ঢাকার প্রায় ১২ শতাংশ বাড়ি এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১২.৩ শতাংশ ও ঢাকা উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) ১১.৩ শতাংশ বাড়ি রয়েছে। ঢাকার দুই সিটিতে বর্ষা-পরবর্তী এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে।
২০২৩ সালের বছরের ৮ থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডে বর্ষা-পরবর্তী লার্ভা জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা।
এ সময় উত্তর সিটির ৪০টি ও দক্ষিণের ৫৯টি ওয়ার্ডে মোট তিন হাজার ২৮৩টি বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি।
রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ২০২২ সালের বর্ষা-পরবর্তী জরিপে উত্তরে ৩.৮ শতাংশ ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় হার ৪.১৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা বা শূককীটের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। সেই হিসাবে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বর্ষা-পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গুর ঝুঁকি প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।
মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্স বা বিআই সূচকের মাধ্যমে।
বিআই অনুযায়ী, যদি প্রতি ১০০ প্রজনন উৎসর মধ্যে ২০ বা এর অধিক উৎস এডিস লার্ভা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বলা যায়। আর হাউস ইনডেক্স যদি প্রতি ১০০ প্রজনন উৎসর ১০টি হয়, তাহলে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর বর্ষা-পরবর্তী জরিপে উত্তর সিটির ১৩.৪ ও দক্ষিণের ১৪.৬ বিআই পাওয়া গেছে। উত্তরে সর্বোচ্চ বিআই ছিল ২৬.৬ শতাংশ ও দক্ষিণে ৪৬.৬ শতাংশ বিআই পাওয়া গেছে।
ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার শঙ্কা
কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিআই ২০ ও হাউস ইনডেক্স ১০-এর ওপরে গেলে তখন ধরে নেওয়া হয় উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। তখন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া বা মশাবাহিত অন্য রোগ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়।
ড. কবিরুল বাশার বলেন, নতুন বছরে ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যেহেতু ঢাকার বাইরে নতুন করে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে, সুতরাং এবার ঝুঁকিটা একটু বেশি। এ জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ইউনিয়ন পরিষদসহ প্রতিটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানকে এডিস মশা এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
একই সঙ্গে কীটনাশক ও সরঞ্জাম দিতে হবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে।
কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘জরিপে যখন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত হয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উচিত সেই ঝুঁকিগুলো নিরসন করা। এ জন্য দরকার কীটতত্ত্ববিদদের নেতৃত্বে কমিটি। তবে আদৌ সেটা করা হয়নি। শুরু থেকেই আমরা কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতা বাড়ানো কথা বলে আসছি। আমার কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’ তিনি বলেন, ‘মশা এখন দেশজুড়ে ছড়িয়েছে। সে ক্ষেত্রে শুধু ঢাকায় জরিপ করা আংশিক কাজ হলো। আমাদের সারা দেশে জরিপ চালাতে হবে। মশা নিধনে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজ করতে হবে। সরকার মশা নিধনে নতুন কর্মকৌশল নির্ধারণ করেছে। তবে এটিও অনেক দুর্বল।’
আক্রান্ত ৫৮ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৫৮ শতাংশে বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছর। ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর ৪১ শতাংশ এই বয়সীরা। যাদের বেশির ভাগই কর্মজীবী ছিল।
এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী ও ৬০ শতাংশ পুরুষ ছিল। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী ও ৪৩ শতাংশ পুরুষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৩৪ শতাংশ ঢাকায় চিকিৎসা নিয়েছে। ৬৬ শতাংশ চিকিৎসা নিয়েছে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে। ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ ও বরিশাল জেলায়।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই ভূখণ্ডে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। সে সময় একে ‘ঢাকা ফিভার’ নাম দেওয়া হয়েছিল। ২০০০ সালে ডেঙ্গুর বড় ধরনের প্রকোপ দেখা দেয়। এর পর থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে চলতি বছর। এর আগে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ২০২২ সালে, ২৮১ জন। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রথমবার এক লাখ ছাড়ায়। সে বছর ভর্তি হয়েছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। মৃত্যু ১৭৯ জনের।
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন