আমরা সোনালি প্রজন্মের মানুষ!  

gbn

জীবিকার্জনের জন্য বহুলোকের টক-ঝাল অনেক কথা শুনতে হয়! কথা বলতে হয় মেপে মেপে! মিশতে হয় বেছে বেছে!

রাজু আহমেদ।  কলাম লেখক।  জিবি নিউজ ||

জীবনের একাংশের সবটুকুতে মজা। জীবনের পরতে পরতে যেনো আনন্দের ছড়া গাঁথা। স্কুলে যেতে মজা, স্কুল পালাতে আরও বেশি মজা। খেলতে মজা, হাঁটতে মজা, দৌড়াতে মজা! খেতে মজা, মারামারি করতেও মজা! ঘুমাতে তো আরো বেশি মজা। সেই বয়সটা চুমু পাওয়ার বয়স; দেওয়ার নয়। ডিজেলের হ্যারিকেন-হ্যাজাকে মাদুর পেতে উঠোনে বসে জোরে জোরে শব্দ করে পড়ার স্মৃতি এখনো সজীব, এখনো আনন্দের। 

 

 ঈদের চাঁদ দেখাতে আনন্দ, বাড়িতে কেউ এলে আনন্দ, কোথাও বেড়াতে গেলেও আনন্দ। দুই টাকায় তখন সুখ কেনা যেত! এক টাকার মার্বেলে একবেলা কেটে যেত! দু'চোখে রহস্যের অন্ত নাই, অন্তরে প্রশ্নের সীমা-পরিসীমা নাই। সদলবলে গোসলে মজা, লুকোচুরি-বউছিতে মজা, এক্কা-দোক্কায় মজা, লুডু-ক্যারামে মজা! জেতার চেয়ে হারে আরও বেশি মজা! হারলেই আবার খেলার জেদ বেশি করে চাপত! কত সুখ, অনন্ত আনন্দ! 

 

নিজেদের আইনে পাড়ার ক্রিকেটে মজা,  বাঁশিহীন অর্ধশতক লোকের দলবলে ফুটবল খেলার মাঝে যে আনন্দ ছিল তা আর কোথায় মিলত! আষাঢ়ের নতুন পানিতে টেংরামাছ ধরা,  পাঁচবেটারি লাইট আর তিন কাঁটার চল নিয়ে বড় মাছ শিকারে উদ্দেশ্যে মাঠে চলে যাওয়ার মাঝে যে সুখ ছিল তা এখন পৃথিবীতে নাই!  সেই পৃথিবীটাই কি আছে?  সাদা-কালো টেলিভিশনের,  আলিফ-লায়লার? 

 

ঢোঙ্গায় ধান সিদ্ধ করার পাশে আগুন পোহানোর সুখ, ডিম-আলু সিদ্ধ দেয়ার সুখ, তেঁতুলের খোসায় ভাত রান্নার সুখ!-কোথায়, কোথায়?  বড় চুলোয় খেজুরের রস থেকে মিঠা বানানো দেখা, সেটাতে মুড়ি দিয়ে মোয়া বানানো দেখা, গোরু দিয়ে ধানের মেই ভাঙা, নারী-পুরুষের কৃষিকাজে পাশাপাশি চলা দেখার আনন্দ থেকে এখন বঞ্চিত হই!

 

বড়দের জাকিজাল দিয়ে মাছ ধরার সময়ে খালুই রাখা, গাছির থেকে তালের রস খাওয়া, হাঁক দিয়ে চলা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে এক টাকায় দুইখান আইসক্রিম পাওয়া-তখন স্বর্গের সুখ ছিল বলে আমার বিশ্বাস!  তখন সবকিছুতে মজা ছিল! কান্নার মাঝেও কেমন সুখ সুখ অসুখ ছিল! 

 

সেই সুখ যদি থেকেও থাকে তবে বয়স আমাকে আর দেখতে দেয় না, পেতে দেয় না সেই সুখ! বয়সের মধ্যভাগ দায়িত্বের। একটা জীবনের সাথে আরও কয়েকটা জীবন যখন জড়িয়ে যায় তখন পা ফেলতেও ভাবতে হয়, গোসলের পানিও হিসেব করে শরীরে ছাড়তে হয়! বুঝে শুনে তবেই পথে বাড়তে হয়!

 

 জীবিকার্জনের জন্য বহুলোকের টক-ঝাল অনেক কথা শুনতে হয়! কথা বলতে হয় মেপে মেপে! মিশতে হয় বেছে বেছে! ইচ্ছা-অনিচ্ছা মূল্যহীন দাঁড়ায়!  কাঁধে দায়িত্ব এলে উচ্ছ্বাস হারিয়ে যায়, সকাল-বিকাল রুটিন করে বয়স বাড়তে থাকে! রোগ-শোক ধরতে থাকে! দুঃখের শিকড় বুনতে থাকে! জীবনের এই অংশে সুখ কদাচিৎ; অসুখ যথোচিত!  

 

আবার একটু পিছনে ফিরি! সেখানেই তো সব ছিল! গতশতকের শেষ দশকে আমাদের শৈশবের মত এই প্রজন্মেরও শৈশব আনন্দঘন? তাদের কাছে হয়তো কিন্তু তখনকার আমরা তা দেখি না! তাদের শৈশব-কৈশোরের সোনালি দিনগুলো মোবাইল গ্রাস করছে। মাঠের খেলাধুলার দখল নিয়েছে অনলাইন গেইম! পড়াশুনায় বৈচিত্র্য বেড়েছে তবে আনন্দ কমেছে! দেশিয় প্রজাতির মাছই বিরল, শিকারের প্রশ্ন তো অবান্তর! বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হচ্ছে ভার্চুয়ালি যা মায়া-মমতাহীন!  

 

এখনকার ঈদের আনন্দ পোশাক পর্যন্ত,  আত্মীয়স্বজনদের সমাগম হলে গৃহস্ত বিরক্ত হয়, যৌথ পরিবার কীভাবে অনু করা যায় সে-ই নিয়ে ষড়যন্ত্র-কৌশল! সন্তানদের অভিভাবকরা এমনভাবে পাহাড়ায় রাখে যেনো ওরা চোর-ডাকাত!  উপায় নাই!  গাঁজা-ইয়াবায় শহর-নগর, পল্লী-গলির মোড় মোড় সয়লাব! আদর্শ ছেলেপুলের চেয়ে নেশাখোরদের দৌরাত্ম্য বেশি! কিশোর-গ্যাঙের কাছে সমাজ জিম্মি! ছেলে-মেয়েতে আক্রোশ বেশি! অভিভাবকরাও সন্তানের চাওয়া-পাওয়া পূরণের মেশিনে পরিনত হয়েছে!  

 

রাষ্ট্রের শিক্ষার হার বাড়ছে তবে গ্রাম-গঞ্জে মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে! শহরে আরও বেশি কমছে! সবাই নেতা হতে চায়!  ক্ষমতার দাবানলে সবাইকে চেপে ধরতে চায়!  খারাপ মানুষের সংখ্যা সব পেশায় বাড়ছে বলেই পেশির তাকত ও অর্থের শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে!  সমাজের ভদ্ররা ইজ্জত নষ্টের ভয়ে নিজেদেরকে গুঁটিয়ে নিয়েছে! চাপা নাভিশ্বাসে সবাই জিম্মি!

 

 আনন্দ এখন নেশায়, মজা ঘুষ খাওয়ায়!  সোনালী সময়ের প্রজন্মের অনেকেই অন্যায়-দুর্নীতিকে বৈধ মনে করছে, ঘুষের লেনদেনকে হালাল করতে উঠে-পড়ে লেগেছে; দিচ্ছে ও নিচ্ছে!  আনন্দহীনভাবে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের কাছে সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থার দায়িত্ব যখন যাবে তখন যে কী হাল হবে তা আর কে সাহস করে বলবে! দুঃখ আছে!  অবশ্য অন্যায়কে পাপ ভাবনার যে অনুভূতি সেটা লোপ পেলে আর কোন দুঃখ থাকবে না। বিবেক কাজ না করলে আর কোন ভোগান্তি হবে না!  ভোগবাদ নেতৃত্বে এলে দুনিয়াতেই সর্বসুখ আমাদের বিশ্বাস-তাদের নীতি এমনটাই হবে!

 

 

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন