সিএনএন চ্যানেলে ইউনূসকন্যার সাক্ষাৎকার

ইসরায়েলের হয়ে পক্ষপাতমূলক সংবাদ নীতির কারণে নিজেদের কর্মীদের তোপের মুখে পড়েছে মার্কিন সম্প্রচার মাধ্যম সিএনএন। সংবাদমাধ্যমটির পক্ষপাতমূলক পলিসি ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন খোদ প্রতিষ্ঠানটির কর্মী সাংবাদিকরা। ইসরায়েলের হয়ে পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন করে যাওয়া সেই প্রতিষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ড. ইউনূসের কন্যা ও মার্কিন নাগরিক মনিকা ইউনূস। এ সময় বাংলাদেশের বিচার বিভাগের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি তিনি নিজের বাবার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে দেশের সাংবিধানিক কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে দণ্ড পাওয়া শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে লবিংয়ে নেমেছেন তাঁর কন্যা মনিকা ইউনূস। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএনে দেওয়া সাক্ষাৎকার সেটিরই অংশ। যেখানে তিনি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

মনিকা এমন এক সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যা গাজা যুদ্ধ নিয়ে ইসরায়েলের হয়ে পক্ষপাতমূলক খবর প্রকাশ করায় নিজেদের কর্মীদের তোপের মুখে পড়েছে।

সংবাদমাধ্যমটির কর্মীরাই এই হীন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন এবং সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সিএনএনের নিউজরুম থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও অভ্যন্তরীণ এক ডজন মেমো ও ই-মেইল ঘেঁটে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, আটলান্টার হেডকোয়ার্টার থেকে নির্দেশনা অনুযায়ী মার্কিন সম্প্রচার মাধ্যমটিতে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে সিএনএনের এক কর্মী গার্ডিয়ানকে বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বেশির ভাগ খবর ইসরায়েলের প্রতি নেটওয়ার্কের পদ্ধতিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতিত্বের দ্বারা প্রভাবিত করা হয়েছে। এটি সাংবাদিকতার অপব্যবহারের সমান।

 

 

সংবাদমাধ্যমটিতে হামাসের বক্তব্য এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ রাখা হয়েছে। পক্ষপাতমূলক এই সংবাদমাধ্যমটিতে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে দণ্ড পাওয়া শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কন্যা মনিকা ইউনূস।

এদিকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলা আইনি প্রক্রিয়া বন্ধ করতে নানাভাবে চলছে আন্তর্জাতিক লবিং। তাঁকে ‘আইনি হয়রানি’ বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন হিসেবে একটি যৌথ বিবৃতি ছাপা হয়েছে, যে বিবৃতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ১২ জন সিনেটর। এর আগে বিচার বন্ধে এমনই বিজ্ঞাপন আকারে বিবৃতি দিয়েছেন কয়েকজন নোবেলজয়ী।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ইউনূসের পরিচিত আছে। আর এসব লবিং, বিবৃতি ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিচার বন্ধের আহ্বানকে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর চাপ প্রয়োগ ও হস্তক্ষেপের সামিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

তবে সবচাইতে মজাদার বিষয় হলো ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দেওয়ার জন্য বারবার এই ব্যক্তিদের দেখা গেলেও গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর চলা ইসরায়েলের গণহত্যা বন্ধে এখন পর্যন্ত কোনো কথাই বলেননি এই বিবৃতিদানকারী অধিকাংশ সদস্য। এমনকি এ বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রতি আহ্বান জানিয়ে কোনো বিবৃতি প্রদান করেননি তাঁরা। তবে কি গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার থেকেও বাংলাদেশে ড. ইউনূসের মামলাকে বড় মানবাধিকার ইস্যু হিসেবে দেখছেন তাঁরা?

সিএনএনের সাংবাদিক ক্রিস্টিন আমানপোরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মার্কিন এই নাগরিক তাঁর বাবার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মনিকা বলেন, ‘অভিযোগগুলো মূলত তাঁর কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেটা সাধারণভাবে দেওয়ানি আদালতেই নিষ্পত্তি সম্ভব। কিন্তু এগুলোকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অর্থহীন। ড. ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীরা শতভাগ নির্দোষ। আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞরাও বিষয়টি যাচাই করেছেন। তাঁরাও বলেছেন, এই অভিযোগগুলো বানোয়াট।’

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মনিকা ইউনূস যে কথাটা বলতে চাচ্ছেন, তাতে পরোক্ষভাবে উনি স্বীকার করেই নিয়েছেন, এখানে শ্রম আইন লঙ্ঘন হয়েছে। শ্রম আইন ২০০৬ ও বিধিমালা ২০১৫ আইএলও কর্তৃক স্বীকৃত এবং সেখানে ফৌজদারি একটা আলাদা চ্যাপ্টার আছে।

সুতরাং এ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট যে, বিদেশে বসে একটি পক্ষপাতমূলক সম্প্রচার মাধ্যমে ড. ইউনূসকন্যা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছেন। একজন ভিনদেশি নাগরিক হয়ে তিনি বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে হেয় করতে চেয়েছেন।  

এদিকে  ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মনিকা দাবি করলেও আসলে এই ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সরকারিভাবে। ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে একটি সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে গ্রামীণ ব্যাংক। আর ড. ইউনূস ছিলেন এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সরকারের নিযুক্ত ও বেতনভুক্ত একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক; কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠাতা নন তিনি।

গ্রামীণ ব্যাংক নারীদের ঋণগ্রস্ত করে তুলছে এবং ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছেন, এমন অভিযোগগুলোর বিষয়ে সাক্ষাৎকারে মনিকার কাছে জানতে চাওয়া হলে জবাবে তিনি বলেন, ক্ষুদ্রঋণ সুনির্দিষ্ট একটি মডেল, যা সঠিকভাবে অনুসরণ করা না হলে অন্য যেকোনো জিনিসের মতোই তা ব্যর্থ হতে পারে। অর্থাৎ যাঁরা আত্মহত্যা করেছে তাঁরা নিজেদের ভুলের কারণেই করেছে বলে মত দিয়েছেন তিনি।

এদিকে সাক্ষাৎকারে একাধিকবার ড.ইউনূস কেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিহিংসার শিকার তা জানতে চাইলেও এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মনিকা। আর আইনের যে সকল অসঙ্গতিকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে এই মামলাকে প্রতিহিংসাপরায়ণ দাবি করা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যাসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি না দিয়ে কেনো প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি প্রদান করা হচ্ছে না এ বিষয়েও কোনো ব্যাখ্যা মেলেনি ইউনূসের পক্ষে কাজ করে যাওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে। মনিকাও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে বরং আইন ও নির্বাহী বিভাগের প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাধীন বিচার বিভাগের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে সকল মহল।

গত ১ জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনে দায়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন শ্রম আদালত।

ইউনূসের বিরুদ্ধে আনা কল্যাণ তহবিলে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করার মতো অভিযোগগুলো আদালতে প্রমাণিত হয়েছে।

সাজা পেয়ে শ্রম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে ইউনূস। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে আরো অনেক মামলা। গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের লভ্যাংশের ২৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে একটি মামলায় ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে দুদক।

২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের তখন গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটকে রাখা হয়।

আর সেই রাজনীতি নিষিদ্ধ ও রাজনীতিবিদদের জেল-জুলমের সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন একটি রাজনৈতিক দল খুলতে মাঠে নামেন। জরুরি অবস্থার মধ্যেই তিনি নাগরিক শক্তি নামের রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য ব্যাপক তোড়জোড় চালিয়েছিলেন, যা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়।

রাজনীতিতে ইউনূসের আগ্রহের বিষয়ে মনিকা বলেন, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি একবারের জন্য এটা ভেবেছিলেন। তবে তাঁর রাজনৈতিক কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই।

তবে উইকিলিকস থেকে ফাঁস হওয়া গোপন নথিতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধান দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠাতে চেয়েছিলেন এই নোবেলজয়ী। জেনারেল মইন ইউ আহমেদের লেখা বই এবং আরো কিছু নথি থেকে এটি স্পষ্ট ছিল যে, এক-দুই বছরের জন্য নয়, বরং দীর্ঘ মেয়াদে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক সরকার গঠনের জন্য ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন ড. ইউনূস।

জিবিডেস্ক //

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন