বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ সময়ে টানা আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে মাঠের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করে টানা কর্মসূচি পালন করছে নিবন্ধন ঝুলে থাকা দল জামায়াতও।
শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে চতুর্থ দফা অবরোধ পালন করছে বিএনপি-জামায়াত। এ দফা অবরোধের প্রথম দিন রবিবার (১২ নভেম্বর), শেষ হবে সোমবার রাতে।
এমন টানা আন্দোলনে প্রতিদিন সিলেট জেলায় প্রায় ৩০০ কোটি আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। করোনা মহামারির দীর্ঘ ধকল পুরোপুরি কাটিয়ে উঠার আগেই কয়েক দফা বন্যার কবলে পড়ে সিলেট। এসবে রেশ কাটানোর আগেই ফের এমন অর্থনৈতিক ক্ষতির ধাক্কায় দিশেহারা সিলেটের ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
অবরোধের দিনগুলোতে সিলেটে বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে- ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, লেগুনা ও রিকশা অনেকটা চলাচল করছে। তবে দূরপাল্লার বাস ও পণ্যবাহী বড় গাড়িগুলো চলাচল করছে খুবই সামান্য। মালিক-চালকদের ভয়- অবরোধকারীরা হঠাৎ চালাতে পারে ভাঙচুর, করতে পারে অগ্নিসংযোগ। এতে তাদের কয়েক লাখ টাকার গাড়ির বড় ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তাই ভয়ে বেশিরভাগ দূরপাল্লার বাসসহ বড় যানবাহনগুলো অবরোধে চলাচল করছে না। এছাড়া বন্ধ থাকছে বেশিরভাগ দোকানপাট ও শপিং মল। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সিলেট-ঢাকা মহাসড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল রাস্তার পার্শ্ববর্তী ব্যবসায়ীরা।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি সূত্রে জানা গেছে- বিএনপি-জামায়াতের চলমান অবরোধে সিলেট জেলা প্রতিদিন প্রায় ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
সিলেট মহানগরের শিবগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী ফয়সল আহমদ। এ বাজারে তাঁর স্টেশনারী দোকান রয়েছে। কিন্তু চলমান অবরোধের দিনগুলোতে তিনি দোকান খুলতে পারছেন না ভয়ে। তিনি সিলেটভিউ-কে বলেন, ‘এভাবে অবরোধ চলতে থাকলে লোকসানে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবে না। ব্যবসায়ীদের পথে নামতে হবে।’
দক্ষিণ সুরমার চন্ডিপুল এলাকার ব্যবসায়ী এনাম আহমদ জানান, এই এলাকা সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের অংশ হওয়ায় এখানে সব সময়ই ব্যবসা ভালো হয়। কিন্তু অবরোধের কারণে দোকান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কারণ- এই এলাকায় বেশিরভাগ বিশৃঙ্খলা হয়। তার উপর যানবাহন চলাচল বন্ধ। অবরোধের কারণে বড় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন তিনি। দোকান বন্ধ রাখলেও কর্মচারীদের বেতন এবং দোকান ভাড়া দিতে হবে সময়মতো।
কেবল চণ্ডীপুল নয়, চলমান অবরোধে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সিলেটের ব্যবসা-বাণিজ্যে। অবরোধের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে সিলেট মহানগরে দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন সিলেটের ব্যবসায়ীরা। অবরোধ চলাকালীন গুটিকয়েক দোকান খোলা রাখলেও বিভিন্ন সময় নাশকতা শুরু হলে বাধ্য হয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন তারা।
এদিকে অবরোধ চলাকালীন সিলেটের সঙ্গে দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে খুবই কম। আঞ্চলিক রুটে দু-একটি বাস চলাচল করলেও পিকেটারদের ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগের ভয়ে বন্ধ রাখা হয় বেশিরভাগ বাস।
অপরদিকে, পর্যটননির্ভর ব্যবসাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো উৎসব অনুষ্ঠান ছাড়াও সারা বছরই পর্যটকরা সিলেটে আসেন। এ ছাড়া সাপ্তাহিক সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও পর্যটকদের ভিড় থাকে। হোটেল-রিসোর্টগুলোতে দেওয়া থাকে অগ্রিম বুকিং। রেস্টুরেন্টগুলোতে থাকে উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের ডাকা চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে পর্যটননির্ভর এই ব্যবসাগুলো। সিলেটের রেস্টুরেন্টগুলোতে নেই ভিড়। অনেকেই বাতিল করেছেন হোটেল-রিসোর্টের বুকিং।
সিলেট মহানগরের পানসী রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আহমেদ বলেন, ‘গাড়ি বন্ধ, মার্কেট বন্ধ, মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না। এর খারাপ প্রভাব আমাদের ব্যবসায় পড়েছে। তার ওপর আমাদের ব্যবসা পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল। এখন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে মানুষজন ঘুরতেও আসবেন না। রেস্টুরেন্টে ক্রেতা না এলেও প্রতিদিনের স্টাফ খরচসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ আমাদের ঠিকই বহন করতে হয়।’
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন- ‘বিএনপি-জামায়াতের অবরোধে সিলেটে প্রতিদিন প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এর আগে করোনা মহামারিতে ধস নেমেছিল আমাদের ব্যবসা খাতে। এখন আবার আমরা সিলেটের ব্যবসায়ীরা এই রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘সিলেটের অর্থনীতি পর্যটননির্ভর। সারা বছরই সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকরা আসেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে লাগাতার অবরোধে খা-খা করছে সিলেটের হোটেল-রিসোর্টগুলো। যদি এরকম চলতে থাকে তাহলে ব্যবসায়ীদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।’
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন