আর তোমার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর।” (সূরা হিজর ৯৯ আয়াত)
@ এখানে কুরআন ব্যবহার করেছে (الْيَقِيْنُ) শব্দটি। সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুম শব্দটির তাফসীর করেছেনঃ মৃত্যু [বুখারীঃ ৪৭০৬] কুরআন ও হাদীসে ইয়াকীন’ শব্দটি মৃত্যু অর্থে ব্যবহার হওয়ার বহু প্রমাণ আছে। পবিত্র কুরআনে এসেছেঃ
“তারা বলবে, আমরা মুসল্লীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না, আমরা অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করতাম না, এবং আমরা বিভ্রান্ত আলোচনাকারীদের সাথে বিভ্রান্তিমূলক আলোচনায় নিমগ্ন থাকতাম। আমরা কর্মফল দিন অস্বীকার করতাম, শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে মৃত্যু এসে যায় " [সূরা আল-মুদ্দাসসিরঃ ৪৩-৪৭] অনুরূপভাবে হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান ইবনে মায’উন এর মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে বলেছেনঃ “কিন্তু সে! তার তো (الْيَقِيْنُ) তথা মৃত্যু এসেছে, আর আমি তার জন্য যাবতীয় কল্যাণের আশা রাখি। [বুখারীঃ ১২৪৩]
সুতরাং বুঝা গেল যে, এখানে (الْيَقِيْنُ) শব্দের অর্থ মৃত্যুই। আর এ অর্থই সমস্ত মুফাসসেরীনদের থেকে বর্ণিত হয়েছে। সে হিসেবে প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করে যেতে হবে। যদি কাউকে ইবাদত থেকে রেহাই দেয়া হতো তবে নবী-রাসূলগণ তা থেকে রেহাই পেতেন কিন্তু তারাও তা থেকে রেহাই পাননি। তারা আমৃত্যু আল্লাহর ইবাদত করেছেন এবং করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং যদি কেউ এ কথা বলে যে, মারেফত এসে গেলে আর ইবাদতের দরকার নেই সে কাফের। কারণ সে কুরআন, হাদীস এবং ইজমায়ে উম্মাতের বিপরীত কথা ও কাজ করেছে। এটা মূলতঃ মুলহিদদের কাজ। আল্লাহ আমাদেরকে তাদের কর্মকাণ্ড থেকে হেফাযত করুন। আমীন।
@মুশরিকরা নবী (সাঃ)-কে যাদুকর, পাগল, গণক ইত্যাদি বলত। আর মানুষ হওয়ার কারণে তিনি এ সব কথায় দুঃখ পেতেন। মহান আল্লাহ সান্তনা দিয়ে বললেন, তুমি প্রশংসা কর, নামায পড় এবং নিজ আল্লাহর এবাদত কর। যাতে তোমার অন্তর শান্তি লাভ করবে এবং আল্লাহর সাহায্য আসবে। সিজদাকারী বলতে নামাযী ও ইয়াকীন বলতে মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে।
@(وَاعْبُدْ رَبَّكَ) এখানে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে দুনিয়ার সকল মু’মিন মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তারা যেন ইয়াকীন আসা পর্যন্ত ইবাদত করে। এখানে “يقين” দ্বারা উদ্দেশ্য হল মৃত্যু।
দলীল: উম্মু ‘আলার হাদীস, সেখানে বর্ণিত রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উসমান বিন মাযউন সম্পর্কে বলেছেন:
أَمَّا هُوَ فَقَدْ جَاءَهُ اليَقِينُ، وَاللّٰهِ إِنِّي لَأَرْجُو لَهُ الخَيْرَ، وَاللّٰهِ مَا أَدْرِي، وَأَنَا رَسُولُ اللّٰهِ، مَا يُفْعَلُ بِه
তার ইয়াকীন চলে এসেছে অর্থাৎ মৃত্যু চলে এসেছে। আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে তার জন্য কল্যাণ আশা করছি। আল্লাহ তা‘আলার শপথ আমি আল্লাহ তা‘আলার রাসূল হওয়া সত্ত্বেও জানিনা তার সাথে কী ব্যবহার করা হবে। (সহীহ বুখারী হা: ১২৪৩, ৭০১৮)
কিন্তু কোন কোন ভ্রান্ত সম্প্রদায় এর দ্বারা উদ্দেশ্য গ্রহণ করেন যে, যখন “ইয়াক্বীন” চলে আসবে তখন আর আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার প্রয়োজন নেই। যার ফলে অনেকে এই “ইয়াক্বীন” বা “খাঁটি বিশ্বাস” অর্থ গ্রহণ করে ইবাদত করা ছেড়ে দিয়েছে। তাদের এই উদ্দেশ্যটি ভুল। বরং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে।
যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি হাদীসে বলেন, “তুমি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় কর যদি তাতে সক্ষম না হও তাহলে বসে। আর যদি তাতেও সক্ষম না হও তাহলে ইশারা দিয়ে সালাত আদায় কর”। (সহীহ বুখারী হা: ১২৪৩)
সুতরাং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ইবাদত করে যেতে হবে, যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবাদত করেছেন। যারা এর ব্যতিক্রম বলে তারা সঠিক পথে নেই।
@অর্থাৎ সত্যের বাণী প্রচার এবং সংস্কার প্রচেষ্টা চালাবার ক্ষেত্রে তোমাকে অশেষ কষ্ট ও বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। এগুলোর মোকাবিলা করার শক্তি তুমি একমাত্র নামায ও আল্লাহর বন্দেগী করার ক্ষেত্রে অবিচল দৃঢ়তার পথ অবলম্বন করার মাধ্যমেই অর্জন করতে পারো। এ জিনিসটি তোমার মনকে প্রশান্তিতে ভরে তুলবে, তোমার মধ্যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার জন্ম দেবে, তোমার সাহস ও হিম্মত বাড়িয়ে দেবে এবং তোমাকে এমন যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তুলবে যার ফলে সারা দুনিয়ার মানুষের গালিগালাজ, নিন্দাবাদ ও প্রতিরোধের মুখে তুমি দৃঢ়ভাবে এমন দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকবে যার মধ্যে তোমার রবের রেজামন্দি রয়েছে।
তিনি আরো বলেন,
﴿ وَٱذۡكُرِ ٱسۡمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلۡ إِلَيۡهِ تَبۡتِيلٗا ٨ ﴾ [المزمل: ٨]
অর্থাৎ “সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ কর এবং একনিষ্ঠভাবে তাতে মগ্ন হও।” (সূরা মুয্যাম্মিল ৮ আয়াত)
@ অর্থাৎ আপনি সমগ্র সৃষ্টি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে কেবল আল্লাহ্র সন্তুষ্টিবিধানে ও ইবাদতে মগ্ন হোন। এর সাধারণ অর্থে ইবাদতে শির্ক না করাও দাখিল এবং নিজের সমস্ত কর্মকাণ্ডে তথা উঠাবসায়, চলাফেরায় দৃষ্টি ও ভরসা আল্লাহ্র প্রতি নিবদ্ধ রাখা এবং অপরকে লাভ-লোকসান ও বিপদাপদ থেকে উদ্ধারকারী মনে না করাও দাখিল। দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছুকে পরিত্যাগ করে আল্লাহ্র কাছে যা আছে তৎপ্রতি মনোনিবেশ করাও এর অর্থের অন্তর্গত। কিন্তু এই تبتل তথা দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ সেই رهبانية তথা বৈরাগ্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কুরআনে যার নিন্দা করা হয়েছে এবং হাদীসে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কেননা, শরীয়াতের পরিভাষায় رهبانية বা বৈরাগ্য এর অর্থ দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা এবং ভোগ সামগ্ৰী ও হালাল বস্তুসমুহকে ইবাদতের নিয়তে পরিত্যাগ করা। পক্ষান্তরে এখানে যে সম্পর্কচ্ছেদের আদেশ করা হয়েছে, তা এই যে, বিশ্বাসগতভাবে অথবা কাৰ্যগতভাবে আল্লাহ্র সম্পর্কের উপর কোন সৃষ্টির সম্পর্ককে প্রবল হতে না দেয়া। এ ধরণের সম্পর্কচ্ছেদ বিবাহ, আত্মীয়তার সম্পর্ক ইত্যাদি যাবতীয় সাংসারিক কাজ-কারবারের পরিপন্থী নয়; বরং এগুলোর সাথে জড়িত থেকেও এটা সম্ভবপর। রাসূলগণের সুন্নত; বিশেষতঃ রাসূলকুল শিরোমণি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সমগ্র জীবন ও আচারাদি এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। আয়াতে تبتل শব্দ দ্বারা যে অর্থ ব্যক্ত করা হয়েছে, মূলত তা হলো সকল ইবাদত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্র জন্য করা এবং এর মাধ্যমে একমাত্র তাঁরই মুখাপেক্ষী হওয়া। [দেখুন, কুরতুবী]
@অর্থাৎ, তা অব্যাহতভাবে পালন কর। দিন হোক বা রাত, সব সময় আল্লাহর তাসবীহ, তাহমীদ এবং তাকবীর ও তাহলীল পড়তে থাক।
[২] تَبَتُّلٌ এর অর্থ পৃথক ও আলাদা হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ, আল্লাহর ইবাদত এবং তাঁর কাছে দু'আ ও মুনাজাতের জন্য সব কিছু থেকে পৃথক হয়ে একাগ্রচিত্তে তাঁর প্রতি মনোযোগী হওয়া। তবে এটা বৈরাগ্য থেকে ভিন্ন জিনিস। বৈরাগ্য তো সংসার ত্যাগের নাম, যা ইসলামে অপছন্দনীয় জিনিস। পক্ষান্তরে تَبَتُّلٌ এর অর্থ হল, পার্থিব কার্যাদি সম্পাদনের সাথে সাথে একাগ্রচিত্তে নম্র ও বিনয়ী হয়ে আল্লাহর ইবাদতের প্রতিও মনোযোগী হওয়া। আর এটা প্রশংসনীয় জিনিস।
@অর্থাৎ দুনিয়ার কাজ-কারবার হতে অবসর লাভ করে প্রশান্তির সাথে খুব বেশী বেশী তার যিকির করতে থাকো, তার দিকে ঝুঁকে পড়ে তাঁর প্রতি মনোনিবেশ কর। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “অতএব যখনই অবসর পাও সাবধান করো।” একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবি) অর্থাৎ স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং দুনিয়া ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছেন।
এখানে ভাবার্থ হচ্ছেঃ হে নবী (সঃ)! পার্থিব সৃষ্টিকূল হতে সম্পর্ক চ্ছিন্ন করে আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করার একটা সময় অবশ্যই নির্দিষ্ট করে নাও।
@(وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ)
‘সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ কর’ এতে সকল প্রকার যিকির শামিল। সালাত, কিয়াম, সালাতের আগে ও পরের দু‘আ ইত্যাদি।
(وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيْلًا) – تَبَتَّلْ
অর্থ : পৃথক ও আলাদা হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার নিমিত্তে দুনিয়ার ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হওয়ার পর আলাদা হয়ে যাও। এটি বৈরাগ্যতা নয়। কেননা বৈরাগ্যতা হল : দুনিয়া থেকে সাংসারিক ব্যস্ততাসহ সকল কিছু বর্জন করা। আর এরূপ বৈরাগ্যবাদ ইসলামে নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতেন, আবার বিবাহ করে সংসার গড়েছেন, রোযা রাখতেন আবার রোযা ছাড়তেন, রাতে সালাত আদায় করতেন আবার ঘুমাতেন। এটাই সুন্নাত তরিকা। অতএব এ তরিকা বর্জন করে অন্য তরিকা গ্রহণ করা সম্পূর্ণ শরীয়ত গর্হিত কাজ। কখনো এমন আমল আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৫০৬৩)
তাই পার্থিব কর্ম ব্যস্ততার পাশাপাশি সময়-সুযোগ করে নিয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা প্রশংসনীয়। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতসহ যখন কোন আমল করতেন তখন তা নিয়মিত করার চেষ্টা করতেন। যদি রাতে ঘুমের কারণে অথবা অসুস্থতার কারণে তাহজ্জুত আদায় না করতে পারতেন তাহলে দিনে বার রাকাত আদায় করে নিতেন। তবে কখনো তিনি একরাতে কুরআন শেষ করেননি এবং সারা রাত জাগেননি, রমযান ছাড়া অন্য কোন পূর্ণমাস সিয়াম পালন করেননি। (সহীহ ইবনু খুযাইমাহ হা. ১১৭৭)
@যিকির বলতে উভয়টাই বােঝয় অর্থাৎ মুখে আল্লাহ তাআলার নাম উচ্চারণ করাও এবং অন্তরে তার ধ্যান করাও। সকলের থেকে পৃথক হওয়ার অর্থ দুনিয়ার সব সম্পর্ক ছিন্ন করা নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, সকল সম্পর্কের উপর আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া, যাতে অন্যান্য সম্পর্ক আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের পক্ষে বাধা না হয়; অন্য সব সম্পর্কও আল্লাহ তাআলার হুকুম মােতাবেক পরিচালিত হয় এবং এভাবে সে সব সম্পর্কও তারই জন্য হয়ে যায়।
@تَبْتِيلً — وَاذْكُراسْمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا
এর শাব্দিক অর্থ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদতে মগ্ন হওয়া। পূর্ববর্তী আয়াতে তাহাজ্জুদের নামাযের আদেশ দেওয়ার পর এই আয়াতে এমন এক ইবাদতের আদেশ দেওয়া হয়েছে. যা রাত্রি অথবা দিনের সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত নয় বরং সর্বদা ও সর্বাবস্থায় অব্যাহত থাকে। তা হচ্ছে আল্লাহকে স্মরণ করা। এখানে সদাসর্বদা অব্যাহত রাখার অর্থে আল্লাহকে স্মরণ করার আদেশ করা হয়েছে। কেননা, একথা কল্পনাও করা যায় না যে, রসূলুল্লাহ্ (সা) কোন সময় আল্লাহকে স্মরণ করতেন না, তাই এ আদেশ করা হয়েছে। ---(মাযহারী)। আয়তের উদ্দেশ্য এই যে, রসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দিবারাত্রি সর্বক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে কোন সময় অবহেলা ও অনবধানতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। এটা তখনই হতে পারে, যখন স্মরণ করার অর্থ ব্যাপক নেওয়া হয় অর্থাৎ মুখে, অন্তরে অথবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর আদেশ পালনে ব্যাপৃত রেখে ইত্যাদি যে কোন প্রকারে স্মরণ করা। এক হাদীসে হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ كان يذكر الله على كل حين অর্থাৎ রসূলুল্লাহ (সা) সর্বক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করতেন। এটাও উপরোক্ত ব্যাপক অর্থে শুদ্ধ হতে পারে। কেননা, প্রস্রাব-পায়খানার সময় তিনি যে মুখে আল্লাহকে স্মরণ করতেন না, একথা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে। তবে আন্তরিক স্মরণ সর্বাবস্থায় হতে পারে। আন্তরিক স্মরণ দুই প্রকার- ১. শব্দ কল্পনা করে স্মরণ করা এবং ২. আল্লাহর গুণাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। -(মাওলানা থানভী)
আলোচ্য আয়াতের দ্বিতীয় আদেশ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا অর্থাৎ আপনি সমগ্র সৃষ্টি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানে ও ইবাদতে মগ্ন হোন। এর সাধারণ অর্থে ইবাদতে শিরক না করাও দাখিল এবং নিজের সমস্ত কর্মকাণ্ডে তথা উঠাবসায়, চলাফেরায় দৃষ্টি ও ভরসা আল্লাহর প্রতি নিবদ্ধ রাখা এবং অপরকে লাভ লোকসান ও বিপদাপদ থেকে উদ্ধার কারী মনে না করাও দাখিল। হযরত ইবনে যায়েদ (রা) বলেনঃ تَبْتِيل -এর অর্থ দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছুকে পরিত্যাগ কর এবং আল্লাহর কাছে যা আছে, তৎপ্রতি মনোনিবেশ করা।--(মাযহারী) কিন্তু এই تَبْتِيل তথা দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ সেই رهبا نيت তথা বৈরাগ্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোরআনে যার নিন্দা করা হয়েছে এবং হাদীসে لا رهبانية في الإسلام বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কেননা, শরীয়তের পরিভাষায় رهبا نيت-এর অর্থ দুনিয়ার সাথে সম্পর্কছেদ করা এবং ভোগ সামগ্রী ও হালাল বস্তুসমূহকে ইবাদতের নিয়তে পরিত্যাগ করা। অর্থাৎ এরূপ বিশ্বাস থাকা যে, এসব হালাল বস্তু পরিত্যাগ করা ব্যতীত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হতে পারে না, অথবা ওয়াজিব হকে ত্রুটি করে কার্যত সম্পর্কছেদ করা। আর এখানে যে সম্পর্কচ্ছেদের আদেশ করা হয়েছে, তা এই যে, বিশ্বাসগতভাবে অথবা কার্যগতভাবে আল্লাহর সম্পর্কের উপর কোন সৃষ্টির সম্পর্ককে প্রবল হতে না দেওয়া। এ ধরনের সম্পর্কছেদ বিবাহ, আত্মীয়তার সম্পর্ক ইত্যাদি যাবতীয় সাংসারিক কাজ-কারবারের পরিপন্থী নয়। বরং এগুলোর সাথে জড়িত থেকেও এটা সম্ভবপর। পয়গম্বরগণের সুন্নত। বিশেষত পয়গম্বরকুল শিরোমণি মুহাম্মদ মোস্তাফা (সা)-র সমগ্র জীবন ও আচারাদি এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। আয়াতে تَبْتِيل শব্দ দ্বারা যে অর্থ ব্যক্ত করা হয়েছে, পূর্ববর্তী বুযুর্গানে দীনের ভাষায় এরই অপর নাম ’ইখ্লাস’।~~~(মাযহারী)
জ্ঞাতব্য: অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং সাংসারিক সম্পর্ক ত্যাগ করার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সূফী বুষুর্গগণ সবার অগ্রণী ছিলেন। তাঁরা বলেন:আমরা যে দূরত্ব অতিক্রম করার কাজে দিবারাত্রি মশগুল আছি, প্রকৃতপক্ষে তাঁর দৃষ্টি স্তর আছে—প্রথম স্তর সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয় স্তর আল্লাহ পর্যন্ত পৌছা। উভয় স্তর পরস্পরে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আলোচ্য আয়াতে এ দু’টি স্তরই পর পর দুই বাক্যে বর্ণিত হয়েছে। ১. وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ এবং ২, وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا এখানে আল্লাহকে স্মরণ করার অর্থ সার্বক্ষণিকভাবে স্মরণ করা, যাতে কখনও ছুটি ও শৈথিল্য দেখা না দেয়। এই স্তরকেই সূফী-বুযুর্গগণের পরিভাষায় وصول الى الله এটা আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছা বলা হয়। এভাবে প্রথম বাক্যে শেষ স্তর এবং শেষ বাক্যে প্রথম স্তর উল্লিখিত হয়েছে। এই ব্রুম পরিবর্তনের কারণ সম্ভবত এই যে, দ্বিতীয় স্তরই আল্লাহর পথের পথিকের আসল উদ্দেশ্য ও চরম লক্ষ্য। তাই এর গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ব্যক্ত করার জন্য স্বাভাবিক ক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে। শেখ সাদী (র) উপরোক্ত দু’টি স্তর চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন
تعلن حجاب است و ہے حاصلی – چو, پیوندها بگسلی واصلی
ইসমে যাতের যিকির অর্থাৎ বারবার ’আল্লাহ’ ’আল্লাহ’ বলাও ইবাদতঃ আয়াতে ইসম শব্দ উল্লেখ করে وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ বলা হয়েছে এবং وَاذْكُرِ رَبِّكَ বলা হয়নি। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ইসমে অর্থাৎ আল্লাহ বারবার উচ্চারণ করাও আদিষ্ট বিষয় ও কাম্য। ---(মাযহারী) কোন কোন আলিম একে বিদ’আত বলেছেন। আয়াত থেকে জানা গল যে, তাদের এই উক্তি ঠিক নয়।
@যিকির বলতে উভয়টাই বোঝায় অর্থাৎ মুখে আল্লাহ তাআলার নাম উচ্চারণ করাও এবং অন্তরে তাঁর ধ্যান করাও। সকলের থেকে পৃথক হওয়ার অর্থ দুনিয়ার সব সম্পর্ক ছিন্ন করা নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, সকল সম্পর্কের উপর আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া, যাতে অন্যান্য সম্পর্ক আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের পক্ষে বাধা না হয়; অন্য সব সম্পর্কও আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক পরিচালিত হয় এবং এভাবে সে সব সম্পর্কও তাঁরই জন্য হয়ে যায়।
তিনি অন্য জায়গায় বলেছেন,
﴿ فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ ﴾ [الزلزلة: ٧]
অর্থাৎ “সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে সে তা দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল ৭ আয়াত)
@অতএব কেউ অণু পরিমাণও সৎ কাজ করলে সে তা দেখবে, জামে তিরমিযীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর কাছে এসে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে পড়িয়ে দিন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বললেনঃ (আরবি) যুক্ত তিনটি সূরা পাঠ করো।” লোকটি বললো “আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি, স্মৃতিশক্তি আমার দুর্বল হয়ে গেছে এবং জিহ্বা মোটা হয়ে গেছে (সুতরাং এই সূরাগুলো পড়া আমার পক্ষে কঠিন)।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, “আচ্ছা, তাহলে (আরবি) যুক্ত সূরাগুলো পড়।” লোকটি পুনরায় একই ওযর পেশ করলো। তখন নবী করীম (সঃ) তাকে বললেন “তাহলে (আরবি) বিশিষ্ট তিনটি সূরা পাঠ করো।” লোকটি ঐ উক্তিরই পুনরাবৃত্তি করলো এবং বললোঃ আমাকে একটি সূরার সবক দিন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে (আরবি) এই সূরাটিই পাঠ করালেন। পড়া শেষ করার পর লোকটি বললোঃ “আল্লাহর কসম! আমি কখনো এর অতিরিক্ত কিছু করবো না।” এই কথা বলে লোকটি চলে যেতে শুরু করলো। তখন নবী করীম (সঃ) বললেনঃ “এ লোকটি সাফল্য অর্জন করেছে ও মুক্তি পেয়ে গেছে।” তারপর তিনি বললেনঃ “তাকে একটু ডেকে আনে।” লোকটিকে ডেনে আনা হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ আমাকে ঈদুল আযহার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই দিনকে আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের জন্যে ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।" একথা শুনে লোকটি বললোঃ “যদি আমার কাছে কুরবানীর পশু না থাকে এবং কেউ আমাকে দুধ পানের জন্যে একটা পশু উপটৌকন দেয় তবে কি আমি ঐ পশুটি যবাহ করে ফেলবো?” রাসূলুল্লাহ উত্তরে বললেনঃ না, (এ কাজ করো না। বরং চুল ছাটিয়ে নাও, নখ কাটিয়ে নাও, গোঁফ ছোট করো এবং নাভীর নিচের লোম পরিষ্কার করো, এ কাজই আল্লাহর কাছে তোমার জন্যে পুরোপুরি কুরবানী রূপে গণ্য হবে।” (এ হাদীসটি সুনানে আবী দাউদ ও সুনানে নাসাঈতেও বর্ণিত হয়েছে) জামে তিরমিযীতে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি এই সূরা পাঠ করে সে অর্ধেক কুরআন পাঠের সওয়াব লাভ করে।” (এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল) অন্য এক হাদীসে রয়েছে যে, (আরবি) সূরাটি অর্ধেক কুরআনের সমতুল্য, (আরবি) সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য এবং এ সূরাটি কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমতুল্য। (এটাও গারীব বা দুর্বল হাদীস) অন্য একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সাহাবীদের একজনকে বলেনঃ “তুমি কি বিয়ে করেছো?” লোকটি উত্তরে বলেনঃ “জ্বী, না। আমার বিয়ে করার মত সামর্থ্য নেই।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ (আরবি) “এ সূরাটি কি তোমার সাথে নেই (অর্থাৎ এ সূরাটি কি তোমার মুখস্ত নেই)?” লোকটি জবাবে বললেনঃ “হ্যা (তা তো আছেই)।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এতে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ হলো। তারপর বললেনঃ “তোমার সাথে কি (আরবি) এই সূরাটি নেই?” লোকটি বললেনঃ “হ্যা’, আছে। নবী করীম (সঃ) বললেনঃ “এতে কুরআনের এক চতুর্থাংশ হলো। এরপর বললেন (আরবি) “এ সূরাটি কি তোমার জানা নেই?” লোকটি জবাব দিলেনঃ “হ্যা আছে।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “এটা কুরআনের এক চতুর্থাংশ” অতঃপর বললেনঃ “তোমার কি (আরবি) এ সূরাটি মুখস্ত নেই?” লোকটি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, অবশ্যই আছে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এটাও কুরআনের এক চুতর্থাংশ। যাও, এবার বিয়ে করে নাও।” (এই হাদীসটি হাসান। এই তিনটি হাদীসই ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। তিনি ছাড়া আসহাবুল কুতুবের অন্য কেউ এটা বর্ণনা করেননি) ১-৮ নং আয়াতের তাফসীর হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) (আরবি) এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ জমীনকে যখন ভীষণ কম্পনে কম্পিত করা হবে, নীচে থেকে উপর পর্যন্ত প্রকম্পনে ভিতরের সমস্ত মৃতকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হবে। যেমন অন্যত্র রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে মানুষ! ভয় কর তোমাদের প্রতিপালককে; কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ানক ব্যাপার।” (২২:১) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অথাৎ “এবং পৃথিবীকে যখন সম্প্রসারিত করা হবে ও পৃথিবী তার অভ্যন্তরে যা আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করবে ও শূন্যগর্ভ হবে।” (৮৪:৩-৪) সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জমীন তার কলেজার টুকরোগুলোকে উগরে দিবে এবং বাইরে নিক্ষেপ করবে। স্বর্ণ রৌপ্য স্তম্ভের মত বাইরে বেরিয়ে পড়বে। হত্যাকারী সে সব দেখে বলবেঃ হায়! আমি এই ধন সম্পদের জন্য অমুককে হত্যা করে ছিলাম, অথচ আজ ওগুলো এভাবে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, কেউ যেন ওগুলোর দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না!" আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দুর্ব্যবহারকারী দুঃখ করে বলবেঃ “হায়! এই ধন সম্পদের মোহে পড়ে আমি আমার আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করিনি!” চোর বলবেঃ “হায়! এই মাল ধনের জন্যে আমার হাত কেটে দেয়া হয়েছিল!” অতঃপর ওগুলো তাদেরকে ডাকবে, কিন্তু তারা ওগুলো হতে কিছুই গ্রহণ করবে না।” মোটকথা, সেই ধন সম্পদ এমনভাবে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকবে যে, ওগুলোর প্রতি কেউ চোখ তুলেও চাইবে না। মানুষ বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে সেদিকে তাকিয়ে বলবেঃ হায়! এগুলোর তো নড়া চড়া করার কোন শক্তি ছিল এগুলো তো স্তব্ধ নিথর হয়ে পড়ে থাকতো। আজ এগুলোর কি হলো যে, এমন থরথর করে কাঁপছে! পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মৃতদেহ জমীন বের করে দিবে। তখন মানুষ বলবেঃ এর কি হলো? জমীন ও আসমান সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে দেয়া হবে। ঐ দৃশ্য সবাই দেখবে এবং সবাইকে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সামনে হাযির করা হবে। জমীন খোলাখুলি ও সুস্পষ্টভাবে সাক্ষ্য দিবে যে, অমুক অমুক ব্যক্তি তার উপর অমুক অমুক নাফরমানী করেছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) এই আয়াতটি পাঠ করে বললেনঃ “জমীনের বৃত্তান্ত কি তা কি তোমরা জাননা?” সাহাবীগণ উত্তরে বললেনঃ 'আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আদম সন্তান যে সব আমল জমীনে করেছে তার সব কিছু জমীন এভাবে প্রকাশ করে দিবে, যে অমুক ব্যক্তি অমুক সময়ে অমুক জায়গায় এই এই পাপ ও এই এই পুণ্য কাজ করেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং আবু আবদির রহমান নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটি হাসান-সহীহ গারীব বলেছেন) মু’জামে তিবরানীতে হযরত রাবীআহ হাদাসী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জমীনের ব্যাপারে সাবধান থেকো। ওটা তোমাদের মা। ওর উপর যে ব্যক্তি যে পাপ বা পুণ্য কাজ করবে সে তো খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করে দিবে।” এখানে অহী দ্বারা আদেশ করা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা জমীনকে বলবেনঃ ‘বলে দাও। তখন সে বলে দিবে। সেদিন মানুষ হিসাবের জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের দলে বিভক্ত হয়ে ফিরবে। কেউ হবে পুণ্যবান এবং কেউ হবে পাপী। কেউ জান্নাতী হবে, আবার কেউ জাহান্নামী হবে। এ অর্থও করা হয়েছে যে, এখান থেকে তারা পৃথক হবে, আর তারা মসবেত হবে না। এর কারণ হলো এই যে, তারা নিজেদের আমলসমূহ জেনে নিবে এবং ভালমন্দের প্রতিফল পেয়ে যাবে। এজন্যেই শেষেও একথাই বলে দেয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঘোড়ার মালিকরা তিন প্রকারের। এক প্রকার হলো তারা যারা পুরস্কার ও পারিশ্রমিক লাভকারী। দ্বিতীয় প্রকার হলো তারা যাদের জন্যে ঘোড়া আবরণস্বরূপ। তৃতীয় প্রকার হলো তারা যাদের জন্যে ঘোড়া বোঝাস্বরূপ অর্থাৎ তারা পাপী। পুরস্কার বা পারিশ্রমিক লাভকারী বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা জিহাদের উদ্দেশ্যে ঘোড়া পালন করে। যদি ঘোড়ার দেহে ও পায়ে শিথিলতা দেখা দেয় এবং ঐ ঘোড়া এদিক ওদিকের চারণ ভূমিতে বিচরণ করে তাহলে এজন্যেও মালিক সওয়াব লাভ করবে। যদি ঘোড়ার রশি ছিড়ে যায় এবং ঐ ঘোড়াটি এদিক ওদিক চলে যায় তবে তার পদচিহ্ন এবং মল মূত্রের জন্যেও মালিক সওয়াব বা পুণ্য লাভ করবে। মালিকের পানি পান করাবার ইচ্ছা না থাকলেও ঘোড়া যদি কোন জলাশয়ে গিয়ে পানি পান করে তাহলেও মালিক সওয়াব পাবে। এই ঘোড়া তার মালিকের জন্যে পুরোপুরি পুণ্য ও পুরস্কারের মাধ্যম। দ্বিতীয় হলো ঐ ব্যক্তি যে স্বয়ং সম্পূর্ণ হওয়ার জন্যে ঘোড়া পালন করেছে, যাতে প্রয়োজনের সময় অন্যের কাছে ঘোড়া চাইতে না হয়, কিন্তু সে আল্লাহর অধিকারের কথা নিজের ক্ষেত্রে এবং নিজের সওয়ারীর ক্ষেত্রে বিস্মৃত হয় না। এই সওয়ারী ঐ ব্যক্তির জন্যে পর্দা স্বরূপ। আর তৃতীয় হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে অহংকার এবং গর্বের কারণে এবং অন্যদের উপর জুলুম অত্যাচার করার উদ্দেশ্যে ঘোড়া পালন করে, এই পালন তার উপর একটা বোঝা স্বরূপ এবং তার জন্যে গুনাহ স্বরূপ। রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে তখন জিজ্ঞেস করা হলোঃ “গাধা সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহ তা'আলা আমার প্রতি এই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অর্থবহ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন যে, বিন্দুমাত্র পুণ্য এবং বিন্দুমাত্র পাপও প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) এবং ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত ফারদাকের (রাঃ) চাচা হযরত সাআ’সাআ ইবনে মুআবিয়া (রাঃ) নবী (সঃ)-এর নিকট আগমন করলে তিনি তার সামনে (আরবি) আয়াত দু’টি পাঠ করেন। তখন হযরত সাআ’সাআ (রাঃ) বলেনঃ “এ আয়াত দু’টিই আমার জন্যে যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশী যদি নাও শুনি তবুও কোন অসুবিধা হবে না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) সহীহ বুখারীতে হযরত আদী ইবনে হাতিম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “অর্ধেক খেজুর সাদকা করার মাধ্যমে হলেও এবং ভাল কথার মাধ্যমে হলেও আগুন হতে আত্মরক্ষা করো।” একইভাবে সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “পুণ্যের কাজকে কখনো হালকা মনে করো না, নিজের বালতি দিয়ে পানি তুলে কোন পিপাসার্তকে পান করানো অথবা কোন মুসলমান ভাই এর সাথে অন্তরঙ্গ অনুভূতি সহকারে দেখা করাও পুণ্যের কাজ বলে মনে করবে।” অন্য একটি সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “হে নারীদের দল! তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীদের পাঠানো উপঢৌকনকে তুচ্ছ মনে করো না, যদিও তারা এটা পায়ের গোড়ালীও অর্থাৎ খুরও পাঠায়। অন্য একটি হাদীসে রয়েছেঃ “ভিক্ষুককে কিছু না কিছু দাও, আগুনে পোড়া একটা খুর হলেও দাও।” মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হে আয়েশা। (রাঃ)! পাপকে কখনো তুচ্ছ মনে করো না। মনে রেখো, তারও হিসাব হবে।" হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সঃ) সাথে আহার করছিলেন এমন সময় এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। হযরত আবু বকর (রাঃ) তখন খাবার হতে হাত তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাপেরও বদলা আমাকে দেয়া হবে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! পৃথিবীতে তুমি যে সব দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছে তাতে তোমার ছোট খাট পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেছে, পুণ্যসমূহ তোমার জন্যে আল্লাহর কাছে রক্ষিত রয়েছে। এগুলোর প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে কিয়ামতের দিন তোমাকে প্রদান করা হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন) অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, এ সূরাটি হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর উপস্থিতিতে অবতীর্ণ হয়। তিনি শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “এই সূরাটি আমাকে কাঁদিয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন না। এরূপ ধারণা করে তোমরা যদি গুনাহ না করতে তাহলে আল্লাহ তা'আলা অন্য কোন উম্মত সৃষ্টি করতেন যারা ভুল করতো ও গুনাহ করতো, অতঃপর পরম করুণাময় আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করতেন।” (এ হাদীসটিও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন) মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবি) যখন আয়াত দু'টি অবতীর্ণ হয় তখন তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি কি আমার সব আমলই দেখবো?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যা।” তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “বড় বড় সব আমল?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃ “হ্যা” তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ “ছোট ছোট সব আমল?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হ্যা তখন হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বললেনঃ “হায়, আফসোস!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “হে আবু সাঈদ (রাঃ)! খুশী হয়ে যাও, জেনে রেখো যে, আল্লাহ তা'আলা পুণ্যের পরিমাণ দশগুণ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত দেন, এমনকি যাকে ইচ্ছা করেন তার চেয়েও বেশী প্রদান করেন কিন্তু গুনাহ সমপরিমাণই থাকবে অথবা আল্লাহ গুনাহগারকে ক্ষমা করে দিবেন। মনে। রাখবে যে, কোন লোককে শুধু তার আমল মুক্তি দিতে পারবে না।” একথা শুনে হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) আপনাকেও নয়?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃ “হ্যা, আমাকেও নয়। তবে আল্লাহ তা'আলা আমাকে তার রহমত দ্বারা ঢেকে দিবেন। আবু যারআহ (রঃ) বলেন যে, (এই হাদীসটি শুধুমাত্র ইবনে লাহীআহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) বলেন, যখন(আরবি) (অর্থাৎ “আহার্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে (৭৬:৮)।” যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন মুসলমানরা মনে করেন যে, তারা সামান্য জিনিস প্রদান করলে কোন বিনিময় প্রাপ্ত হবেন না। তাই, তাদের দরজায় ফকীর মিকসীন আসলে তারা তাদেরকে এক আধটা খেজুর, রুটির টুকরা ইত্যাদি দেয়াকে বৃথা মনে করে শূন্য হস্তেই ফিরিয়ে দিতেন। তারা চিন্তা করতেন যে, যদি দিতে পারেন তবে ভালো ও উৎকৃষ্ট কোন জিনিসই দিবেন। এ ধরনের চিন্তা একটি দল করতেন। অন্য কেটি দল মনে করতেন যে, ছোট খাট পাপের জন্য কৈফিয়ত তলব করা হবে না। যেমন কখনো মিথ্যা কথা বলা, এদিক ওদিক তাকানো, কারো গীবত করা ইত্যাদি। তখন অবতীর্ণ হলো, (আরবি) এই আয়াত দু'টি। অর্থাৎ “কেউ অণু পরিমাণ সঙ্কাজ করলে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসত্তাজ করলে তাও দেখবে।” তাদেরকে আরো বলা হলোঃ ছোট খাট পুণ্য বা নেক কাজকে তুচ্ছ মনে করো ওটা বড়রূপে দেখা দিবে। আর ছোট খাট পাপকেও তুচ্ছ মনে করো না। কেন না, এই ছোট খাট পাপসমূহই একত্রিত হয়ে বিরাট আকার ধারণ করবে।” এর অর্থ হলো ছোট পিপীলিকা। অর্থাৎ আমলনামায় ছোট বড় সব আমলই দেখা যাবে। গুনাহ তো একটির স্থলে একটিই লিখা হয়, কিন্তু পুণ্য বা নেককাজ একটির বদলে দশ, বরং যার জন্যে আল্লাহ চান এরচেয়ে অনেকগুণ বেশী লিখেন। আবার অনেক সময় নেকীর বদলে গুনাহ্ মার্জনাও করে দেন। এক একটি নেকীর বদলে দশ দশটি গুনাহ মাফ হয়ে যায়। তারপর এমনও রয়েছে যে, যার পুণ্য বা নেকী গুনাহর চেয়ে একবিন্দু পরিমাণ বেশী হবে সে জান্নাতে প্রবেশাধিকার লাভ করবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “পাপকে হালকা মনে করো সব পাপ একত্রিত হয়ে ধ্বংস করে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এসব পাপের উদাহরণ প্রসঙ্গে বলেনঃ “যেমন কিছু লোক কোন জায়গায় অবতরণ করলো। তারপর একটি লোক একটি দু'টি করে কাঠ কুড়িয়ে জমা করলো। এতে কাঠের একটা স্কুপ হয়ে গেল। তারপর ঐ কাঠে অগ্নি সংযোগ করা হলো এবং তারা যা ইচ্ছা করলো তা রান্না করলো।”
@৯৯ নং সূরা আল-যিলযাল-আয়াত ০৭
فَمَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ خَیۡرًا یَّرَہٗ ؕ﴿۷﴾
কেউ অণু পরিমাণ সৎকাজ করলে সে তা দেখবে [১]।
@[১] এ আয়াতে خير বলে শরীয়তসম্মত সৎকর্ম বোঝানো হয়েছে; যা ঈমানের সাথে সম্পাদিত হয়ে থাকে। কেননা, ঈমান ব্যতীত কোন সৎকর্মই আল্লাহ্র কাছে সৎকর্ম নয়। কুফার অবস্থায় কৃত সৎকর্ম আখেরাতে ধর্তব্য হবে না যদিও দুনিয়াতে তার প্রতিদান দেয়া হয়। তাই এ আয়াতকে এ বিষয়ের প্রমাণস্বরূপ পেশ করা হয় যে, যার মধ্যে অণু পরিমাণ ঈমান থাকবে, তাকে অবশেষে জাহান্নাম থেকে বের করে নেয়া হবে। কেননা, এ আয়াতের ওয়াদা অনুযায়ী প্রত্যেকের সৎকর্মের ফল আখেরাতে পাওয়া জরুরী। কোন সৎকর্ম না থাকলেও স্বয়ং ঈমানই একটি বিরাট সৎকর্ম বলে বিবেচিত হবে। ফলে মুমিন ব্যক্তি যতবড় গোনাহগারই হোক, চিরকাল জাহান্নামে থাকবে না। কিন্তু কাফের ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন সৎকর্ম করে থাকলে ঈমানের অভাবে তা পণ্ডশ্রম মাত্র। তাই আখেরাতে তার কোন সৎকামই থাকবে না।
@অর্থ : অণু। এখানে উদ্দেশ্য সবচেয়ে ছোটতম গুনাহ বা নেকী তাও দেখতে পাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(یَوْمَ تَجِدُ کُلُّ نَفْسٍ مَّا عَمِلَتْ مِنْ خَیْرٍ مُّحْضَرًاﹴ وَّمَا عَمِلَتْ مِنْ سُوْ۬ئٍﹱ تَوَدُّ لَوْ اَنَّ بَیْنَھَا وَبَیْنَھ۫ٓ اَمَدًۭا بَعِیْدًا)
“প্রত্যেক মানুষ যা ভাল করেছে এবং খারাপ করেছে কিয়ামতের দিন সবই উপস্থিত পাবে। সে কামনা করবে তার ও তার অন্যায় কাজের মধ্যে যদি অনেক দুরত্ব থাকত!” (সূরা আলি ইমরান ৩: ৩০)
@ আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, তিনি প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব কথাই ভালই জানেন। কোন ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্ৰমত কথাও তাঁর নিকট লুক্কায়িত থাকে না। তার জ্ঞান সমস্ত জিনিসকে প্রতি মুহূর্তে বেষ্টন করে রয়েছে। পৃথিবী প্রান্তে, পর্বতে, সমুদ্রে, আকাশে, বাতাসে, ছিদ্রে মোটকথা যেখানে যা কিছু আছে সবই তাঁর গোচরে রয়েছে। সব কিছুর উপরেই তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা বিদ্যমান। তিনি যেভাবেই চান রাখেন, যাকে ইচ্ছে করেন শাস্তি দেন। সুতরাং এত ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী ও এতবড় ক্ষমতাবান হতে সকলেরই সদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকা, সদা-সর্বদা তাঁর আদেশ পালনে নিয়োজিত থাকা এবং অবাধ্যতা হতে বিরত থাকা উচিত। তিনি সবজান্তাও বটে এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারীও বটে। সম্ভবতঃ তিনি কাউকে ঢিল দিয়ে রাখবেন, কিন্তু যখন ধরবেন তখন এমন কঠিনভাবে ধরবেন যে, পালিয়ে যাবার কোন উপায় থাকবে না। এমন একদিন আসবে যেদিন সমস্ত ভাল-মন্দ কাজের হিসেব সামনে রেখে দেয়া হবে। পুণ্যের কাজ দেখে আনন্দ লাভ হবে এবং মন্দ কাজ দেখে দাঁত কামড়াতে থাকবে ও হা-হুতাশ করবে। সেদিন তারা ইচ্ছে পোষণ করবে যে, যদি তার মধ্যে ও ঐ মন্দ কার্যের মধ্যে বহু দূরের ব্যবধান থাকতো তবে কতই না চমৎকার হতো! কুরআন কারীমের আর এক স্থানে ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ সেদিন মানুষকে তার পূর্বের ও পরের কৃৎকর্মের সংবাদ দেয়া হবে। (৭৫:১৩) দুনিয়ায় যে শয়তান তার সঙ্গে থাকতো এবং তাকে অন্যায় কার্যে উত্তেজিত করতো সেদিন তার উপরও সে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবে এবং বলবেঃ (আরবী) অর্থাৎ হে শয়তান, যদি তোমার ও আমার মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান হতো তবে কতই না ভাল হতো! তুমি মন্দ সাথী।' (৪৩:৩৮) আল্লাহ তা'আলা বলেন-“আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় অস্তিত্ব হতে অর্থাৎ স্বীয় শাস্তি হতে ভয় প্রদর্শন করছেন। অতঃপর তিনি স্বীয় সৎ বান্দাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছেন যে, তারা যেন তাঁর দয়া ও স্নেহ হতেও নিরাশ না হয়। কেননা, তিনি। অত্যন্ত দয়ালু ও স্নেহশীল। ইমাম হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ “এটাও তার সরাসরি দয়া ও ভালবাসা যে, তিনি স্বীয় অস্তিত্ব হতে বান্দাদেরকে ভয় দেখিয়েছেন। এও ভাবার্থ হতে পারে যে, আল্লাহ তা'আলা বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। সুতরাং বান্দাদেরও উচিত যে, তারা যেন সরল-সঠিক পথ হতে সরে না পড়ে, পবিত্র ধর্মকে পরিত্যাগ না করে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আনুগত্য হতে মুখ ফিরিয়ে না নেয়।
@ অর্থাৎ তার মধ্যে এবং তার আমলের মধ্যে বিশাল ব্যবধান কামনা করবে। তারা চাইবে যেন তাদের আমলনামা তাদেরকে দেয়া না হয়।
@ আল্লাহ তা‘আলা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবকিছু জানেন, কিছুই তার কাছে গোপন নেই- সে কথাই এ আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
কিয়ামাতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তি তার আমলনামা উপস্থিত পাবে। যাদের আমলনামা খারাপ হবে তারা আফসোস করে বলবে, হায়! যদি আমার ও আমার এ খারাপ আমলের মধ্যে অনেক দূরত্ব হতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاَمَّا مَنْ اُوْتِیَ کِتٰبَھ۫ بِشِمَالِھ۪ﺃ فَیَقُوْلُ یٰلَیْتَنِیْ لَمْ اُوْتَ کِتٰبِیَھْﭨﺆ وَلَمْ اَدْرِ مَا حِسَابِیَھْ)
“আর যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে: হায়! আমাকে যদি আমার আমলনামা না দেয়া হত। এবং আমি যদি আমার হিসাব কী, তা না জানতাম!” (সূরা হাক্কাহ ৬৯:২৫-২৬)
@আল্লাহ তা‘আলা ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের আলোচনার পর বাম হাতে আমলনামাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আলোচনা নিয়ে এসেছেন। তারা আখিরাতে যে আফসোস করবে ও তাদের জন্য যে শাস্তির ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে তার বিবরণও এখানে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। জাহান্নামের শিকলের বিবরণ দিতে গিয়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যদি আকাশ হতে একটি বড় পাথর নিক্ষেপ করা হয় তবে তা এক রাতে পৃথিবীতে এসে পড়বে। কিন্তু ওটাকেই যদি জাহান্নামীকে বাঁধার শৃংখলের একমাথা হতে নিক্ষেপ করা হয় তবে তা অন্য মাথায় পড়তে ৪০ বছর লেগে যাবে। (আহমাদ হা. ৬৮৫৬, তিরমিযী হা. ২৫৮৮ সনদ সহীহ)
যাদের বাম হাতে আমলনামা প্রদান করা হবে তাদের হায় হুতাশের শেষ থাকবে না।
জাহান্নামী ব্যক্তির ক্ষমতা, সন্তান-সন্ততি ও সহায়-সম্পদ কোন উপকারে আসবে না।
জাহান্নামে যাওয়ার কারণ জানলাম ও তার শাস্তির বিবরণ জানলাম।
যে শয়তান তাকে খারাপ কাজে প্রেরণা দিয়েছে তার কাছ থেকেও দূরে থাকার আফসোস প্রকাশ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قَالَ يَا لَيْتَ بَيْنِيْ وَبَيْنَكَ بُعْدَ الْمَشْرِقَيْنِ فَبِئْسَ الْقَرِيْنُ)
“সে (শয়তানকে) বলবে: হায়! আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান থাকত! কতই না নিকৃষ্ট সহচর সে!” (সূরা যুখরুƒফ ৪৩:৩৮) সুতরাং যে শয়তানের প্রতারণায় আমরা আজ অপরাধের সাগরে ডুবে আছি কিয়ামতের দিন সে শয়তানকে দোষ দেয়ার সুযোগ থাকবে না; বরং নিজের অপরাধের বোঝা নিজেকেই বহন করে লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে যেতে হবে।
মানুষ যা প্রকাশ করে ও গোপন করে এমনকি আকাশে ও জমিনে যা আছে তাও আল্লাহ তা‘আলা জানেন।
ভাল-মন্দ সবকিছুর প্রতিদান মানুষ পাবে।
পাপাচারীগণ কিয়ামতের দিন আফসোস করবে; কিন্তু তাদের আফসোস কোন কাজে আসবে না।
মূলত এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে ভাল কাজে উৎসাহ ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তাই আমাদের ভাল কাজে উৎসাহী ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষ যা কিছু করছে সব ব্যাপারে জমিন সাক্ষ্য দেবে।
২. মানুষ তার কৃত বিন্দু পরিমাণ ভালমন্দ আমলও দেখতে পাবে।
@আয়াতে خَيْرً বলে শরীয়তসম্মত সৎ কর্ম বোঝানো হয়েছে। যা ঈমানের সাথে সম্পাদিত হয়ে থাকে। কেননা, ঈমান ব্যতীত কোন সৎ কর্মই আল্লাহর কাছে সৎ কর্ম নয়। কুফর অবস্থায় কৃত সৎ কর্ম পরকালে ধর্তব্য হবেনা যদিও দুনিয়াতে তার প্রতিদান দেওয়া হয়। তাই এ আয়াতকে এ বিষয়ের প্রমাণস্বরূপ পেশ করা হয় যে, যার মধ্যে অণু পরিমাণ ঈমান থাকবে, তাকে অবশেষে জাহান্নাম থেকে র করে নেওয়া হবে। কেননা, এ আয়াতের ওয়াদা অনুযায়ী প্রত্যেকের সৎ কর্মের ফল পরকালে পাওয়া জরুরী। কোন সৎ কর্ম না থাকলেও স্বয়ং ঈমানই একটি বিরাট সৎকর্ম বলে বিবেচিত হবে। ফলে মু’মিন ব্যক্তি যত বড় গোনাহ্গারই হোক, চিরকাল জাহান্নামে কবে না। কিন্তু কাফির ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন সৎকর্ম করে থাকলে ঈমানেরও অভাবে তা পশুশ্রম মাত্র। তাই পরকালে তার কোন সৎ কাজই থাকবে না।
তিনি আরো বলেছেন,
﴿ وَمَا تُقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُم مِّنۡ خَيۡرٖ تَجِدُوهُ عِندَ ٱللَّهِ هُوَ خَيۡرٗا وَأَعۡظَمَ أَجۡرٗاۚ ﴾ [المزمل: ٢٠]
অর্থাৎ “তোমরা তোমাদের আত্মার মঙ্গলের জন্য ভাল যা কিছু অগ্রিম প্রেরণ করবে তোমরা তা আল্লাহর নিকট উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসাবে মহত্তর পাবে।” (সূরা মুযযাম্মিল ২০ আয়াত)
@এর অর্থ হলো, আখেরাতের জন্য যা কিছু তোমরা আগেই পাঠিয়ে দিয়েছো তা তোমাদের ঐ সব জিনিসের চেয়ে অনেক বেশী উপকারী যা তোমরা দুনিয়াতেই রেখে দিয়েছো এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্ত কোন কল্যাণকর কাজে ব্যয় করোনি। হাদীসে উল্লেখ আছে, একবার রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের এমন কেউ আছে যার নিজের অর্থ-সম্পদ তার উত্তরাধিকারীর অর্থ-সম্পদের চেয়ে তার কাছে বেশী প্রিয়? জবাবে লোকেরা বললো, “হে আল্লাহ্র রাসূল, আমাদের মধ্যে কেউ-ই এমন নেই যার নিজের অর্থ-সম্পদ তাঁর কাছে তার উত্তরাধিকারীর অর্থ-সম্পদ থেকে বেশী প্রিয় নয়।” তখন তিনি বললেনঃ ‘তোমরা কি বলছো তা ভেবে দেখো।’ লোকেরা বললো, হে আল্লাহ্র রাসূল, আমাদের অবস্থা আসলেই এরূপ। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের নিজের অর্থ-সম্পদ তো সেইগুলো যা তোমরা আখেরাতের জন্য অগ্রিম পাঠিয়ে দিয়েছো। আর যা তোমরা রেখে দিয়েছো সেগুলো ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের অর্থ-সম্পদ৷ [বুখারী: ৬৪৪২] [ইবন কাসীর]
@অর্থাৎ, নফল নামাযসমূহ, সাদাকা-খয়রাত এবং অন্যান্য যে সব সৎকর্মই করবে, আল্লাহর কাছে তার উত্তম প্রতিদান পাবে। অধিকাংশ মুফাসসিরের নিকট ২০ নং এই আয়াতটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই জন্য তাঁরা বলেন যে, এর অর্ধেক অংশ মক্কায় এবং অর্ধেক অংশ মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। (আইসারুত্ তাফাসীর)
@অর্থাৎ “তোমরা তোমাদের আত্মার মঙ্গলের জন্যে ভাল কাজ যা কিছু অগ্রীম প্রেরণ করবে তোমরা তা পাবে আল্লাহর নিকট। ওটা উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসেবে মহত্তর।
হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমাদের মধ্যে কে নিজের সম্পদের চেয়ে (নিজের) উত্তরাধিকারীর সম্পদকে বেশী ভালবাসে?” সাহাবীগণ উত্তরে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে নিজের সম্পদের চেয়ে উত্তরাধিকারীদের সম্পদকে বেশী ভালবাসে।” তিনি বললেনঃ “যা বলছো চিন্তা করে বল।” তাঁরা বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা তো এটা ছাড়া অন্য কিছু জানি না।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “যে ব্যক্তি যা (আল্লাহর পথে) খরচ করবে তাই শুধু তার নিজের সম্পদ, আর যা সে রেখে যাবে তাই তার উত্তরাধিকারীদের সম্পদ।” (এ হাদীসটি হাফিয আকূল ইয়ালা মুসিলী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী ও সুনানে নাসাঈতেও হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে)
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। অর্থাৎ খুব বেশী বেশী আল্লাহকে স্মরণ কর এবং তোমাদের সমস্ত কার্যে তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। কেননা, তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু ঐ ব্যক্তির উপর যে তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে।
@এর অর্থ হলো, আখেরাতের জন্য যা কিছু তোমরা আগেই পাঠিয়ে দিয়েছো তা তোমাদের ঐ সব জিনিসের চেয়ে অনেক বেশী উপকারী যা তোমরা দুনিয়াতেই রেখে দিয়েছো এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্ত কোন কল্যাণকর কাজে ব্যয় করোনি। হাদীসে উল্লেখ আছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণনা করেছেন যে, এক সময় রসূলুল্লাহ ﷺ জিজ্ঞেস করলেনঃ أَيُّكُمْ مَالُهُ أَحَبُّ إلَيْهِ مِنْ مَالِ وَارِثِهِ "তোমাদের এমন কেউ আছে যার নিজের অর্থ-সম্পদ তার উত্তরাধিকারীর অর্থ-সম্পদের চেয়ে তার কাছে বেশী প্রিয়? জবাবে লোকেরা বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের মধ্যে কেউ-ই এমন নেই যার নিজের অর্থ-সম্পদ তাঁর কাছে তার উত্তরাধিকারীর অর্থ-সম্পদ থেকে বেশী প্রিয় নয়। ” তখন তিনি বললেনঃ “তোমরা কি বলছো তা ভেবে দেখো। ” লোকেরা বললোঃ হে আল্লাহর রসূল, আমাদের অবস্থা আসলেই এরূপ। একথা শুনে নবী ﷺ বললেনঃ إنَّمَا مَالُ أَحَدِكُمْ مَا قَدَّمَ وَمَالُ وَارِثِهِ مَا أَخَّرَ তোমাদের নিজের অর্থ-সম্পদ তো সেই গুলো যা তোমরা আখেরাতের জন্য অগ্রিম পাঠিয়ে দিয়েছো। আর যা তোমরা রেখে দিয়েছো সেগুলো ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের অর্থ-সম্পদ। (বুখারী, নাসায়ী ও মুসনাদে আবু ইয়ালা)।
তিনি আরো বলেছেন,
﴿ وَمَا تُنفِقُواْ مِنۡ خَيۡرٖ فَإِنَّ ٱللَّهَ بِهِۦ عَلِيمٌ ﴾ [البقرة: ٢٧٣]
অর্থাৎ “আর তোমরা যা কিছু ধন-সম্পদ দান কর, আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত।” (সূরা বাক্বারাহ ২৭৩ আয়াত)
@ মুশরিকদেরকে দান করা প্রসঙ্গ
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, মুসলিম সাহাবীগণ তাঁদের মুশরিক আত্মীয়দের সাথে আদান-প্রদান করতে অপছন্দ করতেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে এই সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয়। তখন এই ২৭২নং আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং তাঁদেরকে তাঁদের মুশরিক আত্মীয়দের সাথে লেনদেন করার অনুমতি দেয়া হয়। (হাদীসটি সহীহ। সুনান নাসাঈ -৬/৩০৫/১১০৫২, মুসতাদরাক হাকিম-২/২৮৫) ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেনঃ ‘সাদাকাহ শুধুমাত্র মুসলিমদেরকে দেয়া হবে।’ যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘ভিক্ষুক যে কোন মতাবলম্বী হোক কেন, তোমরা তাদেরকে সাদাকাহ প্রদান করো। (হাদীসটি য‘ঈফ। তাফসীর ইবনু আবী হাতিম)
আসমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটি-
﴿لَا یَنْهٰىكُمُ اللهُ عَنِ الَّذِیْنَ لَمْ یُقَاتِلُوْكُمْ فِی الدِّیْنِ وَلَمْ یُخْرِجُوْكُمْ مِّنْ دِیَارِكُمْ﴾
‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি, আর তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ী থেকে বের করে দেয়নি’ (৬০ নং মুমতাহিনাহ, আয়াত-৮) এই আয়াতের তাফসীরে ইনশা’আল্লাহ্ আসবে। এখানে মহান আল্লাহ্ বলেন, وَمَاتُنفِقُوْامِنْخَيْرٍفَلانفُسِكُمْ ‘তোমরা যা কিছু খরচ করবে তা নিজেদের উপকারের জন্যই করবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
﴿وَ مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِاَنْفُسِهِمْ یَمْهَدُوْنَ﴾
যারা সৎ কাজ করে তারা নিজেদেরই জন্য রচনা করে সুখ-শয্যা। (৩০ নং সূরাহ্ রূম, আয়াত নং ৪৪) অপর আয়াতে মহান আল্লাহ্ আরো বলেনঃ
﴿ مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِهٖ﴾
যে ব্যক্তি ভালো কাজ করলো তা তার নিজের জন্যই করলো। (৪১ নং সূরাহ্ হা-মীম সাজদাহ, আয়াত নং ৪৬) এ ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে।
অতঃপর মহান আল্লাহ্ বলেনঃ وَمَاتُنْفِقُوْنَإِلَّاابْتِغَاءوَجْهِاللهِ হাসান বাসরী (রহঃ) বলেনঃ ‘মুসলিমের প্রত্যেক খরচ মহান আল্লাহ্র জন্যই হয়ে থাকে, যদিও সে নিজেই খায় ও পান করে।’ (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ৩/১১৫) ‘আতা খুরাসানী (রহঃ) এর ভাবার্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ যখন তুমি মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দান করবে তখন দান গ্রহীতা যে কেউ হোক না কেন এবং যে কোন কাজই করুক না কেন তুমি তার পূর্ণ প্রতিদান লাভ করবে।’ (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ৩/১১৫) এই ভাবার্থটিও খুব উত্তম। মোট কথা এই যে, সৎ উদ্দেশ্যে দানকারীর প্রতিদান যে মহান আল্লাহ্র দায়িত্বে রয়েছে তা সাব্যস্ত হয়ে গেলো। এখন সেই দান কোন সৎ লোকের হাতেই যাক বা কোন মন্দ লোকের হাতেই যাক, এতে কিছু যায় আসে না। সে তার সৎ উদ্দেশের কারণে প্রতিদান পেয়েই যাবে। যদিও সে দেখে-শুনে ও বিচার-বিবেচনা করে দান করে থাকে অতঃপর ভুল হয়ে যায় তাহলে তার দানের সাওয়াব নষ্ট হবে না। এ জন্য আয়াতের শেষে প্রতিদান প্রাপ্তির সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
قَالَ رَجُلٌ لَأَتَصَدَّقَنَّ اللَّيْلَةَ بِصَدَقَةٍ، فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِي يَدِ زَانِيَةٍ، فَأَصْبَحَ النَّاسُ يَتَحَدَّثُونَ: تُصُدِّقَ عَلَى زَانِيَةٍ، فَقَالَ: اللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى زَانِيَةٍ، لَأَتَصَدَّقَنَّ اللَّيْلَةَ بِصَدَقَةٍ فَوَضَعَهَا فِي يَدِ غَنِيٍّ، فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ: تُصُدِّقَ الليلة على غني، قال: اَللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى غَنِيٍّ، لَأَتَصَدَّقَنَّ اللَّيْلَةَ بصدقة، فخرج فَوَضَعَهَا فِي يَدِ سَارِقٍ فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ: تُصُدِّقَ اللَّيْلَةَ عَلَى سَارِقٍ، فَقَالَ: اَللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى زَانِيَةٍ وَعَلَى غَنِيٍّ وَعَلَى سَارِقٍ، فَأُتِيَ فَقِيلَ لَهُ: أَمَّا صَدَقَتُكَ فَقَدْ قُبِلَتْ، وَأَمَّا الزَّانِيَةُ فَلَعَلَّهَا أَنْ تَسْتَعِفَّ بِهَا عَنْ زِنَاهَا، وَلَعَلَّ الْغَنِيَّ يَعْتَبِرُ فَيُنْفِقُ مِمَّا أَعْطَاهُ اللَّهُ، وَلَعَلَّ السَّارِقَ أَنْ يَسْتَعِفَّ بِهَا عَنْ سَرِقَتِهِ.
‘এক ব্যক্তি ইচ্ছা করলোঃ ‘আজ আমি রাতে দান করবো।’ অতঃপর সে দান নিয়ে বের হয় এবং একটি ব্যভিচারিনীর হাতে দিয়ে দেয়। সকালে জনগণের মধ্যে এই কথা নিয়ে সমালোচনা হতে থাকে যে, এক ব্যভিচারিণীকে সাদাকাহ দেয়া হয়েছে। এ কথা শুনে লোকটি বললোঃ ‘হে মহান আল্লাহ্! আপনার জন্যই সমস্ত প্রশংসা যে, আমার দান ব্যভিচারিণীর হাতে পড়েছে।’ আবার সে বললোঃ ‘আজ রাতেও আমি অবশ্যই সাদাকাহ প্রদান করবো। অতঃপর এক ধনী ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়। আবার সকালে জনগণ আলোচনা করতে থাকে যে, রাতে এক ধনী লোককে দান করা হয়েছে। সে বললোঃ হে মহান আল্লাহ্! আপনার জন্যই সমুদয় প্রশংসা যে, আমার দান একজন ধনী ব্যক্তির ওপরে পড়েছে।’ আবার সে বললোঃ ‘আজ রাতেও আমি অবশ্যই দান করবো।’ অতঃপর সে এক চোরের হাতে দিয়ে দেয়। সকালে পুনরায় জনগণের মধ্যে আলোচনা হতে থাকে যে, রাতে এক চোরকে সাদাকাহ দেয়া হয়েছে। তখন সে বললোঃ হে মহান আল্লাহ্! আপনার জন্য সমস্ত প্রশংসা যে, আমার ব্যভিচারিণী, ধনী ও চোরের হাতে পড়েছে।’ অতঃপর সে স্বপ্নে দেখে যে, একজন ফিরিশতা এসে বলেছেনঃ তোমার দানগুলো মহান আল্লাহ্র নিকট গৃহীত হয়েছে। সম্ভবত দুশ্চরিত্র নারীটি তোমার দান পেয়ে ব্যভিচার থেকে বিরত থাকবে,হয়তো ধনী লোকটি এর দ্বারা শিক্ষা গ্রহণ করবেন এবং সেও দান করতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে, আর হতে পারে যে, মাল পেয়ে চোরটি চুরি করা ছেড়ে দিবে।’ (সহীহুল বুখারী-৩/৩৪০/১৪২১, ফাতহুল বারী -৩/৩৪০, সহীহ মুসলিম-২/৭০৯/৭৮, মুসনাদ আহমাদ -২/৩২২)
কে দান-সাদাকাহ পাওয়ার যোগ্য
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ ﴿لِلْفُقَرَآءِالَّذِیْنَاُحْصِرُوْافِیْسَبِیْلِاللّٰهِ﴾ সাদাকাহ ঐ মুহাজিরদের প্রাপ্য যারা ইহলৌকিক সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বদেশ পরিত্যাগ করে, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে একমাত্র মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কাছে মাদীনায় উপস্থিত হয়েছে। তাদের জীবন যাপনের এমন কোন উপায় নেই যা তাদের জন্য যথেষ্ট হতে পারে এবং তারা সফরও করতে পারে না যে, চলে-ফিরে নিজেদের খাওয়া পরার ব্যবস্থা করতে পারে।’ অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ্ বলেনঃ ﴿ وَ اِذَا ضَرَبْتُمْ فِی الْاَرْضِ فَلَیْسَ عَلَیْكُمْ جُنَاحٌ اَنْ تَقْصُرُوْا مِنَ الصَّلٰوةِ ﴾
‘আর যখন তোমরা ভূ-পৃষ্ঠে ভ্রমণ করো তখন সালাত সংক্ষেপ করলে তোমাদের কোন অপরাধ নেই।’ (৪ নং সূরাহ্ নিসা, আয়াত নং ১০১) অন্যত্র মহান আল্লাহ্ আরো বলেনঃ
﴿عَلِمَ اَنْ سَیَكُوْنُ مِنْكُمْ مَّرْضٰى١ۙ وَ اٰخَرُوْنَ یَضْرِبُوْنَ فِی الْاَرْضِ یَبْتَغُوْنَ مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ١ۙ وَ اٰخَرُوْنَ یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ ﴾
‘মহান আল্লাহ্ জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, কেউ কেউ মহান আল্লাহ্র অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ ভ্রমণ করবে এবং কেউ কেউ মহান আল্লাহ্র পথে সংগ্রামে লিপ্ত হবে।’ (৭৩ নং সূরাহ্ মুয্যাম্মিল, আয়াত নং ২০) তাদের অবস্থা যাদের জানা নেই তারা তাদের বাহ্যিক পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে এবং কথা-বার্তা শুনে তাদেরকে ধনী মনে করে। বিশুদ্ধ হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
لَيْسَ الْمِسْكِينُ بِهَذَا الطَّوَّافِ الَّذِي تَرُدُّهُ التَّمْرَةُ وَالتَّمْرَتَانِ، وَاللُّقْمَةُ وَاللُّقْمَتَانِ، وَالْأُكْلَةُ وَالْأُكْلَتَانِ، وَلَكِنَّ الْمِسْكِينَ الَّذِي لَا يَجِدُ غِنًى يُغْنِيهِ، وَلَا يُفْطَنُ لَهُ فَيُتَصَدقَ عَلَيْهِ، وَلَا يَسْأَلُ النَّاسُ شَيْئًا.
‘ঐ ব্যক্তি মিসকীন নয়, যে বাড়ী বাড়ী ঘুরে বেড়ায়, কোথায়ও হয়তো একটি খেজুর পেলো, কোথায়ও হয়তো দু’এক গ্রাস খাবার পেলো, আবার কোন জায়গায় হয়তো দু’একদিনের খাদ্য প্রাপ্ত হলো। বরং মিসকীন ঐ ব্যক্তি যার নিকট ঐ পরিমাণ খাদ্য নেই যার দ্বারা সে অমুখাপেক্ষী হতে পারে এবং সে তার অবস্থাও এমন করেনি যার ফলে মানুষ তার অভাব অনুভব করে তার প্রতি কিছু অনুগ্রহ করবে। আবার ভিক্ষা করার অভ্যাসও তার নেই।’ (সহীহুল বুখারী-৩/৩৯৯/১৪৭৯, ফাতহুল বারী -৩/৩৯৯, সহীহ মুসলিম-২/১০১/৭১৯, মুসনাদ আহমাদ -২/৩১৬) ইমাম আহমাদ (রহঃ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (মুসনাদ আহমাদ -১/৩৮৪) কিন্তু যাদের অন্তরদৃষ্টি রয়েছে তাদের কাছে এদের অবস্থা গোপন থাকেনা। যেমন অন্যত্র মহান আল্লাহ্ বলেনঃ ﴿ سِیْمَاهُمْ فِیْ وُجُوْهِهِمْ ﴾
তাদের মুখে সাজদার চিহ্ন থাকবে। (৪৮ নং সূরাহ্ ফাত্হ, আয়াত নং ২৯) অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ্ আরো বলেনঃ
﴿وَ لَتَعْرِفَنَّهُمْ فِیْ لَحْنِ الْقَوْلِ﴾
তুমি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদের চিনতে পারবে। (৪৭ নং সূরাহ্ মুহাম্মাদ, আয়াত নং ৩০) অতঃপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেনঃ
لَا يَسْأَلُوْنَ النَّاسَ إِلْحَافًا
‘তারা কাকুতি মিনতি করে কারো কাছে প্রার্থনা করে না’ অর্থাৎ তারা যাঞ্চার দ্বারা মানুষকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে না এবং তাদের কাছে সামান্য কিছু থাকা অবস্থায় তারা মানুষের কাছে হাত বাড়ায় না। প্রয়োজনের উপযোগী কিছু বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যে ভিক্ষাবৃত্তি পরিত্যাগ করে না তাকেই পেশাগত ভিক্ষুক বলা হয়। ইমাম আহমাদ (রহঃ) বর্ণনা করেন, আবূ সা‘ঈদ (রহঃ) বলেনঃ আমার মা আমাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কাছ থেকে কিছু সাহায্য পাবার উদ্দেশ্যে তাঁর কাছে পাঠালেন। কিন্তু আমি তাঁর কাছে যাওয়ার পর কিছু না চেয়ে ওখানে বসে পড়লাম। তিনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন এবং বললেনঃ যে অল্পতে তুষ্টি লাভ করে মহান আল্লাহ্ তার ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করে দিবেন, যে ব্যক্তি বিনয়ী হবে মহান আল্লাহ্ তাকে সজ্জন হিসাবে চিহ্নিত করবেন, যে ব্যক্তি তার কাছে যা আছে তাতেই খুশি থাকে মহান আল্লাহ্ তার অভাব পূরণ করে দিবেন, যে সামান্য কিছু থাকা সত্ত্বেও মানুষের কাছে যাঞ্চা করে বেড়ায় মহান আল্লাহ্ তার ভিক্ষাবৃত্তি দূর করবেন না। আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) বলেন, আমি মনে মনে বললামঃ আমার তো ‘ইয়াকুতাহ’ নামের একটি উষ্ট্রী রয়েছে যার মূল্য ‘সামান্য কিছুর’ এর চেয়ে অনেক বেশি, সুতরাং আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কাছে কোন কিছু না চেয়ে বরং সেখান থেকে চলে আসি। (হাদীসটি সহীহ। মুসনাদ আহমাদ -৪/১৩৮, আল মাজমা‘উয যাওয়ায়িদ-৩/৯৫, সুনান আবূ দাঊদ ২/২৭৯, সুনান নাসাঈ -৫/৯৫)
অতঃপর মহান আল্লাহ্ বলেনঃ ﴿وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَیْرٍ فَاِنَّ اللّٰهَ بِه عَلِیْمٌ﴾ তোমাদের সমস্ত দান সম্বন্ধে মহান আল্লাহ্ সম্যক অবগত রয়েছেন।’ অতএব যখন তোমরা সম্পূর্ণরূপে তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে যাবে তখন তিনি তোমাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দিবেন। তাঁর নিকট কোন কিছুই গোপন নেই।
আল কুর’আনে দান-সাদাকাকারীর প্রশংসা করা হয়েছে
﴿اَلَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ بِالَّیْلِ وَ النَّهَارِ سِرًّا وَّ عَلَانِیَةً فَلَهُمْ اَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ١ۚ وَ لَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَ لَا هُمْ یَحْزَنُوْنَؔ﴾
এরপর মহান আল্লাহ্ ঐসব লোকের প্রশংসা করেছেন যারা মহান আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর পথে খরচ করে। তাদেরকেও প্রতিদান দেয়া হবে এবং তারা যে কোন ভয় ও চিন্তা হতে নিরাপত্তা লাভ করবে। পরিবারের খরচ বহন করার কারণেও তাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। যেমন সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে, মাক্কা বিজয়ের বছর এবং অন্য বর্ণনায় রয়েছে, বিদায় হাজ্জের বছর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) -কে রোগাক্রান্ত অবস্থায় দেখতে গিয়ে বলেনঃ
وَإِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلَّا ازْدَدْتَ بِهَا دَرَجَةً وَرِفْعَةً، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فِي امْرَأَتِكَ.
‘তুমি মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যা খরচ করবে তিনি এর বিনিময়ে তোমার মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন, এমনকি তুমি স্বয়ং তোমার স্ত্রীকে যা খাওয়াবে তারও প্রতিদান তোমাকে দেয়া হবে।’ (সহীহুল বুখারী-১/১৬৫/৫২, ৩/১৯৬/১২৯৫, ৭/৭১২/৪৪০৯, ফাতহুল বারী -৩/১৯৬, সহীহ মুসলিম-৩/১২৫০,১২৫১,/৫, সুনান আবূ দাউদ-৩/১১২/২৮৬৪, জামি‘ তিরমিযী-৪/৩৭৪/২১১৬, মুওয়াত্তা ইমাম মালিক-২/৪/৭৬৩, মুসনাদ আহমাদ -১/১৭৯) মুসনাদ আহমাদে রয়েছে যেঃ إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا أَنْفَقَ عَلَى أَهْلِهِ نَفَقَةً يَحْتَسِبُهَا كَانَتْ لَهُ صَدَقَةً.
‘মুসলিম ব্যক্তি সাওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে নিজের ছেলে-মেয়ের জন্য যা খরচ করে তাও সাদাকাহ।’ ইমাম বুখারী (রহঃ) মুসলিম (রহঃ) ’ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (সহীহুল বুখারী- ১/১৯৫/৫৫, মুসনাদ আহমাদ -৪/১২২, ফাতহুল বারী -১/৫৫, সহীহ মুসলিম-২/৬৯৫/৪৮)
মহান আল্লাহ্র আনুগত্য লাভ করার উদ্দেশ্যে যারা রাতে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে নিজেদের ধন-সম্পদ থেকে ব্যয় করে, তাদের প্রভুর নিকট তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না।
@এখানে যেসব লোকের কথা বলা হয়েছে, তারা হচ্ছে এমন একদল লোক যারা আল্লাহর দ্বীনের খেদমতে নিজেদেরকে কায়মনোবাক্যে সাবর্ক্ষণিকভাবে উৎসর্গ করে দিয়েছিল। তাদের সমস্ত সময় এই দ্বীনি খেদমতে ব্যয় করার কারণে নিজেদের পেট পালার জন্য কিছু কাজকাম করার সুযোগ তাদের ছিল না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এই ধরনের স্বেচ্ছাসেবীদের এটি স্বতন্ত্র দল ছিল। ইতিহাসে তাঁরা ‘আসহাবে সুফ্ফা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। এরা ছিলেন তিন চারশো লোকের একটি দল। নিজেদের বাড়ি ঘর ছেড়ে দিয়ে এরা মদীনায় চলে এসেছিলেন। সর্বক্ষণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির থাকতেন। তাঁর সাথে সাথে থাকতেন। তিনি যখন যাকে যেখানে কোন কাজে বা অভিযানে প্রয়োজন তাদের মধ্যে থেকে নিয়ে পাঠিয়ে দিতেন। মদীনার বাইরে কোন কাজ না থাকলে তারা মদীনায় অবস্থান করে দ্বীনী ইল্ম হাসীল করতেন এবং অন্যদেরকে তার তালিম দিতেন। যেহেতু তাঁরা ছিলেন সার্বক্ষনিক কর্মী এবং নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার মতো ব্যক্তিগত উপকরণও তাঁদের ছিল না, তাই মহান আল্লাহ সাধারণ মুসলমানদের দৃষ্টি তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে বিশেষ করে তাদেরকে সাহায্য করাকে আল্লাহ পথে ব্যয়ের সবোর্ত্তম খাত বলে উল্লেখ করেছেন।
@এরপর খরচ করার খাতগুলোর মধ্য থেকে বিশেষ করে একটি খাত সম্পর্কে এখানে বর্ণনা করা হচ্ছে; এখানে মোমেনদের একটি দলের জন্যে এক বিশেষ মর্যাদার কথা ঘোষণা করা হয়েছে, এমন এক মর্যাদার কথা তুলে ধরা হয়েছে যা শুনলে চেতনাগুলি সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে, অন্তরসমূহ আবেগে প্রকম্পিত হয় এবং যেনো এক স্নেহের পরশ লেগে তার মন নিরুদ্বিগ্ন হয়ে যায় । তখন সে কোনো হীনতা বোধ করে না, তার মন এমনভাবে হালকা হয়ে যায় যে, কোনো উদ্বেগ তাকে আর স্পর্শ করতে পারে না, তার সব প্রশ্ন থেকে যায় এবং মুগ্ধ আবেশে তার কথা বন্ধ হয়ে যেতে চায়। বলা হয়েছে, "দান খয়রাতের প্রাপকদের মধ্যে এমন অভাবগ্রস্ত মোহাজের সম্প্রদায় আছে যারা আল্লাহ তায়ালার পথে থাকার কারণে আবদ্ধ হয়ে গেছে। তাদের রুজি রোজগারের পথ বদ্ধ হয়ে গিয়েছে, তুমি তাদেরকে তাদের চেহারা দেখে চিনতে পারবে দেখবে । সেখানে দুঃখ কষ্ট ও দৈন্যের ছাপ লেগে আছে। তারা মানুষের হাত জড়িয়ে ধরে তাদের কাছে কিছু চায় না। এদের জন্যে যা কিছু তোমরা খরচ করো তা আল্লাহ্ তায়ালা জানেন। এই প্রাণবন্ত গুণটি মোহাজেরদের একটি দলের ওপর প্রযোজ্য ছিলো, যারা হিজরত করতে গিয়ে তাদের ধন সম্পদ ও পরিবার বর্গ পেছনে ফেলে এসেছিলেন এবং মদীনায় আসার পর আল্লাহর পথে জেহাদে ও আল্লাহ্র রসূলের পাহারাদারীতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, যেমন করে হেফাযতের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন রসূল (স.)-এর জন্যে আসহাবে সুফফার ব্যক্তিরা যাদের কারণে কোনো দুশমন সেদিকে কুদৃষ্টিতে তাকাতেও সাহস পেতো না। এরা জেহাদের কাজে এতোটা নিবেদিত প্রাণ হয়ে গিয়েছিলেন যে, কোনো ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে তারা বিদেশে ভ্রমণ করতে পারতেন না। এতদসত্ত্বেও তারা কারো কাছে কিছু চাইতেন না। আত্মসস্ত্রম বোধ সম্পন্ন এই সম্মানিত সাহাবারা তাদের প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত না করায় সাধারণ মূর্থ লোকেরা তাদেরকে সচ্ছল মনে করতো এবং তাদের আসল অবস্থাটা বুঝতে না পারায় তাদেরকে তারা সম্পদশালী মনে করতো । কিন্তু আয়াতটিতে উল্লেখিত কথাগুলো সাধারণভাবে সকল যামানার ও সব মানুষের জন্যেই প্রযোজ্য । এ কথাগুলো তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছিলো যারা প্রকৃতপক্ষে বড়োই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন, বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যারা কোনো রোযগার করতে পারতো না, আর তাদের আত্মসম্ভ্রমবোধ তাদেরকে কারো কাছে হাত পাততেও দিতো না এবং তাদের অভাব অন্যের কাছে প্রকাশ পায় তাও তারা পছন্দ করতেন না। এইসব অবস্থার কারণে সাধারণ ও আনাড়ী গোছের মানুষরা তাদের বাহ্যিক অবস্থা দৃষ্টে এবং তাদের বিনয় নম্রতা ও সততার কারণে তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করতো । কিন্তু তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন ও তীক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিরা খোলা দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে তাদের বাহ্যিক প্রশান্ত চেহারার অন্তরালে লুক্কায়িত তাদের তীব্র দারিদ্রতাকে দেখতে পেতেন। সে দারিদ্রের ছাপ তাদের চেহারায় পরিস্ফুট হয়ে না-উঠলেও তাদের দেখে তারা তাদের কষ্ট বুঝতেন । যদিও লজ্জায় তাঁদের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুতো না। এই ছোট্ট আয়াতটির মধ্যে এ সম্ভ্রমপূর্ণ অবস্থার যে ছবি আঁকা হয়েছে তা অনুভূতিশীল লোকের অন্তরে গভীরভাবে দাগ কাটে । আলোচ্য আয়াতটির মধ্যে তাদের লজ্জাবনত ভাবের এক বাস্তব ছবি যেনো মূর্ত হয়ে উঠেছে। এ পর্যায়ে উল্লেখিত প্রতিটি বাক্য তাদের জন্যে অনুভুতিশীল প্রত্যেক হৃদয়াভ্যন্তরে যেনো মোহাব্বাতের এক কোমল পরশ বুলিয়ে দিতে চায় । তাদের এই আত্মমর্যাদাবোধ ছবির মতো ভেসে ওঠে যে কোনো অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের কাছে। তখন তাদের চেতনা এমনভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে যে, তাৎক্ষণিকভাবে ওদের জন্যে কিছু করার উদ্দেশ্যে তাদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে । এই আয়াতটি পাঠ করার সাথে সাথে ওই চেহারাগুলো এবং ওই ব্যক্তিত্বগুলো এমনভাবে পাঠকের হৃদয়পটে ভেসে ওঠে যেন মনে হয় তারা ও তাদেরকে চাক্ষুষ আপন দেখতে পাচ্ছে। এই-ই হচ্ছে মানবতার উদাহরণ তুলে ধরার জন্যে কোরআনে কারীমের মধ্যে উল্লেখিত হৃদয়গ্রাহক পদ্ধতি যার ফলে কোনো অবস্থা জীবন্ত রূপ নিয়ে অনুভূতির দুয়ারে সাড়া জাগায় । তারাই হচ্ছেন সেই সম্ভ্রমশীল ও মহান অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি যারা তাদের অভাবকে তাদের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার মতোই গোপন করে রাখেন ৷ তাদেরকে গোপনেই দান করা উচিত যেন তাদের বিবেকে কোনো আঘাত না লাগে এবং তাদের আত্মমর্যাদা আহত না হয়, আর এই কারণেই ওসব ব্যক্তিকে গোপনে সদকা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে, যাতে শুধুমাত্র আল্লাহর জ্ঞানেই তা ধরা পড়ে এবং তার কাছ থেকেই একমাত্র তার প্রতিদান পাওয়ার আশা করা যায়।এই জন্যেই এরশাদ হয়েছে, 'তোমরা যা কিছু খরচ করো সে বিষয়ে অবশ্যই আল্লাহ্ তায়ালা খবর রাখেন ।' একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালাই নিভৃত হৃদয়ের গোপন কথার খবর রাখবেন এবং তাঁর দৃষ্টি থেকে ভালো কোনো কিছু বাদ পড়ে যায় না।
এ বিষয়ে সুবিদিত আয়াত অনেক রয়েছে। উক্ত মর্মের হাদীসসমূহ নিম্নরূপঃ
১/৯৬। আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আমার কোন বন্ধুর সাথে শত্রুতা করবে, তার বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধের ঘোষণা রইল। আমার বান্দা যে সমস্ত জিনিস দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করে, তার মধ্যে আমার নিকট প্রিয়তম জিনিস হল তা---যা আমি তার উপর ফরয করেছি। (অর্থাৎ ফরয ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করা আমার নিকটে বেশী পছন্দনীয়।)
আর আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে, পরিশেষে আমি তাকে ভালবাসতে লাগি। অতঃপর যখন আমি তাকে ভালবাসি, তখন আমি তার ঐ কান হয়ে যাই, যার দ্বারা সে শোনে, তার ঐ চোখ হয়ে যাই, যার দ্বারা সে দেখে, তার ঐ হাত হয়ে যাই, যার দ্বারা সে ধরে এবং তার ঐ পা হয়ে যাই, যার দ্বারা সে চলে! আর সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, তাহলে আমি তাকে দিই এবং সে যদি আমার আশ্রয় চায় তাহলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় দিই।’’[সহীহুল বুখারী ৬৫০২]
আমি তার কান হয়ে যাই----। অর্থাৎ আমার সন্তুষ্টি মোতাবেক সে শোনে, দেখে, ধরে ও চলে।[গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ৯৬]
- باب المجاهدة فالأول: عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: "إن الله تعالى قال: من عادى لي وليا فقد آذنته بالحرب. وما تقرب إلي عبدي بشيء أحب إلي مما افترضت عليه، وما يزال عبدي يتقرب إلي بالنوافل حتى أحبه، فإذا أحببته كنت سمعه الذي يسمع به، وبصره الذي يبصر به، ويده التي يبطش بها، ورجله التي يمشي بها، وإن سألني أعطيته؛ ولئن استعاذني لأعيذنه" (رواه البخاري).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১১৩
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১৭/১১৩। আবূ যার্র জুন্দুব ইবনু জুনাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুমহান প্রভু হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি (আল্লাহ) বলেন, ‘‘হে আমার বান্দারা! আমি অত্যাচারকে আমার নিজের জন্য হারাম করে দিয়েছি এবং আমি তা তোমাদের মাঝেও হারাম করলাম। সুতরাং তোমরাও একে অপরের প্রতি অত্যাচার করো না। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই পথভ্রষ্ট; কিন্তু সে নয় যাকে আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি। অতএব তোমরা আমার নিকট সঠিক পথ চাও আমি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখাব। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই ক্ষুধার্ত; কিন্তু সে নয় যাকে আমি খাবার দিই। সুতরাং তোমরা আমার কাছে খাবার চাও, আমি তোমাদেরকে খাবার দেব। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই বস্ত্রহীন; কিন্তু সে নয় যাকে আমি বস্ত্র দান করেছি। সুতরাং তোমরা আমার কাছে বস্ত্র চাও, আমি তোমাদেরকে বস্ত্রদান করব। হে আমার বান্দারা! তোমরা দিন-রাত পাপ করে থাক, আর আমি সমস্ত পাপ ক্ষমা করে থাকি। সুতরাং তোমরা আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেব। হে আমার বান্দারা! তোমরা কখনো আমার অপকার করতে পারবে না এবং কখনো আমার উপকারও করতে পারবে না।
হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ মানুষ ও জ্বিন সকলেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একজন পরহেযগার ব্যক্তির হৃদয়ের মত হৃদয়বান হয়ে যায়, তাহলে এটা আমার রাজত্বের কোন কিছু বৃদ্ধি করতে পারবে না। হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ মানুষ ও জ্বিন সকলেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একজন পাপীর হৃদয়ের মত হৃদয়ের অধিকারী হয়ে যায়, তাহলে এটা আমার রাজত্বের কোন কিছুই কমাতে পারবে না। হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ তোমাদের মানুষ ও জ্বিন সকলেই একটি খোলা ময়দানে একত্রিত হয়ে আমার কাছে প্রার্থনা করে, আর আমি তাদের প্রত্যেককে তার প্রার্থিত জিনিস দান করি, তাহলে (এ দান) আমার কাছে যে ভান্ডার আছে, তা হতে ততটাই কম করতে পারবে, যতটা সূঁচ কোন সমুদ্রে ডুবালে তার পানি কমিয়ে থাকে। হে আমার বান্দারা! আমি তোমাদের কর্মসমূহ তোমাদের জন্য গুণে রাখছি। অতঃপর আমি তোমাদেরকে তার পূর্ণ বিনিময় দেব। সুতরাং যে কল্যাণ পাবে, সে আল্লাহর প্রশংসা করুক। আর যে ব্যক্তি অন্য কিছু (অর্থাৎ অকল্যাণ) পাবে, সে যেন নিজেকেই তিরস্কার করে।’’
(হাদীসের একজন বর্ণনাকারী) সাঈদ বলেন, আবূ ইদরীস (এই হাদীসের অন্য একজন বর্ণনাকারী) যখন এই হাদীস বর্ণনা করতেন, তখন হাঁটু গেড়ে বসে যেতেন।[মুসলিম ২৫৭৭, ২৪৯৫, ইবনু মাজাহ ৪২৫৭, আহমাদ ২০৮৬০, ২০৯১১, ২১০৩০, দারেমী ২৭৮৮ হাদিসের মানঃ সহিহ]।
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ৯৭
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
২/৯৭। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মহান প্রভু হতে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যখন বান্দা আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, তখন আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। যখন সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয় তখন আমি তার দিকে দু’হাত অগ্রসর হই। আর যখন সে আমার দিকে হেঁটে আসে তখন আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।’’[সহীহুল বুখারী ৭৫৩৬, ৭৪০৫, ৭৫০৫, ৭৫২৭, মুসলিম ২৬৭৫, তিরমিযী ২৩৮৮, ৩৬০৩, ইবনু মাজাহ ৩৮২২, আহমাদ ৭৩৭৪, ২৭৪০৯, ৮৪৩৬ ]
( باب المجاهدة الثاني: عن أنس رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم فيما يرويه عن ربه عز وجل قال: " إذا تقرب العبد إلي شبراً تقربت إليه ذراعاً، وإذا تقرب إلي ذراعاً تقربت منه باعاً، وإذا أتاني يمشي أتيته هرولة" (رواه البخاري).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ৯৮
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৩/৯৮। ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘এমন দুটি নিয়ামত আছে, বহু মানুষ সে দু’টির ব্যাপারে ধোঁকায় আছে। (তা হল) সুস্থতা ও অবসর।’’[সহীহুল বুখারী ৬৪১২, তিরমিযী ২৩০৪, ইবনু মাজাহ ৪১৭০, আহমাদ ২৩৩৬, ৩১৯৭, দারেমী ২৭০৭ ]
- باب المجاهدة الثالث: عن ابن عباس رضي الله عنهما قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: " نعمتان مغبون فيهما كثير من الناس: الصحة، والفراغ" (رواه البخاري).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ৯৯
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৪/৯৯। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে (এত দীর্ঘ) কিয়াম করতেন যে, তাঁর পা দুখানি (ফুলে) ফেটে (দাগ পড়ে) যেত। একদা আমি তাঁকে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এরূপ কাজ কেন করছেন? আল্লাহ তো আপনার আগের ও পিছের সমস্ত পাপ মোচন করে দিয়েছেন।’ তিনি বললেন, ‘‘আমি কি তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দা হতে পছন্দ করব না?’’[সহীহুল বুখারী ৪৮৩৭, ১১১৮, ১১১৯, ১১৪৮, ১১৬১, ১১৬২, ১১৬৮, মুসলিম ৭৩১, ২৮২০, তিরমিযী ৪১৮, নাসায়ী ১৬৪৮, ১৬৪৯, ১৬৫০, আবূ দাউদ ১২৬২, ১২৬৩, ১৬৪৯, ১৬৫০, ইবনু মাজাহ১২২৬, ১২২৭ ]।
باب المجاهدة الرابع: عن عائشة رضي الله عنها أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يقوم من الليل حتى تنفطر قدماه، فقلت له: لم تصنع هذا يا رسول الله، وقد غفر الله لك ما تقدم من ذنبك وما تأخر؟! قال: " أفلا أحب أن أكون عبداً شكوراً؟" (متفق عليه. هذا لفظ البخاري، ونحوه في الصحيحين من رواية المغيرة بن شعبة).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০১
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৫/১০১। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহ বলেন, ‘যখন (রমযানের শেষ) দশক শুরু হত, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত জাগতেন, নিজ পরিবারকে জাগাতেন, (ইবাদতে) খুবই চেষ্টা করতেন এবং (এর জন্য) তিনি কোমর বেঁধে নিতেন।’[সহীহুল বুখারী ২০২৪, মুসলিম ১১৭৪, তিরমিযী ৭৯৬, নাসায়ী ১৬৩৯, আবূ দাউদ ১৩৭৬, ইবনু মাজাহ ১৭৬৮, আহমাদ ২৩৬১১, ১২৩৮৫৬, ২৩৮৬৯ ]।
- باب المجاهدة الخامس: عن عائشة رضي اللَّه عنها أنها قالت: »آان رسولُ اللَّه صَلّى االلهُ عَلَيْهِ وسَلَّم إذَا دَخَلَ الْعشْرُأحيا اللَّيْل،َ وأيقظ أهْله،ْ وجدَّ وشَدَّ المِئْزَرَ« متفقٌ عليه.والمراد: الْعشْرُ الأواخِرُ من شهر رمضان: »وَالمِئْزَر«: الإِزارُ وهُو آِنايَةٌ عن اعْتِزَال النِّساء،ِ وقِيلَ: المُرادُتشْمِيرهُ للعِبادَةِ. يُقالُ: شَددْتُ لِهذا الأمرِ مِئْزَرِي، أيْ: تشمرتُ وَتَفَرَّغتُ لَه
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০২
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৬/১০২। আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, (দেহমনে) সবল মু’মিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা বেশী প্রিয়। আর প্রত্যেকের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। তুমি ঐ জিনিসে যত্নবান হও, যাতে তোমার উপকার আছে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর ও উৎসাহহীন হয়ো না। যদি তোমার কিছু ক্ষতি হয়, তাহলে এ কথা বলো না যে, ‘যদি আমি এ রকম করতাম, তাহলে এ রকম হত।’ বরং বলো, ‘আল্লাহর (লিখিত) ভাগ্য এবং তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন।’ কারণ, ‘যদি’ (শব্দ) শয়তানের কাজের দুয়ার খুলে দেয়।[সহীহুল বুখারী ২৬৬৪, ইবনু মাজাহ ৭৯, ৪১৬৮, আহমাদ ৮৫৭৩, ৮৬১১]
باب المجاهدة عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: " المؤمن القوي خير وأحب إلى الله من المؤمن الضعيف وفي كل خير. احرص على ما ينفعك، واستعن بالله ولا تعجز. وإن أصابك شيء فلا تقل: لو أني فعلت كان كذا وكذا، ولكن قل: قدر الله، وما شاء فعل؛ فإن لو تفتح عمل الشيطان" ( رواه مسلم).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৩
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৭/১০৩। আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘জাহান্নামকে মনোলোভা জিনিসসমূহ দ্বারা ঘিরে দেওয়া হয়েছে এবং জান্নাতকে ঘিরে দেওয়া হয়েছে কষ্টসাধ্য কর্মসমূহ দ্বারা।’’[সহীহুল বুখারী ৬৪৮৭, তিরমিযী ২৫৬০, নাসায়ী ৩৭৬৩, আবূ দাউদ ৪৭৪৪, আহমাদ ৭৪৭৭, ২৭৫১২, ৮৬৪৪, ৮৭২১ ]
‘ঘিরে দেওয়া হয়েছে’ অর্থাৎ ঐ জিনিস বা কর্ম জাহান্নাম বা জান্নাতের মাঝে পর্দাস্বরূপ, যখনই কেউ তা করবে, তখনই সে পর্দা ছিঁড়ে তাতে প্রবেশ করবে।
باب المجاهدة السابع: عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: " حجبت النار بالشهوات، وحجبت الجنة بالمكاره" (متفق عليه).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৪
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৮/১০৪। আবূ আব্দুল্লাহ হুযাইফা ইবনু ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন যে, আমি এক রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে নামায পড়লাম। তিনি সূরা বাক্বারাহ পড়তে আরম্ভ করলেন। অতঃপর আমি মনে মনে) বললাম যে, ‘তিনি একশো আয়াত পড়ে রুকুতে যাবেন।’ কিন্তু তিনি (তা না ক’রে) ক্বিরাআত করতে থাকলেন। তারপর আমি (মনে মনে) বললাম যে, ‘তিনি এই সূরা এক রাকাআতে সম্পন্ন করবেন; এটি পড়ে রুকূ করবেন।’ কিন্তু তিনি (সূরা) নিসা আরম্ভ করলেন। তিনি তা সম্পূর্ণ পড়লেন। তারপর তিনি (সূরা) আলে ইমরান শুরু করলেন। সেটিও সম্পূর্ণ পড়লেন। (এত দীর্ঘ ক্বিরাআত সত্ত্বেও) তিনি ধীর শান্তভাবে থেমে থেমে পড়ছিলেন।
যখন কোন এমন আয়াত এসে যেত, যাতে তাসবীহ (আল্লাহর পবিত্রতার বর্ণনা) আছে, তখন তিনি (ক্বিরাআত বন্ধ করে) তাসবীহ (অর্থাৎ সুবহানাল্লাহ) পড়তেন। আর যখন প্রার্থনা সম্বলিত আয়াত এসে যেত, তখন প্রার্থনা করতেন। যখন আশ্রয় চাওয়ার আয়াত আসত, তখন আশ্রয় চাইতেন। অতঃপর তিনি রুকূ করলেন; তাতে তিনি বলতে লাগলেন, ‘সুবহানা রাব্বিয়াল ‘আযীম।’ সুতরাং তাঁর রুকুও তাঁর কিয়ামের (দাড়ানোর) মত দীর্ঘ হয়ে গেল! অতঃপর তিনি ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বললেন ও (রুকু হতে উঠে) প্রায় রুকু সম দীর্ঘ কিয়াম করলেন। অতঃপর তিনি সিজদা করলেন এবং (সাজদায়) তিনি ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’ (দীর্ঘ সময় ধরে) পড়লেন ফলে তাঁর সিজদা তাঁর কিয়ামের সমান হয়ে গেল![মুসলিম ৭৭২, তিরমিযী ২৬২, নাসায়ী ১০০৮, ১০০৯, ১০৪৬, ১০৬৯, ১১৩৩, ১১৪৫, আবূ দাউদ ৮৭১, ৮৭৪, ইবনু মাজাহ ৮৮৮, ৮৯৭, ১০৫১, আহমাদ ২২৭২৯, ২২৭৫০, ২২৭৮৯, দারেমী ১৩০৬ ]
باب المجاهدة عن أبي عبد الله حذيفة بن اليمان، رضي الله عنهما، قال: صليت مع النبي صلى الله عليه وسلم ذات ليلة، فافتتح البقرة، فقلت يركع عند المائة، ثم مضى؛ فقلت يصلي بها في ركعة، فمضى؛ فقلت يركع بها، ثم افتتح النساء؛ فقرأها، ثم افتتح آل عمران فقرأها، يقرأ مترسلاً إذا مر بآية فيها تسبيح سبح، وإذا مر بسؤال سأل، وإذا مر بتعوذ تعوذ، ثم ركع فجعل يقول: " سبحان ربي العظيم" فكان ركوعه نحواً من قيامه ثم قال: " سمع الله لمن حمده، ربنا لك الحمد" ثم قام قياماً طويلاً قريباً مما ركع، ثم سجد فقال: " سبحان ربي الأعلى" فكان سجوده قريباً من قيامه" (رواه مسلم).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৫
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
৯/১০৫। ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন যে, ‘আমি এক রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে নামায পড়লাম। অতঃপর তিনি দীর্ঘ কিয়াম করলেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত আমি খারাপ কাজের ইচ্ছা করলাম।’ তাঁকে প্রশ্ন করা হল যে, ‘আপনি কি ইচ্ছা করেছিলেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি ইচ্ছা করেছিলাম যে, আমি বসে যাই এবং (তাঁর অনুসরণ) ছেড়ে দিই।’[সহীহুল বুখারী ১১৩৫, মুসলিম ৭৭৩, ইবনু মাজাহ ১৪১৮, ১৩৩৮, ৩৭৫৭, ৩৯২৭]
باب المجاهدة عن ابن مسعود رضي الله عنه قال: صليت مع النبي صلى الله عليه وسلم ليلة، فأطال القيام حتى هممت بأمر سوء! قيل: وما هممت به؟ قال: هممت أن أجلس وأدعه. (متفق عليه).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৬
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১০/১০৬। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তিনটি জিনিস মৃত ব্যক্তির সঙ্গে যায়ঃ তার আত্মীয়-স্বজন, তার মাল ও তার আমল। অতঃপর দু’টি জিনিস ফিরে আসে এবং একটি জিনিস রয়ে যায়। তার আত্মীয়স্বজন ও তার মাল ফিরে আসে এবং তার আমল (তার সঙ্গে) রয়ে যায়।[সহীহুল বুখারী ৬৫১৪, মুসলিম ২৯৬০, তিরমিযী ২৩৭৯, নাসায়ী ১৯৩৭, আহমাদ ১১৬৭০ ]
باب المجاهدة عن أنس رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: " يتبع الميت ثلاثة: أهله وماله وعمله؛ فيرجع اثنان ويبقى واحد: يرجع أهله وماله، ويبقى عمله" (متفق عليه).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৭
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১১/১০৭। ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জান্নাত তোমাদের জুতোর ফিতার চেয়েও অধিক নিকটবর্তী এবং জাহান্নামও তদ্রূপ।’’[সহীহুল বুখারী ৬৪৮৮, আহমাদ ৩৫৮, ৩৯১৩, ৪২০৬ ]
باب المجاهدة عن ابن مسعود رضي الله عنه قال: قال النبي صلى الله عليه وسلم: " الجنة أقرب إلى أحدكم من شراك نعله، والنار مثل ذلك" (رواه البخاري).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৮
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১২/১০৮। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খাদেম ও আহলে সুফ্ফার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবূ ফিরাস রাবীআহ ইবনু কা‘ব আসলামী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে রাত কাটাতাম। আমি তাঁর কাছে ওযূর পানি এবং প্রয়োজনীয় বস্তু এনে দিতাম। (একদিন তিনি খুশী হয়ে) বললেন, ‘‘তুমি আমার কাছে কিছু চাও।’’ আমি বললাম, ‘আমি আপনার কাছে জান্নাতে আপনার সাহচর্য চাই।’ তিনি বললেন, ‘‘এ ছাড়া আর কিছু?’’ আমি বললাম, ‘বাস্ ওটাই।’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে তুমি, অধিকাধিক সিজদা করে (অর্থাৎ প্রচুর নফল নামায পড়ে) তোমার (এ আশা পূরণের) জন্য আমাকে সাহায্য কর।’’[সহীহুল বুখারী ৪৮৯, তিরমিযী ৩৪১৬, নাসায়ী ১১৩৮, ১৬১৮, আবূ দাউদ ১৩২০, ইবনু মাজাহ ৩৮৭৯, আহমাদ ১৬১৩৮ ]
باب المجاهدة عن أبي فراس ربيعة بن كعب الأسلمى خادم رسول الله صلى الله عليه وسلم، ومن أهل الصفة رضي الله عنه قال: " كنت أبيت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم، فآتيه بوضوئه، وحاجته فقال: "سلني" فقلت: أسألك مرافقتك في الجنة. فقال: ( أوغير ذلك؟" قلت: هو ذاك قال: " فأعني على نفسك بكثرة السجود" (رواه مسلم).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১০৯
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১৩/১০৯। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খাদেম সাওবান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘‘তুমি অধিকাধিক সিজদা করাকে অভ্যাস বানিয়ে নাও। কারণ, তুমি যে কোন সিজদা করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার দ্বারায় তোমাকে মর্যাদায় এক ধাপ উঁচু করে দেবেন এবং তোমা থেকে একটি গোনাহ মিটিয়ে দেবেন।’’[মুসলিম ৪৮৮, তিরমিযী ৩৮৮, নাসায়ী ১১৩৯, ইবনু মাজাহ ১৪২৩, আহমাদ ২১৮৬৫, ২১৯০৫, ২১৯৩৬ ]
باب المجاهدة الثالث عشر: عن أبي عبد الله- ويقال: أبو عبد الرحمن- ثوبان مولى رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: " عليك بكثرة السجود، فإنك لن تسجد لله سجدة إلا رفعك الله بها درجة، وحط عنك بها خطيئة". (رواه مسلم).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১১১
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১৫/১১১। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আমার চাচা আনাস ইবনু নাদর বদরের যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। (যার জন্য তিনি খুবই দুঃখিত হয়েছিলেন।) অতঃপর তিনি একবার বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! প্রথম যে যুদ্ধ আপনি মুশরিকদের বিরুদ্ধে করলেন তাতে আমি অনুপস্থিত থাকলাম। যদি (এরপর) আল্লাহ আমাকে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন, তাহলে আমি কী করব আল্লাহ তা অবশ্যই দেখাবেন (অথবা দেখবেন)।’ অতঃপর যখন উহুদের দিন এল, তখন মুসলিমরা (শুরুতে) ঘাঁটি ছেড়ে দেওয়ার কারণে পরাজিত হলেন। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ! এরা অর্থাৎ সঙ্গীরা যা করল তার জন্য আমি তোমার নিকট ওযর পেশ করছি। আর ওরা অর্থাৎ মুশরিকরা যা করল, তা থেকে আমি তোমার কাছে সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করছি।’
অতঃপর তিনি আগে বাড়লেন এবং সামনে সা‘দ ইবনু মু‘আযকে পেলেন। তিনি বললেন, ‘হে সা‘দ ইবনু মু‘আয! জান্নাত! কা‘বার প্রভুর কসম! আমি উহুদ অপেক্ষা নিকটতর জায়গা হতে তার সুগন্ধ পাচ্ছি।’ (এই বলে তিনি শত্রুদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত বরণ করলেন।) সা‘দ বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সে যা করল, আমি তা পারলাম না।’ আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘আমরা তাঁর দেহে আশীর চেয়ে বেশি তরবারি, বর্শা বা তীরের আঘাত চিহ্ন পেলাম। আর আমরা তাকে এই অবস্থায় পেলাম যে, তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং মুশরিকরা তাঁর নাক-কান কেটে নিয়েছে। ফলে কেউ তাঁকে চিনতে পারেনি। কেবল তাঁর বোন তাঁকে তাঁর আঙ্গুলের পাব দেখে চিনেছিল।’ আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন যে, আমরা ধারণা করতাম যে, (সূরা আহযাবের ২৩নং) এই আয়াত তাঁর ও তাঁর মত লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।
‘‘মু’মিনদের মধ্যে কিছু আল্লাহর সঙ্গে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূরণ করেছে, ওদের কেউ কেউ নিজ কর্তব্য পূর্ণরূপে সমাধা করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। ওরা তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করেনি।’’[সহীহুল বুখারী ২৮০৫, ২৭০৩, ৪০৪৮, ৪৪৯৯, ৪৫০০, ৪৬১১, ৪৭৮৩, ৬৮৯৪, মুসলিম ১৯০৩, নাসায়ী ৪৭৫৫, ৪৭৫৬, ৪৭৫৭, আবূ দাউদ ৪৫৯৫, ইবনু মাজাহ ২৬৪৯, আহমাদ ১১৮৯৩, ১২২৯৩, ১২৬০৩ ]
باب المجاهدة عن أنس رضي الله عنه، قال: غاب عمي أنس ابن النضر رضي الله عنه، عن قتال بدر، فقال: يارسول الله غبت عن أول قتال قاتلت المشركين، لئن الله أشهدني قتال المشركين ليرين الله ما أصنع. فلما كان يوم أحد انكشف المسلمون، فقال اللهم أعتذر إليك مما صنع هؤلاء - يعني أصحابه- وأبرأ إليك مما صنع هؤلاء- يعني المشركين- ثم تقدم فاستقبله سعد بن معاذ، فقال: ياسعد بن معاذ الجنة ورب الكعبة، إني أجد ريحها من دون أحد. قال سعد: فما استطعت يا رسول الله ما صنع! قال أنس: فوجدنا به بضعاً وثمانين ضربة بالسيف، أو طعنة برمح ، أو رمية بسهم، ووجدناه قد قتل ومثل به المشركون فما عرفه أحد إلا أخته ببنانه. قال أنس: كنا نرى أو نظن أن هذه الآيه نزلت فيه وفي أشباهه: (من المؤمنين رجال صدقوا ما عهدوا الله عليه) ( الأحزاب: 23) إلى آخرها. (متفق عليه).
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১১২
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১৬/১১২। আবূ মাসউদ উক্ববাহ ইবনু ‘আমর আনসারী বাদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, যখন সাদকার আয়াত অবতীর্ণ হল, তখন (সাদকা করার জন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে) আমরা নিজের পিঠে বোঝা বহন করতাম (অর্থাৎ মুটে-মজুরের কাজ করতাম)। অতঃপর এক ব্যক্তি এল এবং প্রচুর জিনিস সাদকাহ করল। মুনাফিকরা বলল, ‘এই ব্যক্তি রিয়াকার (লোককে দেখানোর জন্য দান করছে।)’ আর এক ব্যক্তি এল এবং সে এক সা’ (আড়াই কিলো) জিনিস দান করল। তারা বলল, ‘এ (ক্ষুদ্র) এক সা’ দানের আল্লাহ মুখাপেক্ষী নন।’ অতঃপর এই আয়াত অবতীর্ণ হলঃ ‘‘বিশ্বাসীদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যারা সাদকা দান করে এবং যারা নিজ পরিশ্রম ব্যতিরেকে কিছুই পায় না, তাদেরকে যারা দোষারোপ করে এবং উপহাস করে, আল্লাহ তাদেরকে উপহাস করেন এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’’[সহীহুল বুখারী ১৪১৫, ১৪১৬, ২২৭৩, ৪৬৬৮, ৪৬৬৯, মুসলিম ১০১৮, নাসায়ী ২৫২৯, ২৫৩০, ইবনু মাজাহ ৪১৫৫, (সূরা তাওবাহ ৭৯, বুখারী-মুসলিম) ]
باب المجاهدة عن أبي مسعود عقبة بن عمرو الأنصاري البدري رضي الله عنه قال: لما نزلت آيه الصدقة كنا نحامل على ظهورنا. فجاء رجل فتصدق بشيء كثير فقالوا: مراءٍ، وجاء رجل آخر فتصدق بصاع فقالوا: إن الله لغني عن صاع هذا! فنزلت ( الذين يلمزون المطوعين من المؤمنين في الصدقات والذين لا يجدون إلا جهدهم) الآية (التوبة:79). (متفق علي
@গ্রন্থঃ রিয়াযুস স্বা-লিহীন
অধ্যায়ঃ বিবিধ (كتاب المقدمات)
হাদিস নম্বরঃ ১১৩
১১: মুজাহাদাহ বা দ্বীনের জন্য এবং আত্মা, শয়তান ও দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিরলস চেষ্টা, টানা পরিশ্রম ও আজীবন সংগ্রাম করার গুরুত্ব
১৭/১১৩। আবূ যার্র জুন্দুব ইবনু জুনাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুমহান প্রভু হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি (আল্লাহ) বলেন, ‘‘হে আমার বান্দারা! আমি অত্যাচারকে আমার নিজের জন্য হারাম করে দিয়েছি এবং আমি তা তোমাদের মাঝেও হারাম করলাম। সুতরাং তোমরাও একে অপরের প্রতি অত্যাচার করো না। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই পথভ্রষ্ট; কিন্তু সে নয় যাকে আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি। অতএব তোমরা আমার নিকট সঠিক পথ চাও আমি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখাব। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই ক্ষুধার্ত; কিন্তু সে নয় যাকে আমি খাবার দিই। সুতরাং তোমরা আমার কাছে খাবার চাও, আমি তোমাদেরকে খাবার দেব। হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই বস্ত্রহীন; কিন্তু সে নয় যাকে আমি বস্ত্র দান করেছি। সুতরাং তোমরা আমার কাছে বস্ত্র চাও, আমি তোমাদেরকে বস্ত্রদান করব। হে আমার বান্দারা! তোমরা দিন-রাত পাপ করে থাক, আর আমি সমস্ত পাপ ক্ষমা করে থাকি। সুতরাং তোমরা আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেব। হে আমার বান্দারা! তোমরা কখনো আমার অপকার করতে পারবে না এবং কখনো আমার উপকারও করতে পারবে না।
হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ মানুষ ও জ্বিন সকলেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একজন পরহেযগার ব্যক্তির হৃদয়ের মত হৃদয়বান হয়ে যায়, তাহলে এটা আমার রাজত্বের কোন কিছু বৃদ্ধি করতে পারবে না। হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ মানুষ ও জ্বিন সকলেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একজন পাপীর হৃদয়ের মত হৃদয়ের অধিকারী হয়ে যায়, তাহলে এটা আমার রাজত্বের কোন কিছুই কমাতে পারবে না। হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ তোমাদের মানুষ ও জ্বিন সকলেই একটি খোলা ময়দানে একত্রিত হয়ে আমার কাছে প্রার্থনা করে, আর আমি তাদের প্রত্যেককে তার প্রার্থিত জিনিস দান করি, তাহলে (এ দান) আমার কাছে যে ভান্ডার আছে, তা হতে ততটাই কম করতে পারবে, যতটা সূঁচ কোন সমুদ্রে ডুবালে তার পানি কমিয়ে থাকে। হে আমার বান্দারা! আমি তোমাদের কর্মসমূহ তোমাদের জন্য গুণে রাখছি। অতঃপর আমি তোমাদেরকে তার পূর্ণ বিনিময় দেব। সুতরাং যে কল্যাণ পাবে, সে আল্লাহর প্রশংসা করুক। আর যে ব্যক্তি অন্য কিছু (অর্থাৎ অকল্যাণ) পাবে, সে যেন নিজেকেই তিরস্কার করে।’’
(হাদীসের একজন বর্ণনাকারী) সাঈদ বলেন, আবূ ইদরীস (এই হাদীসের অন্য একজন বর্ণনাকারী) যখন এই হাদীস বর্ণনা করতেন, তখন হাঁটু গেড়ে বসে যেতেন।[মুসলিম ২৫৭৭, ২৪৯৫, ইবনু মাজাহ ৪২৫৭, আহমাদ ২০৮৬০, ২০৯১১, ২১০৩০, দারেমী ২৭৮৮ ]
باب المجاهدة عن سعيد بن عبد العزيز، عن ربيعة بن يزيد، عن أبي إدريس الخولاني، عن أبي ذر جندب بن جنادة، رضي الله عنه، عن النبي صلى الله عليه وسلم فيما يروى عن الله تبارك وتعالى أنه قال: " ياعبادي إني حرمت الظلم على نفسي وجعلته بينكم محرماً فلا تظالموا، يا عبادي كلكم ضال إلا من هديته؛ فاستهدوني أهدكم، يا عبادي كلكم جائع إلا من أطعمته؛ فاستطعموني أطعمكم،يا عبادي كلكم عارٍ إلا من كسوته، فاستكسوني أكسكم، يا عبادي إنكم تخطئون بالليل والنهار وأنا أغفر الذنوب جميعا، فاستغفروني أغفرلكم، ياعبادي إنكم لن تبلغوا ضري فتضروني، ولن تبلغوا نفعي فتنفعوني، يَا عِبَادي ، لَوْ أنَّ أوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أتْقَى قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مِنْكُمْ مَا زَادَ ذلِكَ في مُلكي شيئاً . يَا عِبَادي ، لَوْ أنَّ أوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أفْجَرِ قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مَا نَقَصَ ذلِكَ من مُلكي شيئاً، يا عبادي لو أن أولكم وآخركم، وإنسكم وجنكم قاموا في صعيد واحد، فسألوني فأعطيت كل إنسان مسألته، ما نقص ذلك مما عندي إلا كما ينقص المخيط إذا أدخل البحر، يا عبادي إنما هي أعمالكم أحصيها لكم، ثم أوفيكم إياها، فمن وجد خيراً فليحمد الله، ومن وجد غير ذلك فلا يلومن إلا نفسه". قال سعيد: كان أبو إدريس إذا حدث بهذا الحديث جثا على ركبتيه. رواه مسلم.
সু-সমাপ্ত ঃ০৪/০৮/১৪৪৪ হিজরী।
২৪/০২/২০২৩ ইংরেজী।
শুক্রবারঃসকাল-৭টা।
মাসজিদুন নববী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
আল-মাদিনাতুল মানোআয়া।
সৌদিআরব।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন