Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA ||
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য ষ্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান, লেখক ও বিশ্লেষক জর্জ কার্লিন বলেছিলেন, "I have certain rules I live by. My first rule: I don't believe anything the government tells me." বৃটেনের সরকার ও মিডিয়া এ মুহূর্তে আমাদের যা বলছে তা বিশ্বাস করলে সত্যিকার অর্থেই গাজায় ঘটে যাওয়া অনেক তথ্য আমাদের অজানা থেকে যাবে এবং আমরা ভুল ইতিহাস ধারণ করে থাকব।
বৃটেন সহ ইউরোপে (আয়ারল্যান্ড ছাড়া) জনগণের কেউ যদি 'গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা' এ ধরনের কোনো কথা বলেন, তাহলে তাঁকে উগ্রবাদীর তকমা দিয়ে দেওয়া হবে। পশ্চিমা রাজনীতিকগণ এমন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে যে, ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যা ঘটেছে তা অক্টোবরের ৭ তারিখেই ঘটেছে, এর আগে বা পরে কিছুই ঘটেনি। বৃটেনের হোম সেক্রেটারি সূয়েলা ব্রেভারম্যান ঠিক এই বয়ানটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে বলেছেন যে, ৭ অক্টোবরে ইসরাইলের উপর হামাসের আক্রমণে ১৪০০ জন ইসরাইলীকে মেরে ফেলার পরে লন্ডনের রাজপথে হাজার হাজার বা লক্ষ জনতা র্যালি করেছে এবং সূয়েলা ব্রেভারম্যান তাঁর ভাষায় এই সমাবেশকে 'হেইট মার্চ' বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বৃটিশদের ভুলিয়ে দিতে চাইছেন যে, সাত দশকেরও বেশী সময় ধরে সেই অঞ্চলে কি ঘটে আসছে। শুধু তা-ই নয়, তিনি নিজেই হয়তো ভুলে গিয়েছেন যে, ১৪০০ ইসরাইলী জনগণকে হত্যা করার পর হমাসকে সমর্থন দিতে কিন্তু লন্ডনের রাজপথে জনতার ঢল নামেনি! তাহলে এই জনতার ঢল নামল কেন?
বৃটিশ জনগণ যখন দেখল, হামাসের আক্রমণের জবাবে গাজায় প্রায় ৮ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় বৃটিশ রাজনীতিকগণ যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানাচ্ছে না, তখন তারা রাজপথে নেমেছে, অথচ বেশীরভাগ শান্তিপ্রিয় মানুষ যারা সমাবেশে যোগ দিয়েছে তাঁদের সবার গায়ে সূয়েলা ব্রেভারম্যান এই হেইট মার্চের তকমা এঁটে দিলেন। গত বাইশ দিনে গাজায় কতজন নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তা বোঝার জন্যে একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যান দেখা যেতে পারে। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনে প্রায় সাড়ে ন'হাজার নিরপরাধ সাধারণ জনগণকে জীবন দিতে হয়েছে, অন্যদিকে ২০২৩ সালের অক্টোবরের সাত তারিখের পর অর্থাৎ ২৩ দিনে গাজায় সাড়ে আট হাজার নিরপরাধ সাধারণ জনগণকে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৪৮ সালে সাত লক্ষ ফিলিস্তিনীকে নিজ ভূমি থেকে যে উৎখাত করা হয়েছিল যেটি 'ন্যাকবা' নামে ইতিহাসে পরিচিত, অনেকেই ইসরাইলের এখনকার আচরণকে 'নাকবা দ্বিতীয় পর্ব' নামে আখ্যায়িত করছেন এবং একটি জরিপে দেখা গেছে বৃটেনের ৭৬% ভাই মানুষ যুদ্ধ বিরতি চায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেসব ইসরাইলীকে ৭ অক্টোবর হত্যা করা হয়েছে তাঁদের প্রতি এবং যেসব ইহুদীদের হিটলার গ্যাস চেম্বারে অমানবিকভাবে হত্যা করেছিল যা ইতিহাসে হলকোষ্ট নামে পরিচিত তাঁদের প্রতি আমাদের সমবেদনা রয়েছে এবং চিরকাল থাকবে।
এখানে লক্ষ্যণীয় এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হল বৃটিশ রাজনীতিক ও মিডিয়া যতই ইসরাইলকে ভিকটিম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ইসরাইলী সরকারের অনেক অশুভ নীতি গোপন করার চেষ্টা করুক না কেন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কিন্তু কুছ পরোয়া না করে নিজেই সগৌরবে প্রকাশ্যে গণহত্যার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, গাজায় নারী পুরুষ, বৃদ্ধ, তরুণ, নবজাতক সহ শিশু, এমন কি তাঁদের গবাদিপশু - সব কিছুকেই বিতাড়িত করতে হবে অথবা হত্যা করতে হবে। বৃটিশ মিডিয়া এই তথ্য প্রকাশ করেনি যে, ইসরাইলের সিকিউরিটি কাউন্সিল ও তথ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে গাজায় চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় ঘটাবার লক্ষ্যে চারটি পদক্ষেপের প্রস্তাব করেছে যা প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অনুমোদন করেছেন। এগুলো হচ্ছে (১)গাজার পুরো জনগোষ্ঠীকে মিশর অথবা গাল্ফে ঠেলে দিতে হবে অথবা হত্যা করতে হবে (২) হাসপাতাল, স্কুল থেকে শুরু করে গাজার প্রতিটি স্থাপনাকে হামাসের সদর দপ্তর বিবেচনায় নিয়ে সবগুলো স্থাপনাকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে (৩) গাজায় প্রতিটি যানবাহনকে মিলিটারি যান হিসেবে গণ্য করে ধ্বংস করে দিতে হবে সেটি যদি খাবার পানি বা জরুরী জীবনরক্ষাকারী পণ্যও বহন করে তবুও সেটিকে ধ্বংস করতে হবে (৪) জাতিসংঘের ত্রাণ প্রথমে ইসরায়েলি হোষ্টেজদের কাছে যেতে হবে, তা না করলে কোনো ত্রাণ সামগ্রী ফিলিস্তিনীদের কাছে পৌঁছাতে দেওয়া হবে না।
এর পরিপ্রেক্ষিতেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর বক্তৃতায় স্পষ্ট করে ঘোষণা দিয়েছেন ইসরাইলকে নিরাপদ ভূমিতে পরিণত করতে হলে গাজায় ফিলিস্তিনী জনগোষ্ঠী রাখা যাবেনা এবং গাজা সম্পূর্ণভাবে ফিলিস্তিনী মুক্ত হতে হবে। কাজেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ইসরাইল তাদের গণহত্যার পরিকল্পনাটি একেবারেই গোপন করছেনা অথচ পশ্চিমা মিডিয়া এসব গোপন করে এমন ভাব করছে যে, ইসরাইল একটি আকস্মিক সন্ত্রাসী হামলার স্বীকার হয়েছে এবং ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে এবং ইসরায়েল এখন সে কাজটিই করছে।
যেখানে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ওল্ড টেষ্টামেন্টকে থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে (মালাকাসদের উল্লেখ করে) স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, ফিলিস্তিনে কোনো নর, নারী, তরণ, বৃদ্ধ, নবজাতক সহ সব শিশু এমন কি তাদের গবাদি পশুদের পর্যন্ত নি:শেষ করতে যাচ্ছে তারা, সেখানে বৃটেন সহ পশ্চিমা মিডিয়া ও রাজনৈতিকগণ এমন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছে যে, ইসরাইলীরা যা করছে তা নিতান্তই তাদের আত্মরক্ষার প্রয়োজনে করছে। বলা বাহুল্য বিশ্বের হাতে গোণা কয়েকটি মিডিয়াতে নেতানিয়াহুর ঐ বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। যদি বৃটিশ জনগণ জানতে পারত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এবং তথ্যমন্ত্রী জনসমক্ষে কি বলছে তাহলে বৃটিশদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হত যে, যে বয়ানটা বৃটিশদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে তা কতটা বানোয়াট।
বৃটিশ রাজনীতিকরা বিশেষ করে কনজারভেটিভ যে কথাটি সব সময় বলে আসছে তা হল এরকম – ইসরাইল পশ্চিমেরই অংশ কারণ ইসরাইল ও পশ্চিমা দেশগুলো Judeo-Christian হ্যারিটেজ শেয়ার করে এবং পশ্চিম ও ইসরাইল উভয়েই একই ইথোস মেনে চলে। যে যৌথ ইথোসগুলোর কথা বলা হয় সেগুলো সেইন্ট অগাষ্টিন অফ হিপোর সময় থেকে মানা হয়ে আসছে। রোমানদের যুদ্ধ রীতিতেও এটি ছিল যা রোমানরা ও মেনে চলত। সেই যুদ্ধ রীতি তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ১৫০০ বছর আগে থেকে প্রচলিত সেই কনভেনশনগুলো মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়ে আসছিল। সে তিনটি স্তম্ভ হচ্ছে ১) যোদ্ধা ও সাধারণ নাগরিকের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে যাতে সাধারণ নাগরিকদের সাথে যুদ্ধ বিদ্বেষী আচরণ করা না হয়। (২) Proportionality অর্থাৎ আক্রমণের বিপরীতে আনুপাতিক হারে প্রতি আক্রমণ করতে হবে। (৩) military necessity বা সামরিক আক্রমণের যৌক্তিকতা, যেমন ধরুন ইসরাইলের কেবলমাত্র হামাসের ঘাঁটিগুলোতেই আক্রমণের আইনী বৈধতা রয়েছে। কিন্তু বিশ্ব দেখল সেই ইথোস বা যুদ্ধ রীতির সেই তিনটিই স্তম্ভকেই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে ইসরাইল। নেতানিয়াহু তাঁর বক্তৃতার মাধ্যমে পশ্চিম এবং পুরো বিশ্বকেই জানান দিয়েছে যে তিনি জ্ঞাতসারে শীতল মস্তিষ্কে যুদ্ধের সেই তিনটি স্তম্ভকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন এবং এই বেআইনী ও অমানবিক কাজটি তিনি করছেন ওল্ড টেষ্টামেন্টকে উদ্ধৃত করে।
এখানে বলা বাহুল্য, পশ্চিমের খৃষ্টানরা যে কখনো এ তিনটি স্তম্ভকে উপেক্ষা করেনি তা নয়। তবে তারা অন্তত বাহ্যিকভাবে হলেও এই তিনটি স্তম্ভ রক্ষা করার কথা বলে আসছে বা বাহ্যিকভাবে হলেও বা অন্তত মুখে হলেও তাঁদের ইথোসকে সম্মান করে যুদ্ধ রীতি মানার কথা বলে আসছে - মোট কথা তা মানবে না বলে কখনো ঘোষণা দেয়নি। আমরা কখনো পশ্চিমাদের বলতে শুনিনি যে, আমরা নিরপরাধ সাধারণ জনগণকে মেরে ফেলব। এমন কি নাইন ইলেভেনের পরে খোদ মার্কিনীদের মুখেও এমনটি শোনা যায় নি।নাইন ইলেভেনের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে ও ইরাকে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল তখন সাধারণ নিরপরাধ মানুষ কি মারা যায় নি? বহু সাধারণ নাগরিকরা মারা গেছে বা মেরে ফেলা হয়েছে কিন্তু মার্কিনীরা নাইন ইলেভেনের পরেও এমন উদ্ধত্যের সাথে উলঙ্গভাবে ঘোষণা দেয় নি যে তারা নিরপরাধ সাধারণ জনগণকে মেরে ফেলবে। অথচ নেতানিয়াহু এখন যা বলছেন তা যুদ্ধের ক্ষেত্রে এই common Judeo-Christian হ্যারিটেজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই ইথোসের একেবারে ১৮০ ডিগ্রী অবস্থানে নিজেকে নিয়ে গেছেন। ইউরোপ গত এক শতাব্দীতে বহু যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে কিন্তু কখনো এমন বক্তব্য শোনা যায়নি যা নেতানিয়াহুর কন্ঠে আজ শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ নেতানিয়াহুর ঘোষণা থেকে আমরা যেটি স্পষ্ট দেখতে পাই তা হল ইসরাইল ১৫০০ বছর আগের সভ্যতায় ফিরে গেছে।
ইউরোপের নেতারা উগ্রবাদী নেতাদের উদাহরণ দিতে মেলোনি এবং সালভিনির নাম উল্লেখ করেন। ইউরোপের মনে রাখতে হবে বেন গেভিয়ারের মত মানুষের হাতে ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্ব রয়েছে। বেন গেভিয়ারের সাথে তুলনা করলে মেলোনি আর সালভেনিকে তো একেবারে লিবারেল বলা যায়।
ইসরাইলের পক্ষ হয়ে ইউরোপ যে পুরো বিষয়টিকে ধামাচাপা দিচ্ছে তা সত্যি মানব ইতিহাসের জন্যে একটি কলঙ্কময় মূহূর্ত যা ইউরোপের সভ্যতার প্যারামিটারগুলোকে হত্যা করে সভ্যতাকে এক দুই দশক নয়, দেঢ় শতাব্দী পিছিয়ে দিল - আমি নিশ্চিত যে ইউরোপের জন্যে ভবিষ্যতে এটি সুফল বয়ে আনবে না। ইতিহাসের এই কলঙ্কময় টার্নিং পয়েন্টে যে প্রশ্নটি ইউরোপীয় নেতাদের জিজ্ঞেস করা উচিত তা হচ্ছে, আর কতদিন পরে কি ঘটলে ইউরোপের লিবারেল ডেমোক্রেসি এই সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে, এ বিষয়টি আলোচনায় আনতে পারবে? সময় এসেছে ইউরোপের ইসরাইলকে বলার যে, ইউরোপ এবং ইসরাইল এখন আর সভ্যতার একই ওয়েভলেন্থে নেই। ইউরোপ যত দেরীতে এটি বুঝবে তত তাড়াতাড়ি ইউরোপের পতন হবে বা হতে বাধ্য। ইউরোপীয়দের এটি বুঝতেই হবে, নইলে মার্টিন লুথার কিং এর সেই বাণীটিই ইউরোপের জন্যে বুমেরাং হয়ে আসবে "Injustice anywhere is a threat to justice everywhere"
লেখক একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক ও কলামিস্ট
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন