মি: সুনাক দলকে ডানপন্থী নয়, জনসমক্ষে অনেকটা লিবারেল সেন্ট্রিষ্ট হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন
Dr Zaki Rezwana FRSA || GBnews24.com ||
বহু প্রতীক্ষিত স্যুয়েলা ব্র্যেভারম্যানের বরখাস্তকরণ, বৃটিশ মন্ত্রীসভায় রদবদল -- এসব কিছু ছাপিয়ে বৃটিশ রাজনীতিতে সব চাইতে গুরুত্ব বহন করে যে ঘটনাটি তা হচ্ছে ডেভিড ক্যামরোন বা আরো শুদ্ধ করে বললে লর্ড ডেভিড ক্যামরোনের মন্ত্রীসভায় প্রত্যাবর্তন! এই ঘটনার কারণ বুঝতে গেলে সারাদিন বৃটিশ মিডিয়া পরিবেশিত রিশাফলের তথ্যে আচ্ছন্ন না হয়ে বেশ কিছু ঘটনার গভীরে ঢুকে সেগুলোর 'টু প্লাস টু' করা প্রয়োজন। অনেকগুলো প্রশ্নের নিরিখে শুধুমাত্র মিডিয়া সারাদিন আমাদের যা শোনায় তার বাইরেও দৃশ্যপটে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার বিশ্লেষণ দাবি রাখে আজকের এই লিখাটিতে, কারণ, একটি কথা আছে, "Men may tell lies but circumstances don't."
মন্ত্রীসভায় যে কোনো রদবদলের আগে সব সময়েই রাজনৈতিক অঙ্গনে ও মিডিয়াতে কিছু জল্পনা কল্পনা ও কানাঘুষা শোনা যায় - এটাই স্বাভাবিক, এটাই হয়ে আসছে। স্যুয়েলা ব্র্যেভারম্যানের বরখাস্তের সঙ্গে সঙ্গে একটি গাড়ী এসে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে থামলো এবং গাড়ী থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন তাঁকে দেখে স্কাই টিভির সাংবাদিক বেথ রিগবি সহ অনেক সাংবাদিক হা হয়ে গিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন তাঁদের বলা হয়েছিল ক্যামেরা তাক করে রাখতে তবে কে আসছেন তা তাঁরা জানতেন না। কেন এত গোপনীয়তা? ৩৫০ জন এমপির ভেতর একজনও যোগ্যতা সম্পন্ন এমপি ছিলেননা যাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব দেওয়া যেত? জেমস ক্লেভারলি কি একজন ব্যর্থ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা তিনি কি এমন কোনো কাজ করছিলেন যে কারণে তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে নেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছিল? যদি সেন্ট্রিষ্ট একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রয়োজন ছিল তাহলে লেফ্ট বা রাইট উইং বাদ দিয়ে একজন সেন্ট্রিষ্ট এমপিও কি খুঁজে বের করা গেলনা? মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে কনজারভেটিভের কনফারেন্সে ঋষি সুনাক তাঁর পূর্বসূরীদের কৃতকর্মের জন্যে দোষারোপ করার পরও কেন তাঁদেরই একজনকে বেছে নিলেন তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে? কেন পার্লামেন্টে জবাবদিহি এড়ানো যায় এমন একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রয়োজন পড়ল ঋষি সুনাকের?
প্রায় ৫৩ বছর পর কোনো বৃটিশ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রত্যাবর্তন ঘটল। ১৯৭০ সালে বৃটেনের একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এলেক্স ডাগলাস হোম পরবর্তীতে এডওয়ার্ড হিথের মন্ত্রী সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্ব পালন করতে এসেছিলেন। কাজেই অতীতেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রত্যাবর্তনের ঘটনা রয়েছে - এটি যেমন সত্য তেমনি আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, লর্ড ক্যামরোনকে নিয়োগ দেওয়া ঋষি সুনাকের আদৌ কোনো নির্বাচনী কৌশল নয় –এর উদ্দেশ্য ভিন্ন! আমার এই বিশ্বাসের সমর্থনে কিছু তথ্য ও ঘটনার জিগস পাজেলগুলো মেলাতে হবে।
একটি কথা মনে রাখতে হবে, বৃটেনে বর্তমানে ইসরাইল হামাস ইস্যু থেকে শুরু করে রাশিয়া ইউক্রেন ইস্যু অর্থাৎ সব পররাষ্ট্র সিদ্ধান্তই বাইপার্টিজান বা দ্বিদলীয়। এই পররাষ্ট্র ইস্যুগুলোতে লেবার ও কনজারভেটিভের অবস্থান একই। সেই বিচারে লর্ড ক্যামরোনের উপস্থিতি এসব বিষয়ে জেমস ক্লেভারলির চাইতে আলাদা বা বাড়তি কোনো প্রভাব ফেলবে না। খুব সচেতনভাবে কথা বলার ব্যাপারে এমপিদের মধ্যে জেমস ক্লেভারলির একটি সুনাম রয়েছে। কাজেই তাঁকে স্যুয়েলার পরিবর্তে নিত্যই সহজেই সমালোচনার মুখে পড়ার মত একটি মন্ত্রণালয় হোম সেক্রেটারির পদ দেওয়াটা পরস্থিতি শীতল করার জন্যে যেমন কার্যকরী তেমনি লর্ড ক্যামরোনের জন্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটি খালি করার জন্যেও জরুরী হয়ে পড়েছিল। মন্ত্রীসভায় জেমস ক্লেভারলির গ্রহণযোগতা অনেক বেশী, তাই তাঁকে হোম সেক্রেটারির নীচে আর কোথাও স্থান দেওয়া সম্ভব ছিলনা। অন্যদিকে স্যুয়েলা ব্রেভারম্যানের অপসারণ যেটি বলা যায় একরকম ওভার ডিও হয়ে পড়েছিল বিশেষ করে সম্প্রতি টাইমসে প্রকাশিত ব্রেভারম্যানের আর্টিকেল ও সে সংক্রান্ত নাম্বার টেন ডাউনিং স্ট্রিটকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার ঘটনা ঘটার পরে।
লর্ড ক্যামরোনকে নিয়োগ দেওয়ার কারণ হিসেবে একটি তত্ত্ব হাজির করাই যেতে পারে, তা হচ্ছে, মি: সুনাক দলকে ডানপন্থী নয়, জনসমক্ষে অনেকটা লিবারেল সেন্ট্রিষ্ট হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। এটি ঠিক যে, আমরা যদি কনজারভেটিভের নির্বাচন ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখি, কোন্ কোন্ সময়ে কনজারভেটিভ নির্বাচনে জিতেছিল, তাহলে আমরা দেখব কনজারভেটিভ তখনই জিতেছে যখন মধ্যপন্থী (সেন্টার) ও ডানপন্থী উভয় ভোটারকে সন্তুষ্ট করা গিয়েছিল - শুধুমাত্র কনজারভেটিভজম দিয়ে নির্বাচনে কখনো বিজয় আসেনি। বেঞ্জামিন ডেসরেইলি, ষ্টেনলি বল্ডুইন, উনষ্টন চার্চিল, মার্গারেট থ্যাচার - সবাই কনজারভেটিভের মূল তত্ত্বগুলো রেখে সেন্টারে এসেছিলেন বা কিছুটা মধ্যপন্থী হয়েছিলেন। কনজারভেটিভ সেইসব নির্বাচনে জিতেছে যেখানে কনজারভেটিভের অবস্থান ছিল সেন্টার- রাইট অর্থাৎ কিছুটা মধ্যপন্থী কিছুটা ডানপন্থী। লেবারের নির্বাচন দেখলেও একই ধারণা পাওয়া যায়। একেবারে বামে সরে আসা জেরেমি করবিনকে আপামর সাধারণ জনগণ গ্রহণ করতে চায়নি যদিও লেবার দলের তৃণমূল সদস্যদের মধ্যে জেরেমি করবিন অত্যন্ত জনপ্রিয়। অর্থাৎ সেন্টারে যে জনগোষ্ঠী অবস্থান করছে সেই ‘ ইলেকটরাল স্যুইট স্পট’-কে উপেক্ষা করে নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি কোনো দল - না লেবার, না কনজারভেটিভ। কাজেই, লর্ড ক্যামরোনকে নিয়োগের পেছনে একজন লিবারেল সেন্ট্রিষ্টকে আনার তত্ত্বটি, তত্ত্ব হিসেবে সঠিক ও মানানসই কিন্তু এই বিশেষ ক্ষেত্রে ঋষি সুনাকের উদ্দেশ্য শুধু যে সেটি নয় - তা ভাববার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
প্রশ্ন করা যায়, বার বার দল থেকে চাপ আসলেও ঋষি সুনাক কেন নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চাইছেন? নির্বাচন পিছিয়ে দিলে কনজারভেটিভের ফলাফল তুলনামূলকভাবে ভাল হবে এমন কোনো সম্ভাবনা যে নেই তা ঋষি সুনাক জানেন। নির্বাচনে কনজারভেটিভ যে জয়লাভ করবে না ঋষি সুনাক কেবলমাত্র যে তা বুঝে গিয়েছেন তা-ই নয়, তিনি তা মেনেও নিয়েছেন। তাই নির্বাচনের আগেই ঋষি সুনাক ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতের সাথে ‘পোষ্ট ব্রেক্সিট ট্রেড ডিল'-টি তিনি লর্ড ক্যামরোনের মাধ্যমে সেরে ফেলতে চান। এই বিলটি হলে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম আইটি কোম্পানী ইনফোসিস যেখানে ঋষি সুনাক ও তাঁর স্ত্রীর প্রায় ৯০০ মিলিয়ন পাউন্ডের সমতূল্য শেয়ার রয়েছে সেটির দর ধেই ধেই করে বেড়ে দাঁড়াবে কয়েক বিলিয়নে। এই পোষ্ট ব্রেক্সিট ট্রেড ডিলে বৃটিশ স্বার্থ কম দেখা হচ্ছে, বরং এই ডিল করাতে সক্ষম হলে ইউরোপীয় মানদন্ডের চাইতে নীচু মানের পণ্য গ্রহণ করতে হবে বৃটেনকে এবং ভারতীয় নাগরিকদের বৃটেনে চাকরীর সুযোগ দিতে হবে। কোনো রকম আর্থিক সুবিধে ছাড়া লর্ড ক্যামরোন একাজে সহায়তা করবে - এটা ভাবা এখনকার জন্যে বোকামী, তবে ভবিষ্যৎ এ সত্য প্রকাশ করবেই। এখানে একটু বলে রাখা প্রয়োজন, স্যুয়েলা ব্রেভারম্যান এই ডিলের বিরোধিতা করে আসছিলেন। স্যুয়েলা ব্রেভারম্যানকে বরখাস্ত করার কারণ বহু আগে থেকেই ঘটে আসছিল তবে লর্ড ক্যামরোনকে নিয়োগ দেওয়ার প্রাক্কালে এতদিনে ঋষি সুনাকের চোখে তা ধরা পড়ল।
আমরা জানি, এমপিদের পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার একটি চিন্তা থাকে; তাঁদের নির্বাচনী এলাকার জনগণের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে - এমন চিন্তা থাকে; তাঁদের আয়ের হিসেব নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তার জবাব দিতে হয়; সেই সাথে পার্লামেন্টে বিরোধীদলের তাবৎ প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। এক্ষেত্রে, অষ্টারিটি খ্যাত, রেফারেন্ডাম খ্যাত ও গ্রীনসিল খ্যাত লর্ড ক্যামরোনকে এসবের কোনো কিছুরই মোকাবেলা করতে হবে না, কারণ তিনি এমপি নন, তিনি লর্ড। কাজেই আইনগতভাবে এসব কিছুর ঊর্ধ্বে থাকা লর্ড ক্যামরোনই হচ্ছেন মোক্ষম ব্যাক্তি যাকে দিয়ে ঋষি সুনাকের কিছু স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কাজ করিয়ে নেওয়া সম্ভব। এই উদাহরণ আমাদের আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছে হাউজ অফ লর্ডস বাতিল অথবা রিফর্ম করার প্রয়োজনীয়তা কত বেশী।
এবার আরেকটি ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক। নিয়োগের একেবারে সঙ্গে সঙ্গেই, এমন কি ক্যাবিনেটে যাওয়ার আগেই লর্ড ক্যামরোন কোন বিশ্বনেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন? কোনো ইইউ নেতা, কোনো মার্কিনী নেতা কিংবা ইসরায়েলী নেতার সঙ্গে? না, নিয়োগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দেখা করেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড: জয় শঙ্করের সাথে। আরো লক্ষ্য করার মত বিষয় হচ্ছে, ড: জয় শঙ্কর বিলেতেই অবস্থান করছেন নভেম্বরের ১১ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত। কাজেই গত কয়েকদিনে বৃটেনের রাজনীতির নাট্যকর্মের পুরোটাই তিনি অবলোকন করেছেন। ড: জয় শঙ্কর তাঁর টুইট বার্তায় বলেছেন তিনি আগের দিন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলির সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং পরের দিন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ক্যামরোনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৃটিশ মিডিয়া যেখানে মূলত মন্ত্রীসভার রদবদলের খবর পরিবেশন করছে এবং তার মাঝে একটু এই বৈঠকের কথাও বলেছে তখন ভারতীয় মিডিয়া এই বৈঠককে ভারতের জন্যে সার্থক বৈঠক বলে আখ্যায়িত করছে। আমাদের মনে থাকার কথা, মাত্র দু’মাস আগে ঋষি সুনাক নর্থ সী - তে তেল ও গ্যাস উত্তোলনের জন্যে বহু কোম্পানিকে লাইসেন্স দিয়েছে। যারা খেয়াল করেছেন তাঁদের এটাও মনে থাকার কথা, ইনফোসিস জ্বালানী কোম্পানী ‘BP’- র সঙ্গে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের একটি ডিল ও ‘Shell’- এর সঙ্গে ২ বিলিয়ন পাউন্ডের একটি ডিলে স্বাক্ষর করেছে।
আগামী নির্বাচনে কনজারভেটিভ হেরে যাওয়ার পর বলা যায়, কনজারভেটিভ দলে অনির্বাচিতভাবে আগমন এবং পরবর্তীতে নির্বাচনে হেরে যাওয়া অর্থাৎ পুরো দ্বায়িত্বকালে অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীদের তালিকায় জেমস কালাহান, জন মেজর ও গর্ডন ব্রাউনের মত আরো কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর সাথে ঋষি সুনাক তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছেন। তবে হব কথার শেষ কথা, লর্ড ক্যামেরোনর এই নিয়োগ লেবারকে আগামী নির্বাচনে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে কোনো রাজনৈতিক কৌশল বা কোনো নির্বাচনী ষ্ট্র্যাটেজি – একথা বিশ্বাস করার মত কোনো যুক্তি আমি দেখিনা।।
………………..
লেখক একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সিনিয়র সংবাদ পাঠক ও কলামিস্ট
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন