একাকীত্ব সুস্থ অস্তিত্বের জন্য হুমকি!

এই যে একাকীত্ব, এতো যে হতাশা তার অধিকাংশ এসেছে অতিরিক্ত ভোগবাদী মানসিকতা এবং স্বার্থপরতার পথ গলিয়ে

রাজু আহমেদ।  প্রাবন্ধিক।| 

একাকী থাকার সময়ে কেউ যদি একাকীত্ব অনুভব করে তবে সেটার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব! সঙ্গীর কাছে, পারিবারের সাথে, বন্ধুদের মাঝে গেলেই এই একাকীত্ব নামক বেদনার মেঘ কেটে যাবে। কিন্তু! যদি সবার মাঝে থেকেও, সবার সাথে মিশেও হঠাৎ হঠাৎ কাউকে একাকীত্ব গ্রাস করে তবে সেটা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। সবার মাঝে থেকেও একাকীত্ব যদি কাউকে ডাকে, মস্তিষ্কের সেলগুলোর ওপরে নিয়ে নেয় কর্তৃত্ব তবে হতাশা-বিষন্নতা থেকে রক্ষা পাওয়া শুধু কঠিন নয়, কখনো কখনো অসম্ভবও! 

 

কখন এমন ভয়ানক অস্তিত্ব ঘিরে ধরে? যখন জীবনের সবকিছু ভালো লাগে, সবকিছু রঙিন দেখায় তখন এমন একাকীত্বের প্রশ্ন অবান্তর। যদি যখন-তখন খেতে ভালো লাগে,  ঘুরতে ভালো লাগে এমনকি দিনভর ঘুমুতে ভালো লাগলেও এই একাকীত্ব ভর করার সুযোগ পায় না। যদি বই পড়তে ভালো লাগে তবেও তাঁরও একাকীত্ব নাই! তবে সারাদিন যদি মোবাইল নিয়ে কাটাতে ভালো লাগে, অতীতের ছবিগুলো দেখে বর্তমান নিয়ে দুঃখ আসে তবে ধরে নিতে হবে একাকীত্ব আসতে শুরু হয়েছে! যদি আপনজন থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয়, লুকিয়ে রাখতে হয় হৈ-চৈ থেকে তবে সেখানে বিষন্নতা-হতাশার ঢেউ খেলতে শুরু করেছে! এখন সুনামির অপেক্ষা!

 

দাম্পত্যের একটা সময়ে ভয়ানক একাকীত্ব আসতে পারে! সেটা দু’জন চার দেয়ালে পাশাপাশি থাকার পরেও, একই ছাদের নিচের পরিবার ভর্তি মানুষজন গমগম করার পরেও সেই একাকীত্ব দেখা দিতে পারে। মান-অভিমানের দিনগুলো যদি অবেহলায় ডুবে যায়, যত্নের বদলে যদি সন্দেহ-সংশয় ভরে যায়, পাতা নড়ার শব্দেও যদি বাতিক হয়, অপ্রাপ্তির ছলনা যদি দুঃখের কারণ হয়, মনের মাঝে দমিয়ে রাখা ইচ্ছাগুলো যদি কেউ জানাতে না চায় তবে একেক জনের আলাদা আলাদা পৃথিবীতে জীবনযাপন শুরু হতে পারে। সাধারণত দাম্পত্যের মধ্য বয়সে একাকীত্বের এই প্রবল ঢেউ আঘাত হানতে পারে। তখন ঘটতে পারে নানান অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। অল্প একটু টনকেই ভেঙে পড়তে পারে আজন্মের লালিত ঢাল! 

 

এই যে একাকীত্ব, এতো যে হতাশা তার অধিকাংশ এসেছে অতিরিক্ত ভোগবাদী মানসিকতা এবং স্বার্থপরতার পথ গলিয়ে। অধিকার বঞ্চিত হওয়া, বিশ্বাস-ভরসা হারিয়ে যাওয়া, আস্থার নিশ্চয়তা মুছে যাওয়ার কারণে নীরস একাকীত্ব বাড়ছে। বন্ধনের মধ্যে থেকেও মানুষের সন্দেহ সাংঘাতিক পরিসরে বাড়ছে। সংক্রমিত ঢেউ হয়ে একাকীত্ব ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রাণে প্রাণে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদেরকে এমনভাবে অসামাজিক বানাচ্ছে যাতে রক্তের বন্ধন কিংবা বন্ধুত্বের বন্ধন বারবার আঘাতে আঘাতে দাহ হচ্ছে। এই যে পারস্পারিক অবিশ্বাস, পাশাপাশি থেকেও আলাদা আলাদা জগতে বসবাস এসবের ভাবনা মানুষকে একাকীত্বের দরিয়ায় নিক্ষেপ করছে! মনের মধ্যে জ্বালিয়েছে অশান্তির দাবানল। 

 

এখান থেকে উত্তরণের উপায়? আছে। ভালো কাজে ব্যস্ততা বাড়াতে হবে। ধর্ম গ্রন্থের সাথে সর্বশেষ কবে দেখা হয়েছিল আমরা অনেকেই ভুলে গেছি! হারানো সে অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে হবে। যা অন্তরে বিশ্বাস করি তা বলতে হবে। সঙ্গীর মান-অভিমান এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভাষা বুঝতে হবে। প্রত্যেক সম্পর্কের অন্তর্নিহিত বার্তার সাথে মিথস্ক্রিয়া রাখতে হবে। এই আমি একা নই, অনেক 'আমি'র মিশ্রণ-এই বোধটুকু না জন্মালে মানুষ বারবার একা হতে হবে!

 

শারীরীক অনেক বড় বড় অসুখের চেয়েও মানসিকভাবে একাকীত্ব আরও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেখানে ভালোবাসা আছে, যা কিছু পছন্দের সে-সবের সাথে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলতে হবে। মনের কথা বলতে হবে, লিখতে হবে, শুনতে হবে এবং পড়তে হবে। একা থাকার কারণে যদি একাকীত্ব বাসা বাঁধে তবে নিয়মিত বিরতিতে পরিবার, বন্ধুমহলের কাছে ফিরতে হবে। ছুটে যেতে হবে ভালোবাসার দ্বারে। 

 

নিজেকে ভালো রাখার জন্য অন্য মানুষের চেয়ে নিজেকে বেশি সময় দিতে হবে। ভালোবাসতে হবে অফুরাণ। গান শুনতে হবে, কবিতায় নিজেকে হারাতে হবে। পা বাড়াতে হবে পৃথিবীর পথে! যদি সবার মাঝে থেকেও একাকীত্ব অনুভূত হয় তবে সেটা যথেষ্ট কনসার্নের বিষয়! এটা যে কাউকে মানসিকভাবে, শারীরীকভাবে এবং অবস্থান-মর্যাদাগতভাবে পঙ্গু করে দিতে হবে। ভালোর সাথে থেকে আলো মাখুন-অন্ধকার কাটিয়ে সবার সাথে বাহির দেখুন। সবকিছু সুন্দর-আপনাকে বরণ সরতে সেজে আছে ধরিত্রী!  আপনি কেন্দ্র! এই সুন্দরের সব আয়োজন আপনাকে ঘিরে!

 

 

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন