বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত, বললেন দেশটির লেখক-সাংবাদিকরা

একাত্তর সালে হানাদার বাহিনী যখন এদেশে আক্রমণ করে তখন ঢাকায় ছিলেন উর্দুভাষী সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ নাসিম আখতার মালিক। তার চোখের সামনে ঘটেছে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসিমা আখতার মালিক পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে পরিচিতদের বলেন তাকে কোনোভাবে একটি বোমা জোগাড় করে দিতে। সেই বোমা তিনি পাকিস্তান আর্মির হেডকোয়ার্টারে মারতে চান।

তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পাক আর্মির নৃশংস অত্যাচার দেখে এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এ নারী।

 

নাসিম আখতার মালিক জানান, নয় মাস যুদ্ধের পর যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল তখন পাকিস্তান জুড়ে কবরের নীরবতা নেমে আসে। সাধারণ জনগণ ছিল বিস্মিত ও হতাশ। ঢাকায় পাক আর্মি যে নির্মম জেনোসাইড চালিয়েছে তারা তা জানত না।

 

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি ও লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের প্রামাণ্যচিত্র ‘ভয়েস অব কনশান্স’-এ এসব কথা বলেছেন নাসিম আখতার মালিক।

আজ শনিবার আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে প্রামাণ্যচিত্রটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়ে গেছে। পয়তাল্লিশ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশে চালানো গণহত্যা বিষয়ে পাকিস্তানি লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী, সাবেক আমলা ও সামরিক কর্মকর্তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন। বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তাদের নিজেদের জীবনে কী বিভীষিকা নেমে এসেছে তাও উঠে এসেছে তাদের অনেকের বক্তব্যে।

 

প্রামাণ্যচিত্রে তারা জানিয়েছেন, তাদের অনেকেই ১৯৭১ সালে গণহত্যার প্রতিবাদ করে কারা-নির্যাতনসহ নানা ধরনের নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার পূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন কেউ কেউ। পাশাপাশি পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্মের লেখক ও গবেষকরা কিভাবে এই গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য পাকিস্তানে জনমত সৃষ্টি করছেন সেসব বিষয়ও উঠে এসেছে প্রামাণ্যচিত্রে। গণহত্যার প্রতিবাদকারী কয়েকজন পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী সরকারি নির্যাতনের কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার তথ্যও রয়েছে এই প্রামাণ্যচিত্রে।

বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আট দিনব্যাপী বিজয় উৎসবের বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে।

অনুষ্ঠানমালার প্রথম দিন শনিবার বিশ্বের সকল গণহত্যার শিকার ও নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এবং গণহত্যা নিরোধে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ দিবসে প্রামাণ্যচিত্রটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী ও আলোচনার আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানটি। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, বীর মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা শাহরিয়ার কবির এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারা যাকের।

 

প্রামাণ্যচিত্রে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগার খান, লাহোরের মানবাধিকারকর্মী তাহিরা মাজহার আলী খান, ইসলামাবাদের কবি, সাংবাদিক আহমাদ সালিম, সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শেখার, লাহোরের নাট্যকার ও কলামিস্ট সায়িদ আহমেদ, নৃত্যশিল্পী শিমা কিরমানি, মানবাধিকারকর্মী তাহিরা আবদুল্লাহ, সাংবাদিক হামিদ মীর, মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীর প্রমুখের বক্তব্য রয়েছে।

শাহরিয়ার কবির জানিয়েছেন প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণে তার দশ বছর সময় লেগেছে। এর মধ্যে বক্তব্যদাতাদের অনেকে মারা গেছেন। প্রামাণ্যচিত্রে বক্তারা একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তান আর্মি স্পষ্ট জেনোসাইড ঘটিয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। এ সময় তারা বলেন, পাকিস্তানের উচিৎ নিয়ম মেনে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া।

আলোচনাপর্বে শাহরিয়ার কবির জানান, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজে পাকিস্তানে তাকে কিছু দিন অবস্থান করতে হয়েছে। এ সময় হোটেল থেকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তাকে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। শেষে বাংলাদেশ দূতাবাসে থাকতে হয়েছে। এ ছাড়া অনেক বাধাবিঘ্ন পোহাতে হয়েছে তাকে। শাহরিয়ার কবির বলেন, যতদিন পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ না চাইবে ততদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রটি জেনোসাইডের কথা স্বীকার করবে না। এই জন্যই পাকিস্তানে জনমত গঠন করা প্রয়োজন। তবে পাকিস্তানে এখনও কিছু মানুষ আছেন যারা এই যুদ্ধাপরাধের আনুষ্ঠানিক স্বীকার ও স্বীকৃতি চায়। এ সময় তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যার অস্বীকারকারীদের একটা বড় জবাব এই প্রামাণ্যচিত্র।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, এ ধরনের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে পাকিস্তানের মানুষ সাহায্য করবে তা আশা করা যায় না, এমনকি বাংলাদেশেরই অনেক মানুষ সাহায্য করেন না। মূলত এই কারণেই ছবিটি তৈরি করতে দশ বছর লেগেছে। এ সময় তিনি বলেন, ‘চারদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি অব্যাহত আছে। ভারতের দশটা চলচ্চিত্রের একটা এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত হচ্ছে। সেখানে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলা হচ্ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তারা ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে। এখন বিকৃতায়নের জোয়ার চলছে।’

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, এই কয়দিনে গাজায় সতের হাজারের বেশি মানুষকে ইসরায়েল হত্যা করেছে। মিয়ানমারেও এমন হত্যা চলছে। সবই জাতিসংঘের চোখের সামনে ঘটছে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। বাংলাদেশের গণহত্যার ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের অনীহা আছে। পাকিস্তানের বহু নাগরিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আন্তরিক। কিন্তু বেশিরভাগই বিকৃত ইতিহাসে বিশ্বাস করে আছে এখনও। শাহরিয়ার কবিরের প্রামাণ্যচিত্রটি অনলাইনে চলে গেলে তরুণদের বিশ্বাসে পরিবর্তন আসতে পারে।

জাতিসংঘে ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো গণহত্যা প্রতিরোধ ও এ-সংক্রান্ত শাস্তিবিষয়ক একটি প্রথা গ্রহণ করে। এরপর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ৯ ডিসেম্বর দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। জাতিসংঘ দিবসটি ঘোষণার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিবছর দিনটি পালন করে আসছে।

জিবিডেস্ক //

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন