করোনার কারণে হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি সিলেটের ব্যবসায়ী ও নিম্ন আয়ের মানুষ। এরই মধ্যে একের পর এক নিতপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্য উঠছে তাদের নাভিশ্বাস। এবার ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো সিলেটের ব্যবসায়ী ও নিম্ন আয়ের মানুষের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে বিএনপি-জামায়াতের টানা অবরোধ কর্মসূচি।
জ্বালাও-পোড়াও আতঙ্কে সিলেটে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারছেন না বেশিরভাগ ব্যবসায়ী। কোথাও আতঙ্ক নিয়ে দোকান খুললেও বিক্রি একেবারেই কম।
এদিকে, হামলা-ভাঙচুরের ভয়ে রাস্তায় বেরোতে ভয় পাচ্ছেন পরিবহন শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষ। হরতাল, প্রথম দফা অবরোধের তিন দিন এবং দ্বিতীয় দফা অবরোধের দুই দিনে সিলেটে প্রায় অর্ধশত গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে কমপক্ষে ১০টি গাড়িতে। ফের ডাকা হয়েছে দুই দিনের (বুধ ও বৃহস্পতিবার) অবরোধ।
সাধারণত হরতাল-অবরোধ হলে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। দোকানপাটে কমে যায় বেচা-বিক্রি। ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাতে পারেন না। সে কারণেও বিক্রিতে ভাটা পড়ে। আবার ক্রেতারাও ঝুঁকি নিয়ে পণ্য কিনতে বের হতে চান না।
হরতাল-অবরোধ হলে পরিবহন সংকটে বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া কাঁচামালও সংগ্রহ করতে পারে না ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাহত হয় উৎপাদন। যার প্রভাব পড়ে আমদানি-রপ্তানিতেও। পাশাপাশি পরিবহন ব্যবসায়ীদের ক্ষতিও কম নয়। সমস্যায় পড়েন ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও। কারণ, বেশিরভাগ হরতালেই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। ফুটপাত ও পাড়া-মহল্লায় মানুষের আনাগোনা থাকে কম। ২৯ অক্টোবরের হরতাল এবং পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াতের দুই দফা অবরোধে সিলেটজুড়ে এমনটাই দেখা যায়।
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাইকারি ব্যবসার দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বড় জায়গা। ভোজ্যতেল, চিনি, মসলা, গুঁড়া দুধের মতো নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে প্লাস্টিক, প্রসাধনী, রং, গহনা, ব্যাগ, জুতা ও কাপড়ের ব্যবসা স্বাভাবিক দিনে এখানে জমজমাট থাকে। প্রতিদিনই অন্যান্য জেলার খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য কিনতে মৌলভীবাজার আসেন। লেনদেন হয় হাজার কোটি টাকা। তবে অবরোধের এই দিনগুলোতে বেশ ফাঁকা ছিল এলাকাটি। বন্ধ দেখা যায় প্রায় ৮০ ভাগ দোকান।
জানতে চাইলে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সৈয়দ মো. বশির উদ্দিন বলেন, ‘এমনিতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। এর মধ্যে এ হরতাল-অবরোধ আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও শেষ হচ্ছে না। ওই যুদ্ধের খারাপ ফল আমরা এখনো ভোগ করছি। নতুন করে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা, যা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক যে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা কীভাবে স্বাভাবিক কেনাবেচা করবেন। সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়ছে। আমরা এ অবস্থা মেনে নিতে পারছি না। দোকান খুলতে পারছি না।’
বশির উদ্দিন আরও বলেন, ‘এখন ৫ শতাংশ ক্রেতাও পাইকারি এসব বাজারে নেই। আসবে কীভাবে? রাস্তাঘাট বন্ধ প্রায়। ঝুঁকি নিয়ে কেন কেনাকাটা করতে আসবে? আমরাও কোনো স্থানে পণ্য পাঠাতে পারছি না।’
সিলেটে রিকশা চালান রফিক মিয়া। মহানগরের বাগবাড়ি এলাকার একটি কলোনিতে স্ত্রী ও ৫ সন্তান নিয়ে থাকেন। তিনি সিলেটভিউ-কে জানান- রিকশার ক্ষতি এবং নিজের প্রাণের ঝুঁকি থাকায় মূল সড়কগুলো রিকশা নিয়ে যাননি অবরোধের দিনগুলোতে। ফলে অন্যান্য দিনের মতো অবরোধের দিনে টাকা রোজগার করতে পারেননি, পারেননি পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সদাই-পাতিও নিয়ে যেতে। অবরোধের দিনগুলো খুব কষ্টে গেছে। বুধবার থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ। তিনি বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন।
সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের বাসচালক আনিসুর রহমান সিলেটভিউ-কে বলেন- হরতাল ও অবরোধের দিনগুলোতে একবারও গাড়ি নিয়ে বের হতে পারিনি আতঙ্কে। যদি মালিকের ২৫-৩০ লাখ টাকার গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে কী জবাব দেবো? এভাবে যদি লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকে তবে পরিবার নিয়ে পথে বসা ছাড় উপায় নাই।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে নেমেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটি বলছে- এটি তাদের ‘ডু অর ডাই’ আন্দোলন। দাবিগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে- আওয়ামী লীগ সরকারের পতন।
এই দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার নয়াপল্টনে আয়োজিত মহাসমাবেশ শেষ করতে না পেরে পরদিন হরতালের ডাক দেয় বিএনপি। পরে দেয় ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিনের টানা অবরোধের ডাক। উত্তপ্ততার মধ্যদিয়ে এ তিন দিনের অবরোধ হয়েছে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে। তাদের দাবি পূরণ না হওয়ায় দ্বিতীয় দফা গত রবি ও সোমবার (৫ ও ৬ নভেম্বর) ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ-কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। এর সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে জামায়াতও অবরোধ পালন করেছে। সোমবার সন্ধ্যায় ফের আরও দুই দিনের (বুধ ও বৃহস্পতিবার) অবরোধের ডাক দিয়েছে বিএনপি।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন