বিধি ভেঙে প্রার্থীদের পক্ষে সরকারি চাকরিজীবীরা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার প্রায় ৪০ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনী মাঠে লড়াই করছেন। এসব প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী ও সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে কাজ করছেন কিছু সরকারি চাকরিজীবী। মন্ত্রীদের পক্ষে নির্বাচনী সংবাদ পাঠাচ্ছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তারা। স্থানীয় পর্যায়ে জেলা-উপজেলার সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারাও এ ধরনের কাজ করছেন।

 

এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ১৬ চিকিৎসক, ছয় সাবেক সেনা কর্মকর্তা, ছয়জন খেলোয়াড়, পাঁচ সাবেক আমলা, দুজন শিক্ষক, দুজন অভিনেতা, একজন শিল্পী এবং একজন করে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও সাংবাদিক।

জানা গেছে, এই ১৬ জন চিকিৎসক ছাড়াও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন অনেক সরকারি চিকিৎসক-নার্স ও মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট। অনেক চিকিৎসক নৌকাসহ বিভিন্ন প্রতীকের ব্যানারে ভোটারদের কাছে গিয়ে ভোট চাইছেন। এতে হাসপাতালে রোগীর সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে।

 

সাধারণ চিকিৎসক-নার্সরা অভিযোগ করছেন, গত ১৮ ডিসেম্বর প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দের পর দিন নির্বাচন কমিশনের পাশেই ঢাকার আগারগাঁওয়ের সড়কে মিছিল করেন স্বাচিপের চিকিৎসকরা। অফিস সময়ে চিকিৎসাসেবার ব্যাঘাত ঘটিয়ে জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল, পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানসহ (নিটোর) আশপাশের বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল থেকে এসে তাঁরা মিছিলে যোগ দেন। সরকারের পক্ষে নানা স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি নৌকা মার্কায় ভোট চান চিকিৎসকরা। সেই মিছিলের ভিডিও তাঁদের ফেসবুক পেজেও শেয়ার করা হয়েছে।

 

কুমিল্লা-১ আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইইবি) সভাপতি আবদুস সবুর। তাঁর পক্ষেও আইইবির প্রকৌশলীরা প্রচার চালাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ভোট চেয়ে ব্যক্তিগত স্ট্যাটাস জেলা-উপজেলার প্রকৌশলীদের ট্যাগ করেছেন।

মেহেরপুর-১ (সদর-মুজিবনগর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান ফোন করে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের বিষয়ে আবদুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি সরকারি কর্মকর্তা হয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন।

তাঁকে বিষয়টি বোঝাতে তিনি ফোন করেছিলেন।

 

মেহেরপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। আর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার নাম অলোক কুমার দাশ।

মন্ত্রীদের প্রচারে জনসংযোগ কর্মকর্তারা

ঢাকা-১২ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্বাচনী গণসংযোগের সময় ও স্থান নিয়মিত সাংবাদিকদের জানাচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু।

আগারগাঁওয়ে সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ সড়কের বিভিন্ন জায়গায় আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ভোট চেয়ে ফেস্টুন টানানো হয়েছে। এসব ফেস্টুনে নাম আছে স্বাচিপের সহসভাপতি মো. আবু রায়হানের। তিনি শ্যামলী টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক।

শরীয়তপুর-২ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীমের পক্ষে প্রতিদিন প্রেস রিলিজ পাঠাচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। কয়েকজন মন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মন্ত্রীদের গ্রামের বাড়িতে থেকে জনসংযোগ কাজে সহায়তা করছেন।

ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ

সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে নৌকার প্রার্থী পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের ভাই আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। ওই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান এমপি জয়া সেন গুপ্তা নির্বাচন কমিশনে (ইসি) অভিযোগ দিয়েছেন, আল মাহমুদের পক্ষে কাজ করছেন দিরাই থানার ওসি ইখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী।

নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম। নজরুল ইসলামের স্ত্রী চিকিৎসক সায়মা আফরোজ আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও)। এই আসনে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আলমগীর সিকদার ওরফে লোটন। তাঁর অভিযোগ, প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে প্রতিদিন সায়মা আফরোজ তাঁর স্বামীর হয়ে প্রচারে নামছেন। এ জন্য তিনি ইসিতে অভিযোগ দিয়েছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা-১৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর কবির নানকের পক্ষে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ ব্লকের অষ্টমতলার কনফারেন্স কক্ষে একটি মতবিনিময়সভা হয়। এতে হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দীন চৌধুরী ও স্বাচিপ মহাসচিব কামরুল ইসলাম মিলন বক্তব্য দেন।

ডা. মিলন হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান। এ সময় হাসপাতালের বেশির ভাগ চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য স্বাচিপ মহাসচিব কামরুল ইসলাম মিলনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দীন বলেন, ‘হৃদরোগ ইনস্টিটিউট জাহাঙ্গীর কবিরের নির্বাচনী এলাকায় পড়েছে। আমরা অনেকে এই এলাকার ভোটার। সেই হিসেবে তিনি আজ (গতকাল) সবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন করেছেন। হাসপাতালের স্বাচিপ সদস্য চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন। তবে আমরা কারো পক্ষে ভোট চাইনি।’

ময়মনসিংহ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহিত উর রহমান শান্তর প্রচারে অংশ নেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক সুধীর চন্দ্র পাল। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব ছবিও পোস্ট করছেন।

চট্টগ্রাম-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জামাল উদ্দিন চৌধুরী। এই চিকিৎসকের নির্বাচনী প্রচারে অনেক সরকারি চিকিৎসক নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন।

চিকিৎসা অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, শুধু সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকই নন, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারেন না। যাঁরা নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়েছেন তাঁরা নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করছেন। কিন্তু সরকারি চাকরিতে থাকা চিকিৎসকদের এমন তৎপরতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব বেশি নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘স্বাচিপ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। ফলে কোনো চিকিৎসক অফিস সময়ের বাইরে গিয়ে প্রচার চালালে আমাদের কিছু করার নেই। চাকরিবিধি অনুযায়ী কাজ ফেলে এমনটা করা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর তথ্য সংগ্রহ করে নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছি। এর পরও কেউ কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে অধিদপ্তর থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধিসংক্রান্ত বিষয়ে রিটার্নিং অফিসার, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। এরপরও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯-এর ২৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো রাজনৈতিক দল বা অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে পারবেন না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বা কোনো ধরনের সহায়তা করতে পারবেন না।

২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালায়ও সরকারি চাকরিজীবীদের ভোটের প্রচারে অংশগ্রহণ বা সহায়তা করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’-এর ২০২১ সালের ২৮ জুন জারি করা প্রজ্ঞাপনের (চ) ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর তিন বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনো ধরনের নির্বাচন বা রাজনৈতিক দলের সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন না।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমন আচরণ চাকরিবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাঁরা জনগণের কাছ থেকে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন এবং তাঁরা কোনো দলের কর্মী নন।

জিবিডেস্ক //

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন