মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং এ সপ্তাহেই সান ফ্রান্সিসকোর বে এরিনায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আগামী ১৫ নভেম্বর এই দুই ক্ষমতাশালী প্রেসিডেন্টের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো মুখোমুখি সাক্ষাৎ হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ, তাইওয়ান, ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং নির্বাচনে হস্তক্ষেপের মতো অনেক বিষয়ই উঠে আসবে এ বৈঠকে।
এদিকে চলতি বছরের শুরুতে দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরে।
যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে, চীন তাদের আকাশে গুপ্তচর বেলুন পাঠিয়েছে। পরে মার্কিন যুদ্ধবিমান সেটি দক্ষিণ ক্যারোলাইনার উপকূলে ভূপাতিত করে। এর আগে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়কার হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করেন, যার জেরে দুই দেশের মধ্যে সামরিক যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় চীন।
যুক্তরাষ্ট্রে পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাইডেন এই সম্পর্ক আবার পুনরায় স্থাপনে ‘সংকল্পবদ্ধ’।
কিন্তু চীনকে তাতে খুব একটা ‘আগ্রহী’ বলে মনে হচ্ছে না।
এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন আর পাঁচ বা ১০ বছর আগের মতো সম্পর্ক নেই। তাই আমরা কোনো দীর্ঘ তালিকা দিতে পারছি না যে অনেক ফলাফল বা বলার মতো কিছু বেরিয়ে আসবে। লক্ষ্য হলো প্রতিযোগিতার বিষয়টি সামলানো, কোনো সংঘাতের ঝুঁকি যাতে তৈরি না হয় সেই ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিশ্চিত করা যেন যোগাযোগটা অব্যাহত থাকে।
’
বাইডেন-শি বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (এপেক) সম্মেলনে, যা ১১ নভেম্বর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে বসছে।
চীনের দিক থেকে আগ্রহের শীর্ষে থাকবে তাইওয়ান প্রসঙ্গে আলোচনা, যেখানে সামনের বছরের শুরুতে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এই স্বশাসিত দ্বীপ দেশটিকে নিজেদের অংশ বলে মনে করে চীন।
শি হয়তো নিশ্চয়তা চাইবেন যুক্তরাষ্ট্র যেন কোনোভাবেই তাইওয়ানের এই স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন না করে। অন্যদিকে বাইডেন তাইওয়ানের আশপাশে বেইজিংয়ের সামরিক তৎপরতা নিয়ে মার্কিনি উদ্বেগ তুলে ধরবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চীনে প্রযুক্তি রপ্তানিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে বেইজিংয়ের আঞ্চলিক দাবি নিয়ে উত্তেজনাও হবে আলোচনার বিষয়।
বাণিজ্য ও প্রতিযোগিতা নিয়ে এই মূল মতবিরোধগুলো ছাড়াও বাইডেনের জরুরি অনুরোধ থাকবে যাতে চীন তাদের সব রকম প্রভাব খাটিয়ে ইরানকে সতর্ক করে, যেন ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে কোনোভাবেই সংঘাত ছড়িয়ে না পড়ে।
বিশ্লেষকদের অনুমান, এই বৈঠক থেকে মাঝারি কিছু হয়তো অর্জিত হবে। যেমন দুই দেশের সামরিক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন এবং চীনের তৈরি ফেনটানিলের আসা বন্ধ হবে।
নেই অগ্রগতির আশা
কিন্তু কোনো পক্ষই এমন কোনো অভাবনীয় অগ্রগতির আশা করছে না, যা দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে শুরু করতে সাহায্য করবে, স্থিতিশীলতা ও বোঝাপড়া বজায় রাখবে।
এদিকে চীন সম্পর্কের অবনতির জন্য ওয়াশিংটনকে দায়ী করে। সেন্টার ফর দ্য স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জুড ব্ল্যানশেট বলেন, শি এই বিষয়টি গত মার্চে পরিষ্কার করেছেন, যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘চীনকে ঘিরে ফেলা ও দমন করার’ অভিযোগ আনেন।
আর যখন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত জি ফেং সম্পর্কের উন্নতির দিকে ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন, একই সঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিশ্চয়তাও চাইছেন। হংকং ফোরামে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় তিনি এমন মন্তব্য করেন। বেইজিং জানতে চায়, ‘যুক্তরাষ্ট্র চীনের সিস্টেম বদলাতে চায় না, কোনো শীতল যুদ্ধেরও অবতারণা করবে না, তাইওয়ানের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন করবে না বা চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করার কোনো লক্ষ্য তাদের নেই।’
বাইডেন প্রশাসন বলছে, তারা আক্রমণাত্মক চীনা আচরণকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে, যা আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতিকে লঙ্ঘন করে।
এ ছাড়া বেলুনকাণ্ড ঘিরে উত্তেজনা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টাও চোখে পড়ার মতো। গত জুন থেকে এ পর্যন্ত তারা তিনজন কেবিনেট সদস্যকে বেইজিং পাঠিয়েছে, যার মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনও আছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনের গুপ্তচর বেলুন ওড়ানোর সিদ্ধান্তটা ‘অগ্রহণযোগ্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’—এই অভিযোগ তুলে ব্লিনকেন গত ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠিতব্য সফর হঠাৎ করেই বাতিল করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গত জুন মাসে যখন সফরটি অনুষ্ঠিত হয়, তিনি শির সঙ্গে খুবই ‘জোরালো আলোচনা’ হয়েছে বলে বর্ণনা করেন। আর এই সম্মেলন তার সেই কূটনীতিরই ফল।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কূটনীতিকরা ‘প্রায় প্রতিটি আলোচনায়’ চীনের সঙ্গে সামরিক যোগাযোগ পুনরায় শুরুর ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সাফল্য তাতে আসেনি। ঘুরেফিরে সেই গুপ্তচর বেলুন প্রসঙ্গ উঠে আসে এবং যোগাযোগ স্থাপনের আলোচনা থমকে যায় বলে মন্তব্য করেছেন একজন মার্কিন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি ওই বেলুনের অধ্যায়টা সে সময় বেইজিংয়ের সঙ্গে আমাদের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগে বেশ সমস্যা তৈরি করেছে।’
টিকিট কেটে শির সঙ্গে নৈশভোজ
বেশ কিছু মার্কিন গণমাধ্যমের খবর, বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পর শি সান ফ্রান্সিসকোয় মার্কিন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত নৈশভোজে যোগ দেবেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ৪০ হাজার মার্কিন ডলারের বিনিময়ে অতিথিরা চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একই টেবিলে বসার সুযোগ পাবেন। আর জনপ্রতি টিকিটের মূল্য শুরু হয়েছে দুই হাজার ডলার থেকে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক বিষয়ক জাতীয় কমিটির একজন মুখপাত্র, যিনি এই নৈশভোজের আয়োজনেও যুক্ত রয়েছেন, তিনি বলেন, চীনের ‘খুবই উচ্চপদস্থ’ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা আছে। তবে সেখানে শি উপস্থিত থাকবেন কি না তা নিশ্চিত করেননি তিনি।
বাইডেনের ওপর ভার
শি-বাইডেন বৈঠকের আগে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী হি লিফেংয়ের সঙ্গে এক বৈঠকে বসছেন, যেখানে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে।
এই বৈঠক সামনে রেখে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছে, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ‘সংকট দূর করা ও কাটিয়ে ওঠার’ ভার বাইডেনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের ৮ নভেম্বরের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘ওয়াশিংটনে একটা অপশক্তি আছে, যারা যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের উন্নয়ন চায় না এবং যখনই কোনো জটিলতা তৈরি হয়, তখনই তারা বেশি কার্যকর ভূমিকা নেয়।’
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন