অনেকটা পদ্মা নদীর দ্রুত বয়ে চলা পানি প্রবাহের মতোই, জলবায়ু সংকট এখন গতিশীল, দ্রুতগতির আর প্রায়শই অনিশ্চয়তায় ঘেরা। তবে এই সংকট মোকাবেলায় যে আলোচনা চলছে তাকে মোটেই অনিশ্চয়তায় ভরা বলা যাবে না। কারণ চলমান কপ-২৮ এ দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা প্রশমন, অর্থায়ন ও অভিযোজন নিয়ে সেই অনুমানযোগ্য বিভেদই উদ্ভূত হতে দেখছি।
আসছে দিনগুলোতে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে উন্নতি করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।
আমাদের অবশ্যই ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতার গ্রহণযোগ্য মাত্রাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। বৈশ্বিক পর্যালোচনাকে অবশ্যই আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মসূচি নিতে হবে এবং আমাদের মতো ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়ে জরুরিভিত্তিতে অর্থায়নের গতি বাড়াতে হবে।
‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’র মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজকে রূপান্তরের নানান উপায় ঠিক করেছি। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ’র বদলে জলবায়ু সহনশীলতার পথনকশা ঠিক করেছি।
বিদ্যুৎ খাত রূপান্তরে আমাদের কর্মকৌশল হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সক্ষমতা ৩০ শতাংশে উন্নীত করা, টেকসই কৃষি গড়ে তোলা ও গ্রিড ব্যবস্থার আধুনিকায়ন।
আজ দেখছি দুবাইতে কিছু দেশ এমনকি বিজ্ঞানকেও চ্যালেঞ্জ করে চলছে। বাংলাদেশে আমরা দশকের পর দশক ধরে নিঃসরণ বৃদ্ধির প্রভাব প্রত্যক্ষ করছি। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কেবল এই বছরেই আমাদের দেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের দেশের মানুষ তীব্র দাবদাহ ও বিদ্যুৎহীন অবস্থার শিকার হয়েছে। হাজার হাজার স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছে। গত আগস্ট মাসে বন্যায় ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ হয়েছে বাস্তুচ্যুত।
বাংলাদেশ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্র শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশের জন্য দায়ী, তারপরও আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় সপ্তম স্থানে রয়েছি। বেশ কয়েকবছর ধরে বিভিন্নভাবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পেছনে বিনিয়োগের পাশাপাশি আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিশাল প্রভাবগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমার সরকারের গৃহীত সব পদক্ষেপের কেন্দ্রেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের প্রভাব প্রশমণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি আমাদের অর্থনীতি ও টিকে থাকার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য।
এখন আমরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রতিরক্ষা, সাগর উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও শ্বাসমূলীয় বন সৃজন করে যাচ্ছি। স্যাটেলাইটভিত্তিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিপজ্জনক আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এসব ব্যবস্থা অনেক প্রাণ বাঁচাতে সহায়তা করছে।
তবে কী করে আমরা আমাদের আন্তঃসংযুক্ত অর্থনীতি এবং খাদ্য থেকে শুরু করে বস্ত্রশিল্প পর্যন্ত নানা- যেগুলোর ওপর আমাদের লোকজন নির্ভর করে–ক্ষেত্রগুলোকে এগিয়ে নেব এবং কী করে আমরা অবকাঠামো বানাবো তা-ও অভিযোজনের বিষয়। আমাদের সাহসী কৌশলের জন্য দরকার আরো সাহসী বিনিয়োগ। সৌরশক্তি প্রযুক্তিকে অবশ্যই আরো সুলভ হতে হবে। ইনভার্টারকে নিরুৎসাহিত করা কর পুনর্বিবেচনা করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
অর্থায়নে বিশাল ব্যবধান
কপ-২৮ এ বিশ্বনেতারা অভিযোজন তহবিলে ১৬৯ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ অঙ্ক চলতি বছরের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ৩০০ মিলিয়ন ডলার থেকে যোজন যোজন দূরে। প্রতিবছরই অর্থায়নে ১৯৪ থেকে ৩৬৬ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ব্যবধান থেকে যাচ্ছে। আমাদের যা দরকার, এটা তার চেয়ে অনেক কম। এজন্য ধনী দেশগুলোকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে।
বিশ্বের যা জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন, সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে আমাদের মাত্র কয়েকটি দিন ও কিছু ঘণ্টা বাকি। কপ-২৮ এবং পরে কী অর্জন করা প্রয়োজন তা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সবারই জানা। সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর উচিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী এনডিসি (ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন) জমা দেওয়া এবং তা পূরণে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া। উন্নত দেশগুলোর অবশ্যই প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার করে দেওয়া উচিত এবং ২০২৫-পরবর্তী নতুন জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা অবশ্যই এখনকার প্রতিশ্রুতির চেয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি হওয়া উচিত।
জলবায়ু অর্থায়নের তিনটি অপরিহার্য মানদণ্ড পূরণ করা অত্যাবশ্যকীয়: অর্থ অবশ্যই পর্যাপ্ত, নিয়মিত ও সহজে পাওয়া যায় এমন হতে হবে। আমাদের মতো দেশগুলো সামনের অনেক বছর ধরে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে তহবিল অবশ্যই যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের কাছে সময়মতো পৌঁছাতে হবে।
আমাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি দূরকল্প দরকার। কপ-২৮ এ আমি আমার আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আমাদের অভিন্ন লক্ষ্যগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে, সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে এবং আরো বিলম্বের জন্য যে মূল্য দিতে হবে তা মনে রাখতে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি। আমি সবার কঠিন পরিশ্রম ও আন্তরিক প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।
একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি আমি, যা কিনা সাম্প্রতিকতম বিজ্ঞানের দ্ব্যর্থহীন তাগিদ।
পায়ের চারপাশে যখন পানি উঠে আসছে, তাপপ্রবাহ যখন ধারাবাহিকভাবে রেকর্ড ভেঙে চলেছে তখন আমরা মনে করতে বাধ্য হচ্ছি যে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো সামনের দিগন্তেই অপেক্ষা করছে। আমাদের অবশ্যই যুদ্ধপ্রস্তুতির মতো করে একত্রে এগুলোর মুখোমুখি হয়ে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
* প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ লেখাটি থমসন-রয়টার্স ফাউন্ডেশনের নিউজ লেটার ‘কনটেক্সট নিউজ’-এ গত ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩-এ প্রকাশিত হয়।
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন