বিদায়ী বছরে কূটনৈতিক পাড়ায় সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল মার্কিন ভিসানীতি। সেই ভিসানীতি মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই বছর সমাপ্তির পথে। পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে। প্রধান রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি উচ্চপদস্থদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি-বক্তব্যও শেষ দিকে হয়ে উঠেছে আলোচ্য বিষয়। ২০২৩ সালে মার্কিন ভিসানীতির ফলে অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষই রয়েছেন আতঙ্কে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের বাধা-বিঘ্নের ঘটনায় অনেকেই নিজেদের দূরে রাখাকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন। নতুন বছরের শুরুর দিকে নির্বিঘ্ন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
কূটনীতিকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি নির্বিশেষে বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি কোনো সুখবর নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ বাণিজ্য সম্পর্ক, বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স ঘিরে সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এ দেশটি থেকে এমন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক নয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত ২৪ মে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তার লক্ষ্যে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেন। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে এমন বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগের সদস্য, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অর্থ হলো— ভোট কারচুপি, ভোটারকে ভয়ভীতি দেখানো, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বাধা, রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ, মিডিয়াকে মতপ্রকাশে বাধা দেওয়া। এসব কর্মকাণ্ডের জন্যও ভিসানীতির প্রয়োগ হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
পরে সেপ্টেম্বরে ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে কাদের বিরুদ্ধে ভিসানীতি প্রয়োগ করা হয়েছে, তাদের কোনো নাম ঘোষণা করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যাদের বিরুদ্ধে ভিসানীতির প্রয়োগ হয়েছে, তাদের ব্যক্তিগতভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে যাদের বিরুদ্ধে ভিসানীতির প্রয়োগ হচ্ছে, তাদের মধ্যে সরকার ও বিরোধীপক্ষেরও কারও কারও নাম আছে বলে জানা যায়।
এদিকে মার্কিন ভিসানীতি কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধীদলের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যদি দেশের বাইরে থেকে নির্বাচন বানচাল করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের জনগণও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকার ভীত নয়। কারণ আমরা সর্বদা সংবিধান, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’
তবে, মার্কিন ভিসানীতি কার্যকরের বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘নির্বাচনের আগে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না বলে যুক্তরাষ্ট্র আশ্বাস দিয়েছে।’
‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি আওয়ামী লীগের জন্য খুবই লজ্জাজনক মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে বর্তমান সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকার তাদের অধীনে আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে হবে বলে বিদেশিদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্তু দেশবাসীর পাশাপাশি বিদেশিরাও দেখেছে এর অধীনে অনুষ্ঠিত আগের দুটি নির্বাচনের কোনো মূল্য ছিল না।’
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি সহায়ক হবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আমরা নতুন ভিসানীতি করেছি। বাংলাদেশের মানুষ, সরকার, প্রধানমন্ত্রী এবং সবার জন্য এটি সহায়ক হবে। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্য নতুন ভিসানীতি সহায়ক হবে।
এক সেলফিতে আশার আলো
ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বের শিল্পোন্নত ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদের সাক্ষাৎ হয়। আলাপচারিতার পাশাপাশি তাদের নিয়ে সেলফি তোলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
ওই অনুষ্ঠানের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। সেখানে ক্যাপশনে তিনি লেখেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের President Joe Biden মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর কন্যার সাথে। ছবিটা কে তুলেছে মনে হয়?’
অনুষ্ঠানের আরও কয়েকটি ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট দেন প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, ‘নয়াদিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে চমৎকার গল্প হয়েছে। সম্প্রসারিত জনস্বাস্থ্যের অংশ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব নিয়ে আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি। একই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল সাইকোলজিস্টদের ভূমিকার গুরুত্ব নিয়েও কথা হয়েছে।’
আরও পড়ুন>> বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপে সরগরম কূটনৈতিক পাড়া
এমন সেলফির পর অনেকটা আশার আলো দেখা যায় কূটনৈতিক পাড়ায়। তবে সেই আশা অনেকটা নিরাশায় পরিণত হয় সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে। সেসময় মার্কিন সরকার ভিসানীতি প্রয়োগ শুরুর ঘোষণা দেয়।
ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্কে নতুন মাত্রা
সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফরে আসেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ১৯৯০ সালে তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁর বাংলাদেশ সফরের পর এটি বাংলাদেশে কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় সফর। সফরের দ্বিতীয় দিনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও একান্ত বৈঠক হয়। ঢাকা ও প্যারিস বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট ও বাংলাদেশের নগর অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ে দুটি চুক্তি সই করে।
বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে নতুন কৌশলগত অগ্রযাত্রা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির পক্ষে বাংলাদেশের ভোট
গাজা উপত্যকায় মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার আলোচনা করেও সফল হতে পারেনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার অভিভাবক এ পরিষদের উপর্যুপরি ব্যর্থতার পর গত ২৭ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের গাজায় মানবিক যু্দ্ধবিরতির জন্য আনীত একটি প্রস্তাব দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হয়। এতে মানবিক যু্দ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দেয় বাংলাদেশ। উপস্থিত সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ১২১টি দেশ পক্ষে, ১৪টি বিপক্ষে এবং ৪৪টি দেশ ভোট দানে বিরত থাকে। বাংলাদেশের পক্ষে এ প্রস্তাবে ভোট দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত।
বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে এবং ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সরকারবিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনা করতে বিরোধীপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন- রাশিয়ার পক্ষ থেকে আসা এমন একটি বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, বাংলাদেশ বিষয়ে রাশিয়া যে বক্তব্য রেখেছে, সেটি তাদের ‘ধারাবাহিক অপব্যাখ্যার’ অংশ।
এর আগে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন তাদের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা। পরে মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্স-এ তার বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়।
জাখারোভা বলেন, ‘দেশটির আসন্ন সংসদ নির্বাচন ‘স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ করার ছদ্মাবরণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রভাবিত করার ক্ষেত্র যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রচেষ্টার বিষয় আমরা অব্যাহতভাবে তুলে ধরে আসছি। আমাদের কোনো সন্দেহ নেই যে, বিদেশি ‘শুভাকাঙ্ক্ষীদের’ সহায়তা ছাড়াই জাতীয় শাসনতন্ত্রের বিধানমতো ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখের সংসদ নির্বাচন স্বাধীনভাবে আয়োজনের সক্ষমতা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের আছে।’
সবশেষ গত ১৫ ডিসেম্বর একটি বিবৃতি দিয়েছেন রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সঙ্গে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। গত ১২-১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশে সরকারবিরোধীরা রাস্তাঘাট অবরোধ করে, যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আমরা এসব ঘটনার সঙ্গে ঢাকায় পশ্চিমা কূটনৈতিক মিশনগুলোর, বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক লক্ষ্য করছি। জনগণের ভোটের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সন্তোষজনক মনে না হলে ‘আরব বসন্তের’ মতো করে বাংলাদেশকে আরও অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হতে পারে।
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন