দুবাই কপ শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল মঙ্গলবার সংযুক্ত আরব আমিরাত সময় সকাল ১১টায়। কিন্তু আগের রাতে লম্বা দর-কষাকষির পর মঙ্গলবার সকাল থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে এবারের কপও নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ নিয়ে মতান্তর সমঝোতা বিলম্বিত হওয়ার বড় কারণ।
সোমবার গ্লোবাল স্টকটেকের যে খসড়া উপস্থাপিত হয়েছিল, তার বিপক্ষে বেশির ভাগ দেশের প্রতিনিধিরা ছিলেন সরব।
এরপর নতুন খসড়ার অপেক্ষা শুরু হয়। কিন্তু মঙ্গলবার সারা দিনে সে অপেক্ষা শেষ হয়নি।
নতুন খসড়া কখন আসবে তা নিয়ে দিনভর বেশ নাটকও হয়েছে। কখনো শোনা গেছে দুবাই সময় বিকেলে আসছে পরের খসড়া।
এরপর জানা যায়, রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার দিকে খসড়া প্রকাশিত হতে পারে।
শেষে মঙ্গলবার রাতে কপ২৮-এর মুখপাত্র জানান, আগের রাত ও মঙ্গলবার দিনভর কপের প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর দলের সদস্যরা বিভিন্ন দেশ ও গোষ্ঠীর সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করেছেন।
‘সবার কথা যে শোনা হচ্ছে, তা নিশ্চিত করতে এই বিস্তারিত আলাপ হয়েছে। সব পক্ষের সমর্থন মিলবে এমন একটা খসড়া হাজিরের ব্যাপারে তিনি (প্রেসিডেন্ট) দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আলোচনা আজ রাত ৩টা পর্যন্ত চলবে,’ বলেছেন তিনি।
নতুন খসড়ায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ে ‘কড়া কথা থাকবে’ বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক দূত জন কেরি। মঙ্গলবার রাতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এটুকুই বলেন তিনি।
এর আগে সোমবার কপ২৮-এর প্রেসিডেন্ট সুলতান আল জাবের গ্লোবাল স্টকটেকের খসড়া উত্থাপন করার পর বেশির ভাগ প্রতিনিধিই আপত্তি তোলেন খসড়ার ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদের ভাষা নিয়ে, যেখানে জ্বালানিব্যবস্থা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা স্থান পেয়েছে। এই অনুচ্ছেদে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও উৎপাদন কমানোর প্রয়োজনীয়তার কথা থাকলেও ব্যবহার ধাপে ধাপে কতখানি কমানো হবে কিংবা কোন সময়ের মধ্যে পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে, সেসংক্রান্ত কিছু একেবারেই জায়গা পায়নি।
খসড়ায় তেল বা গ্যাসের নামই আসেনি, তবে গতবারের মতো এবারও কয়লার প্রসঙ্গ এসেছে। ‘আনএবেটেড’ কয়লা বা কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যবস্থা নেই এমন ক্ষেত্রে কয়লার ব্যবহার দ্রুতগতিতে নামিয়ে আনার কথা আবারও জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে, অর্থাৎ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়লা পোড়ানো অব্যাহত রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে কোন ধরনের প্রযুক্তি কিংবা প্রযুক্তির সাহায্যে কার্বন দূষণ ন্যূনতম কতটা কমাতে হবে, সে বিষয়ে খসড়ায় সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই।
পরিবেশবিদদের অভিযোগ, এই খসড়ায় আদতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পথ উন্মুক্তই রাখা হয়েছে। ব্যবহার কমানোর বিষয়টি রাখা হয়েছে ‘পছন্দ’ হিসেবে, ‘বাধ্যতামূলক’ নয়।
খসড়া নিয়ে সোমবার রাতেই এক সেশনে অসংখ্য দেশ ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদটি তাপমাত্রার বৃদ্ধি (প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে) দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না হয়, তা নিশ্চিতের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি বলে মন্তব্য করেছে। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও উৎপাদন ন্যায্য, সুশৃঙ্খল ও ন্যায়সংগত উপায়ে এমনভাবে কমানো যেতে পারে, যেন তার মাধ্যেমে ২০৫০ সালের আগে বা তার কাছাকাছি সময়ের মধ্যে নেট জিরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়। এই কথায় জীবাশ্ম জ্বালানি চাইলে ২০৫০ সালের পরও ব্যবহার করা যাবে এবং সে জন্য নানা যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা হবে, এমন ইঙ্গিত আছে বলে মনে করছেন সমালোচকরা।
অনুচ্ছেদটিতে ‘কার্বন ক্যাপচার, ইউটিলাইজেশন ও স্টোরেজের’ কথাও স্থান পেয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি লবি এই কার্বন নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ (সিসিএস) প্রযুক্তিকে সামনে এনে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সিসিএসকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাজারজাত করতে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচও করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত এই প্রযুক্তিতে প্রত্যাশিত সাফল্যের দেখা মেলেনি।
৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদটিতে বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের পরিমাণ তিন গুণ এবং বিদ্যুত্শক্তির সক্ষমতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হলেও এর জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর যে অর্থনৈতিক সহায়তার প্রয়োজন হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
কেবল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ব্যবস্থা নেওয়াই নয়, জলবায়ু অভিযোজনও এখন দেশগুলোর জন্য অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোমবারের খসড়ায় এই চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে নেওয়া হলেও, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহবান জানানো হলেও অভিযোজনের অর্থায়ন নিয়ে পরিষ্কার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এতে ২০২১ সালের মধ্যে জলবায়ু তহবিলে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করার পাশাপাশি জলবায়ু অর্থায়নের সুস্পষ্ট সংজ্ঞার ঘাটতির বিষয়টিও স্বীকার করে নেওয়া হয়। খসড়ায় চাহিদার সঙ্গে প্রতিশ্রুতির বিশাল ফারাক এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামগ্রিক অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ার বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে।
এবারের খসড়ায় প্রথমবারের মতো অভিযোজন অংশে ‘স্থিতিশীল খাদ্য ব্যবস্থাপনার’ উল্লেখ রয়েছে। তবে জলবায়ু সংকটের মিটিগেশন বা প্রশমন অংশে খাদ্য ব্যবস্থাপনার রূপান্তর বা কৃষিজাত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের উল্লেখ নেই। বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের এক-তৃতীয়াংশের সঙ্গে খাদ্য ব্যবস্থাপনা জড়িয়ে আছে, এ বিষয়টিকে দেশগুলোর নতুন জাতীয় পরিকল্পনায় (ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন-এনডিসি) অন্তর্ভুক্ত করতে অনেকেই জোর দাবি জানিয়ে আসছে।
গ্লোবাল স্টকটেকের এই খসড়ার সবচেয়ে বেশি সমালোচনা এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশ ও ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর দিক থেকে।
‘মার্শাল আইল্যান্ড প্রজাতন্ত্র এখানে নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করতে আসেনি। আমরা এখানে (দুবাই) এসেছি দেড় ডিগ্রির পক্ষে লড়াই করতে, আর এটা অর্জনের একমাত্র পথ হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা। কিন্তু আজ আমরা যা দেখছি, তা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। আমরা চুপচাপ আমাদের জলময় কবরে ফিরে যেতে পারব না। এমন কোনো ফল আমরা মেনে নেব না, যা আমাদের দেশ এবং ঝুঁকিতে থাকা কোটি কোটি মানুষ ও সম্প্রদায়কে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে,’ খসড়া নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন মার্শাল আইল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাণিজ্য মন্ত্রী জন সিল্ক।
‘আপনি বলছেন যে আপনি বিজ্ঞানকে স্বীকার করছেন, সম্মান করছেন কিন্তু এরপর এর সতর্কবার্তাকে অস্বীকার করে সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন, যেটা আপনি অঙ্গীকার করেছিলেন। এটা মোটেও যথেষ্ট নয়,’ বলেছেন মানবাধিকার, শান্তি ও ন্যায়বিচার নিয়ে কাজ করা সংগঠন দ্য এল্ডার্সের মেরি রবিনসন।
ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনালের গ্লোবাল পলিটিকাল স্ট্র্যাটেজির প্রধান হারজিৎ সিং বলেছেন, ‘গত সম্মেলনগুলোর তুলনায় এবার গ্লোবাল স্টকটেকের খসড়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে বড় ধরনের পশ্চাদপসরণ দেখা যাচ্ছে। বিস্ময়করভাবে, এতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি; যা পরিষ্কারভাবে বোঝাচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্ট লবির ক্ষমতাকে, যার মাধ্যমে তারা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দীর্ঘায়িত করার সুযোগ পেতে বৈশ্বিক নীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।’
কেউ কেউ দুষছেন কপ প্রেসিডেন্ট সুলতান আল জাবেরকেও।
‘কপ প্রেসিডেন্ট এমনভাবে পুরো জ্বালানি প্যাকেজকে হাজির করেছেন, তাতে এটি (খসড়া) আর জলবায়ুবিষয়ক সমঝোতা থাকছে না, স্কোরবোর্ডে জীবাশ্ম জ্বালানি লবির জয় ফুটে উঠছে। ২০৩০ সালের মধ্যে কয়লা, তেল আর গ্যাসের ব্যবহার ব্যাপক হারে কমানোর প্রয়োজনীয়তা এখানে অনুপস্থিত। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ আর বিদ্যুত্শক্তির সক্ষমতা দ্বিগুণ করার উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য রেখে বুঝ দেওয়া হয়েছে। এই খসড়া পারমাণবিক শক্তি বা সিসিএসের মতো ভুল সমাধানের দ্বারও উন্মোচন করছে। এই পুরো প্রকল্পের অর্থ দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব দেড় ডিগ্রি সীমার লক্ষ্যকে পরিত্যাগ করছে,’ বলেছেন জার্মানওয়াচের ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইমেট পলিসির প্রধান পিটার লাইডেন।
কপ প্রেসিডেন্সি বলছে, সোমবারের খসড়ায় যে ঘাটতি আছে, সেটা তারা অবগত। তবে তারা আলোচনার দ্বার উন্মোচন করতেই এমন খসড়া করেছে।
‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়টি সম্মেলনে অংশ নেওয়া প্রায় ২০০টি দেশের ওপর নির্ভর করছে, কেবল আমাদের ওপর নয়,’ বলেছেন কপের মহাপরিচালক মাজিদ আল সুয়াইদি।
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন