বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল যোগাযোগের নতুন যুগের সাক্ষী কর্ণফুলী

সকালের সোনালি রোদে ঝলমল কর্ণফুলী নদীর মোহনা। তীরে সগৌরবে উড়ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। উৎসবের আনন্দ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা প্রান্তে। দুই তীর এক পথে মিলিত হওয়ার দিন আজ শনিবার।

 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম যান চলাচলের সুড়ঙ্গপথের অধিকারী হচ্ছে বাংলাদেশ।

 

গ্রাফপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ১০টায় যান চলাচলের জন্য বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন করবেন। টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে জনসমাবেশের আয়োজন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। উদ্বোধন শেষে সমাবেশে বত্তৃদ্ধতা দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

 

কর্ণফুলীর তলদেশে ৩.৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গপথের মাধ্যমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার সঙ্গে আনোয়ারাকে যুক্ত করা হয়েছে। এই টানেলে সর্বোচ্চ গতি ৬০ কিলোমিটার বেগে (আপাতত) গাড়ি চালালে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে  পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র সাড়ে তিন মিনিট। দূরত্ব কমিয়ে এনে অতি দ্রুত যাত্রী ও পণ্য পবিবহনে নির্মাণ করা হয়েছে এই টানেল।

টানেলটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে পশ্চিম প্রান্তে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি থেকে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) এবং কর্ণফুলী সার কারখানার (কাফকো) মাঝখান দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছেছে।

 

জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, কর্ণফুলী নদীর কারণে চট্টগ্রাম এত দিন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। সেটা এখন যুক্ত হলো। পতেঙ্গা পর্যন্ত এত দিন যে উন্নয়ন হয়েছে, সেটা এখন টানেলের মাধ্যমে আনোয়ারা প্রান্ত হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত পৌঁছাবে। যোগাযোগব্যবস্থা আরো উন্নত হবে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সংযোগ উড়াল সড়ক ও সংযোগ সড়কের কাজ পুরোপুরি শেষ।

 

আনোয়ারা প্রান্তে বসেছে টোল প্লাজা। পতেঙ্গা প্রান্তে কোনো টোল প্লাজা রাখা হয়নি। ফলে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা যেতে টোল দিতে হবে শেষে। আর আনোয়ারা থেকে শুরুতেই টোল দিয়ে ঢুকতে হবে টানেলে। গাড়ির ওজন মাপার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে পতেঙ্গা প্রান্তে, টানেলে প্রবেশের আগে বাঁ দিকে। আনোয়ারা প্রান্তে সড়কের দৈর্ঘ্য তুলনামূলক বেশি রাখা হয়েছে।

টানেলের দুটি টিউবে দুই লেন করে চার লেনের সড়কপথ তৈরি করা হয়েছে। দক্ষিণ পাশের টিউব দিয়ে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গামুখী যান চলাচল করবে। ঠিক পাশের উত্তর টিউবটি দিয়ে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারামুখী যান চলাচল করবে। প্রতি টিউবে জরুরি প্রয়োজনে হাঁটার ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু জরুরি প্রয়োজনে সেখানে দাঁড়ানো ও হাঁটা যাবে। দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলে এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাওয়ার তিনটি পথ হয়েছে।

দুই টিউবেই বিদ্যুৎ সংযোগ, বাতাস নির্গমন ব্যবস্থা সচল রাখা, অগ্নিনির্বাপণ, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, কমিউনিকেশন ও মনিটরিং ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ শেষ। সব সিসি ক্যামেরা ও গাড়ির গতি মাপার যন্ত্র বসানো এখনো বাকি। 

দুই লেনের সড়কে গাড়ি চলাচল করবে একমুখী। টানেলের ভেতর দুই পাশে অগ্নিরোধক ফাইবার বোর্ড লাগানো, যা দেখতে অনেকটা দেয়ালের মতো। টানেলের ছাদেও কালো আগ্নিরোধক ফাইবার বোর্ড রয়েছে।

কর্ণফুলী

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের সড়কব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু টানেল নিঃসন্দেহে ভিন্নমাত্রার উন্নয়ন। এত দিন আমাদের যোগাযোগমাধ্যমে যে সনাতন পদ্ধতি ছিল, সেখানে টানেল একটি ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা হিসেবে যুক্ত হলো। আমাদের জন্য এটি নতুন উদ্যোগ। সেই বিবেচনায় আধুনিক।’

টানেলের আরো কিছু তথ্য

টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার। টিউবসহ মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। টানেলের এই অংশটি নদীর তলদেশে। টিউবের ভেতরের ব্যাস ১০.৮০ মিটার। টানেলের বাহির থেকে ব্যাস ১১.৮০ মিটার। পানির উপরিতল থেকে টানেলের সর্বোচ্চ গভীরতা ৪২.৮০ মিটার। নদীর তলদেশ থেকে টানেলের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩১ মিটার। টানেলে সর্বোচ্চ ঢাল ৪ শতাংশ।

মূল টানেলের সঙ্গে পতেঙ্গা প্রান্তে ০.৫৫ কিলোমিটার ও আনোয়ারা প্রান্তে ৪.৮ কিলোমিটারসহ মোট ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে। আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কের সঙ্গে ৭২৭ মিটার উড়াল সড়ক (ভায়াডাক্ট) রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পে ৯.৩৯ কিলোমিটার নতুন পথ তৈরি হচ্ছে।

প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমাদের টানেলের প্রযুক্তি উন্নত। আমরা নিরাপত্তায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। টানেলের ভেতর অত্যাধুনিক ক্যামেরা ও গাড়ির গতি মাপার যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। কোনো দুর্ঘটনা বা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হলে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’

হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, সাধারণ বন্যায় টানেলের কিছু হবে না। তবু আগামী ১০০ বছরের কথা ভাবা হয়েছে। বড় ধরনের ভয়ানক বন্য হলে চারটি গেটের মাধ্যমে টানেল বন্ধ করে দেওয়া হবে। যেহেতু ভেতরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দরকার, তাই জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে টানেলকে যুক্ত করা হয়েছে। বিকল্প হিসেবে আঞ্চলিক গ্রিডের সঙ্গেও যুক্ত আছে। এর পরও জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

সেতু না হয়ে টানেল কেন

নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগে থেকে আলোচনায় ছিল—কর্ণফুলীতে সেতুর বদলে টানেল কেন? নানা সময় এই প্রশ্নের উত্তরে নানা রকম আলোচনা হয়েছে।

অবকাঠামো ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েট অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘টানেল করাটা ঠিক হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এটি একটি শ্বেতহস্তী। এটি টেকসই উন্নয়নের দর্শনের সঙ্গে যায় না। এ ক্ষেত্রে আমি সরকারকে খুব একটা দোষ দেব না। এই যে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, তারা এই সরকারকে চমক দেখাতে এটা করেছে।’

কর্ণফুলী

এমন সমালোচনার বিপরীতে প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাঁরা বই পড়ে পরামর্শ দেন। বইয়ের বাইরে বাস্তবতা দেখেন না। নদীর নাব্যতা বলতে একটা কথা আছে। এখানে সেতু করলে নদীর ক্ষতি হতো। আমি ৪৪ বছর ধরে চাকরি করি। আমারও অভিজ্ঞতা আছে। অনেক কিছু বিবেচনা করেই সেতুর বদলে টানেল করা হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, টানেলের খুব কাছেই চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান। বড় জাহাজ চলাচল কোনোভাবেই যেন কোনো কিছুতে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, নেভিগেশন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, বিষয়টি মাথায় রেখেই সেতু না করে টানেল করা হয়েছে।

কত গাড়ি চলবে টানেলে

প্রকল্প এলাকায় গাড়ি চলাচল নিয়ে ২০১৩ সালে একটি সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষার প্রতিবেদন বলছে, টানেল চালুর বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি।

২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যান চলবে। এর অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬ ও ২০৬৭ সালে এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়তে প্রকল্প

কর্ণফুলী নদীর দুই তীরকে সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের প্রথম টিউবের বোরিং কাজ শুরু হয়।

গত ডিসেম্বরে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, এখনো তা হয়নি। নকশায় না থাকলেও নিরাপত্তা বিবেচনায় স্ক্যানার যুক্ত হচ্ছে টানেলের প্রবেশপথে। এতেও প্রকল্পের ব্যয় ও সময় দুটিই বেড়েছে। সঙ্গে প্রকল্প ব্যয়ে ডলারের দামকে সমন্বয় করা হয়েছে।

১০ হাজার ৩৭৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এই খরচের মধ্যে চীন দিচ্ছে ছয় হাজার ৭০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সড়ক কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে চার হাজার ৬১৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

প্রকল্পের অধীন টানেল ও সংযোগ সড়ক নির্মাণে বসুন্ধরা বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে। নির্মাণ কাজ করছে চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কম্পানি। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিবিএ।

জিবিডেস্ক //

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন