সুনসান চারদিক, নিস্তব্ধ রাত। রবিবার দুপুরেও এটি ছিল কল্পিত এবং পরাবাস্তব বলে মনে হওয়া এক ছবি। রাত হতে হতে সেটিই বরং প্রবল বাস্তব। নীলে ছেয়ে যাওয়া নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামও তাই উল্টো বিলীন নীল বেদনায়।
প্রাপ্তির অপার আনন্দে ভেসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আসা ভারতীয় সমর্থকদের নীরব আর্তনাদেই ভারী রাতের আহমেদাবাদের হাওয়াও।
গোটা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে পড়া হাহাকারের মধ্যে নিঃশব্দে বিজয় তাজ লুট করে নেওয়ার মতো এমন হৃদয়ভাঙা নীরবতাই তো নামিয়ে আনতে চেয়েছিলেন প্যাট কামিন্স। চেয়েই থামেননি অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক, সদলবলে তিনি পেরেছেনও। অন্যদের তুলনায় বেশিই পেরেছেন ট্রাভিস হেড।
ফাইনাল সামনে রেখে তাঁর অধিনায়ক ‘বিগ ম্যাচ প্লেয়ার’ হিসেবে যাঁদের যাঁদের নাম বলেছিলেন, ছোট্ট সেই তালিকা থেকে এই ওপেনারের নামটি কাটা পড়ে যাওয়ার কথা ছিল না। মাত্র পাঁচ মাস আগেই তো ওভালে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে তাঁর ১৬৩ রানের ইনিংস ভারতের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়েছিল। এবার আরেকবার তীরে গিয়ে তরি ডোবার গল্পেও ভারতের মাথা ব্যথা বাড়িয়ে যাওয়া সেই হেডই অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের নায়কও। এবার নিশ্চয়ই তাঁর নামটি বাদ দেওয়ার ভুল আর অবচেতনেও করবেন না কামিন্স!
অথচ হেডের জন্য এই বিশ্বকাপ একটু দেরিতেই শুরু হয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ার প্রথম পাঁচটি ম্যাচে খেলেনইনি। ভাঙা হাতের এই ব্যাটারকে বয়ে বেড়ানোর যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে লাগে একটি ম্যাচই। ধর্মশালায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম খেলতে নেমেই সেঞ্চুরি করেন। এরপর কলকাতায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেমিফাইনালেও ব্যাটে-বলে ঝলসে উঠে হন ম্যাচের সেরা। এবার আরেকটি ফাইনালেও ‘প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ’ হেডের ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি।
দলের চরম বিপর্যয় থেকে তাঁর উত্থানে সঙ্গী হয়ে যান মার্নাস লাবুশানেও। দুজনের জুটি উইকেটে এমন লেপ্টে যায় যে তাঁদের আর বিচ্ছিন্নই করা যায় না। চতুর্থ উইকেটে ১৯২ রানের পার্টনারশিপ ভারতকেও আর ন্যূনতম সম্ভাবনা তৈরি করতে দেয় না। সেঞ্চুরি করে আরো দূরে ছুটতে থাকা হেডের ব্যাট থেকে আসতে পারত উইনিং স্ট্রোকও। কিন্তু মোহাম্মদ সিরাজকে ছক্কা মারতে গিয়ে এই ব্যাটার থামেন ১৩৭ রানে। তখন বিশ্বকাপ জয় থেকে মাত্র ২ রান দূরে অস্ট্রেলিয়া। হেডের বিদায়ের পরের বলেই ম্যাক্সওয়েলের ব্যাটে সেই কাজটিও হয়ে যায়। ৪২ বল বাকি থাকতে এক রকম অনায়াসেই ৬ উইকেটের জয়ে নীরব রাতের বিজয় মঞ্চে ওঠেন কামিন্সরা।
হেডকে নিয়ে অনেকটা বলা হলো, তবে সবটা নয়। ব্যাটিংয়ের আগেও নিজের অ্যাথলেটিসিজমের প্রমাণ দিয়েছেন ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়। যথারীতি বেদম মারতে থাকা রোহিত শর্মাকে (৩১ বলে ৪৭) থামান তিনি। অল্পবিস্তর বোলিং করলেও বোলার হিসেবে অবশ্যই নয়। তবে বোলার গ্লেন ম্যাক্সওয়েলও কৃতিত্বটা তাঁকে দিতে দ্বিধা করবেন না। এই অফস্পিনারের আগের দুই বলে ছক্কা ও চার মারা ভারত অধিনায়ককে পেয়ে বসেছিল আরেকবার উড়িয়ে মারার নেশা। কিন্তু শরীর থেকে দূরে খেলতে চাওয়ায় ব্যাটের নিচের দিকে লেগে ক্যাচ উঠে যায়। নাগালের বেশ বাইরে থাকলেও হেড হাল ছাড়লেন না। কাভার থেকে পেছন দিকে দিলেন দৌড়। শেষ মুহূর্তে আর কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না দেখে ডাইভ দিয়ে নিলেন অসাধারণ এক ক্যাচ।
যেটিকে দিনের শেষে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেওয়া মুহূর্ত হিসেবেও বেছে নেওয়া গেছে অবলীলায়। কারণ রোহিতের বিদায়ের পর থেকেই ভারতের রানের উদ্দাম গতিতে লাগাম পড়ে। ঢিমেতালে এগোতে থাকে স্বাগতিকদের ব্যাটিং। ১০ ওভারেই ৮০ রান তুলে ফেলা দলের মহা শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনও ফাইনালের উত্তাপে যেন পথ হারায় অনেকটা। ফিফটি করলেও এবার আর তেমন এগোতে পারেন না বিরাট কোহলিও (৫৪)। আগের দু্ই ম্যাচে বিস্ফোরক সেঞ্চুরি করা শ্রেয়াস আয়ারও (৪) এবার থামেন অল্পতেই। এঁদের হারানোর ধাক্কায় একা হয়ে যাওয়া লোকেশ রাহুলও ৬৬ রান করতে খেলে ফেলেন ১০৭ বল। অস্ট্রেলিয়ার নিয়ন্ত্রিত বোলিং তাঁকে ওভাবে খেলতে বাধ্যই করে এক রকম। দুই দফায় ৯৭ ও ৭০ বলে কোনো বাউন্ডারির মুখই দেখেনি ভারত। ফাইনাল জেতার জন্য যথেষ্ট রানও তাই স্কোরবোর্ডে আর জমা করে উঠতে পারে না রোহিতের দল।
মাত্র ২৪০ রান নিয়ে কি আর অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে বিশ্বকাপ ট্রফি ছিনিয়ে নেওয়া যায়? কিন্তু অনিশ্চয়তার ক্রিকেট সেই সম্ভাবনাও তৈরি করে ফেলে। আসরে প্রথমবারের মতো নতুন বল হাতে পাওয়া মোহাম্মদ সামি নিরাশ করেন না এবারও। দ্রুতই ফেরান ডেভিড ওয়ার্নারকে (৭)। আরেক প্রান্ত থেকে জসপ্রিত বুমরাহ তুলে নেন মিচেল মার্শ (১৫) ও স্টিভেন স্মিথকেও (৪)। ব্যস, প্রতিপক্ষকে ৪৭ রানে ৩ উইকেট হারানো দলে পরিণত করে রোহিতরাও প্রবলভাবে ফিরে আসার পথ খুলে ফেলেন।
সেই খোলা পথই বন্ধ হওয়ার শুরু ট্রাভিস হেডের ব্যাটে। যোগ্য সঙ্গত দেন লাবুশানেও। আসরজুড়ে যে কাজটি রোহিত আর কোহলি মিলে করে এসেছেন, সেই ছবিই এবার ফুটতে থাকে এই দুই অস্ট্রেলিয়ানের ব্যাটে। একজন চড়াও হন তো আরেকজন রয়েসয়ে খেলতে থাকেন। লাবুশানেও (১১০ বলে ৫৮*) হয়ে ওঠেন ধীরস্থিরতার প্রতীক। ৯৯ বলে ফিফটি করা বলে সে কথাই। অন্যদিকে হেড চড়ে বসেন প্রতিপক্ষের মাথায়। ৫৮ বলে ফিফটি করা পর্যন্ত একটু সদয় হলেও সেখান থেকে নিজের পঞ্চম ওয়ানডে সেঞ্চুরিতে যেতে আবার নির্দয়ও। সেখান থেকে মাত্র ৩৭ বলে তিন অঙ্কে যাওয়া হেডের ব্যাটেই অস্ট্রেলিয়ার মাথায় ওঠে বিজয়মুকুট।
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন